
রাজধানীর উত্তরায় দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যু এবং অন্তত ১৭১ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গতকাল সোমবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বর্ণনায়। কেউ ক্যান্টিনে ছিল, কেউ ক্লাস শেষ করে নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা দেখলো, হঠাৎ করে যেন সবকিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
দুর্ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন। তাদের পাশাপাশি মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীসহ আশেপাশের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা উদ্ধার কার্যক্রমে সহায়তায় করেন। গতকাল বিকেলে দিয়াবাড়ির ঘটনাস্থলে মাইলস্টোনের কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, দুপুর ১টা ৬ মিনিটে হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এলাকা। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান আচমকা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রথমে স্কুলের পাঁচতলাবিশিষ্ট সাত নম্বর ভবনের ছাদে ধাক্কা লাগে। পরে বিমানটি স্কুল সেকশনের দোতলা ভবনে পড়ে বিধ্বস্ত হয়।
প্রাথমিক ধাক্কার পর বিমানটি পাশের দোতলা ভবনের ওপর ভেঙে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। ওই ভবনে তখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শতাধিক শিক্ষার্থী অবস্থান করছিল। বিস্ফোরণের তীব্রতায় ভবনে আগুন ধরে যায়, মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো কাঠামোয়। দুর্ঘটনার সময়ে কিছু শিক্ষার্থী ক্লাস শেষ করে কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল, কেউ কেউ ক্যান্টিনে বা সিঁড়ি ও বারান্দায় অবস্থান করছিল। বিস্ফোরণের তাপে ও ধোঁয়ায় অনেক শিক্ষার্থী হতাহত হয়, কেউ কেউ ভবনের ভেতরেই দগ্ধ অবস্থায় আটকে পড়ে। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার, আতঙ্ক আর ছুটোছুটিতে এলাকা রূপ নেয় মৃত্যুপুরীতে। ফায়ার সার্ভিস ও উদ্ধারকর্মীরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং আহতদের বের এনে করে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠান।
মাইলস্টোনের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিনহাজ জানায়, আমি তখন স্কুল ক্যান্টিনে খাবার খাচ্ছিলাম, হঠাৎ বিকট শব্দ শুনি। দেখলাম, বিমানটি পাঁচতলা ভবনে ধাক্কা খেয়ে দোতলা ভবনে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়। সবাই চিৎকার করছে, দৌড়াচ্ছে। অনেক ছোট ভাইবোনের শরীরে আগুন ধরে যায়। প্রতিষ্ঠানটির একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মিরাজ বলেন, চোখের সামনে অনেক ছোট ভাইবোনকে পুড়তে দেখেছি। কারও শরীর ছিন্নভিন্ন। বুঝতেই পারছিলাম না আমি স্বপ্ন দেখছি, নাকি সত্যি! শাহরিয়া নামে একাদশ শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা পাশের ভবনে ক্লাস করছিলাম। হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠি। জানালায় তাকিয়ে দেখি দোতলা ভবনে আগুন। কয়েক সেকেন্ড পরেই পুরো ভবনটা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। একই ক্লাসের অনিক শেখ বলেন, জীবনে প্রথম মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখলাম। আগুন, ধোঁয়া আর ছুটোছুটি এই শব্দগুলো মাথায় গেঁথে গেলো। আমাদের স্কুলটা যেন এক নিমিষেই মৃত্যুপুরী হয়ে উঠলো।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক নুরুজ্জামান মৃধা বলেন, যে ভবনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, সেখানে পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ক্লাস চলতো। দুপুর একটার দিকে ক্লাস শেষ হলেও অনেকে প্রাইভেট কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। তখনই বিমানটি ভবনের ওপর পড়ে। আমাদের অনেক শিক্ষার্থী হতাহত হয়েছে। তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিট এবং ৬টি অ্যাম্বুলেন্স উদ্ধার অভিযানে নামে। আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ভবনের ভেতরে ও আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দগ্ধ, রক্তাক্ত ও নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের খোঁজ চলছে। এই দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে বেশির ভাগই স্কুলপড়ুয়া শিশু ও কিশোর।
উল্লেখ্য, রাজধানীর উত্তরায় দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২০ জন নিহতের কথা জানিয়েছে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর)। আহত হয়েছে ১৭১ জন। নিহতদের মধ্যে বিমানটির পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামও রয়েছেন।