
গণঅভ্যুত্থানের এক বছর
* বিএমইউতে জুলাই আহতদের মধ্যে ৬৩ শতাংশের আত্মহত্যার চিন্তা
* শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসনে ৩০ কোটি টাকার প্রকল্প
* প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবেন ৮৮২ জন ক্ষতিগ্রস্ত
* ধীরে ধীরে সব সংকটই কেটে যাবে : স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব
* ৫ বিভাগের ২১ জেলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর হলো। এখনো হাসপাতালে আহতরা। চিকিৎসকরা বলছেন, তাদের হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই। যদিও হাসপাতাল ছাড়তে নারাজ তারা। সেখানে থেকে কখনো সহযোদ্ধাদের সঙ্গে, কখনো হাসপাতালের কর্মীদের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছে। এমনকি বাইরে গিয়েও মারামারি করে আসার ঘটনাও ঘটেছে। এতে সতীর্থরা যেমন বিব্রত, একইভাবে মনোক্ষুণ্ন তাদের সমর্থকরা। বিপাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসকরা মৌখিকভাবে বলে আসছেন, জুলাই আহতদের শারীরিক, আর্থিক ও মানসিক সংকট আছে। লম্বা সময় হাসপাতালে থেকে সেটি আরও প্রকট হচ্ছে। দ্রুত তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। মুখের কথায় যেমন আহতরা মানেননি, সরকারও আমলে নেয়নি।
এ সমস্যা সমাধানে পথ দেখিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ)। তারা তাদের হাসপাতালে ভর্তি ৫৪ জনের ওপর গবেষণা করে সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ পেশ করে। সরকারও সারাদেশের জুলাই আহতদের নিয়ে একটি পুনর্বাসন এবং আরোগ্য প্রকল্প দাঁড় করিয়েছে। এতে ৩০ কোটি টাকা অর্থায়ন করবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সরকারের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এটি চার ধাপে বাস্তবায়ন করবে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মক সংকটে আছে। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের পরিচালিত এক মনস্তাত্ত্বিক মূল্যায়নে উঠে এসেছে, আহতদের মধ্যে চারজন হতাশা থেকে যৌথ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। দিন দিন তাদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। গত ২৯ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি ৫৪ জন আহত রোগীর ওপর গবেষণা করে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
পর্যবেক্ষণ, সাক্ষাৎকার ও তিনটি মানসম্মত মনস্তাত্ত্বিক মূল্যায়ন পদ্ধতি ব্যবহার করে এ গবেষণা সম্পন্ন হয়। ব্যবহৃত মূল্যায়ন পদ্ধতিগুলো হলো ডিপ্রেশন অ্যাংজাইটি স্ট্রেস স্কেল-২১ বাংলা সংস্করণ, বাংলা পিটিএসডি চেকলিস্ট ফর ডিএসএম-৫ (পিসিএল-৫) এবং কলম্বিয়া-সুইসাইড সেভিয়ারিটি রেটিং স্কেল (সি-এসএসআরএস)।
মূল্যায়নের ফলাফলে দেখা যায়, ৫৪ জনের মধ্যে ৩৬ জন বা ৬৭ শতাংশ পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে (পিটিএসডি) ভুগছেন। ২৬ জনের মধ্যে চরম মাত্রার বিষণ্ণতার লক্ষণ, ২৪ জন চরম উদ্বেগে আক্রান্ত এবং ১৪ জনের মধ্যে চরম মানসিক চাপের লক্ষণ পাওয়া গেছে। যেসব আহত ব্যক্তি উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও চাপের মধ্যে রয়েছেন তাদের বয়স ১৭ থেকে ৬৮ বছরের মধ্যে।
মূল্যায়ন অনুযায়ী, ৫৪ জনের মধ্যে ৩৪ জন বা ৬৩ শতাংশ আহত ব্যক্তি বিভিন্ন মাত্রার আত্মহত্যার চিন্তা করছেন। তাদের মধ্যে ১১ জনের আত্মহত্যামূলক আচরণ গুরুতর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, এটি একটি বড় মানসিক স্বাস্থ্য সংকট। আত্মহত্যার ঝুঁকির দিক থেকে দেখা গেছে, চারজন অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ফলাফল সরকারের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা। জুলাই বিপ্লবে আহতদের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এখনই নিশ্চিত করা জরুরি, নয়তো পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
গবেষক দলের প্রধান, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও মনোবিজ্ঞানী ডা. সেলিনা ফাতেমা বিনতে শহীদ বলেন, আমাদের মূল্যায়নে দেখা গেছে, জুলাই বিপ্লবের আহত অনেকে পিটিএসডি, বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও মানসিক চাপে ভুগছেন। কিছু ব্যক্তি মাদকাসক্তও হয়ে পড়েছেন এবং আত্মহত্যার চিন্তা বা প্রচেষ্টার ঝুঁকিতে আছেন। তাদের মানসিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও কাউন্সেলিং জরুরি। আহত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন, শিক্ষাগত ও পেশাগত পুনর্গঠন এবং অর্থনৈতিক সহায়তারও প্রয়োজন আছে। অধিকাংশই নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, কারণ তারা মনে করেন বিরোধীরা তাদের আক্রমণ করতে পারে। তাই তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থাও দরকার।
গত বছর গণঅভ্যুত্থান চলাকালে চোখে আঘাতপ্রাপ্ত ৫৫ তরুণের ওপর গবেষণা চালায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। তাদের বেশিরভাগই ২২ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থী, যারা চোখের চিকিৎসার জন্য জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল আহত তরুণরা কী মাত্রায় বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও মানসিক চাপে ভুগছেন তা নিরীক্ষা করা।
গবেষণায় দেখা যায়, আহতদের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ হালকা থেকে গুরুতর বিষণ্নতায় ভুগছেন এবং তাদের মধ্যে ২৫ শতাংশের অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর স্তরে পৌঁছেছে। গবেষণায় আরও দেখা যায়, ৫০ শতাংশেরও বেশি ভুক্তভোগী হালকা থেকে গুরুতর উদ্বেগে ভুগছেন, ২০ শতাংশের বেশি অত্যন্ত গুরুতর উদ্বেগের সঙ্গে লড়াই করছেন এবং প্রায় ৬০ শতাংশ মানসিক চাপে ভুগছেন। জুলাই আহতদের স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে দীর্ঘদিনের ভাবনা ও প্রচেষ্টার পর একটি পথ বের করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আহতদের শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। চিকিৎসা ও পুনরুদ্ধারের পথ : সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে একটি টিকে থাকা-ভিত্তিক পদ্ধতি শীর্ষক প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় পরিচালিত এ প্রকল্প ২০২৫ সালের জুন থেকে ২০২৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চলবে।
প্রকল্পটির মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে ৮৮২ জন ক্ষতিগ্রস্ত এবং পরোক্ষভাবে প্রায় আট হাজার ব্যক্তি উপকৃত হবেন। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং সামাজিক সংহতি গড়ে তোলা। প্রকল্পের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে মেডিকেল সেবা, পুনর্বাসন ও সহায়ক যন্ত্রপাতি সরবরাহ, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও কাউন্সেলিং, আয় সৃষ্টিমূলক কর্মসূচি এবং সচেতনতামূলক প্রচার ও কমিউনিটি এনগেজমেন্ট। দেশের পাঁচটি বিভাগের ২১ জেলায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। আন্তর্জাতিক অংশীদার হিসেবে ড্যানিশ রেড ক্রস ও সুইডিশ রেড ক্রসও প্রকল্পে যুক্ত রয়েছে।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, জুলাই আহতদের চিকিৎসা, পুনর্বাসনসহ নানাবিধ বিষয় আমাদের অগ্রাধিকারে রয়েছে। এরই মধ্যে দেশ-বিদেশে তাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়েছে। যাদের অঙ্গহানি হয়েছে, ব্র্যাক লিম্ব ও ব্রেস সেন্টারের (বিএলবিসি) মাধ্যমে সেটিও সংযোজনের কাজ চলমান। তাদের চিকিৎসা, মানসিক অবস্থার উন্নতি ও পুনর্বাসনের নানান উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের প্রচেষ্টায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে একটি প্রকল্প আমরা হাতে নিয়েছি। আশা করি, ধীরে ধীরে সব সংকটই কেটে যাবে।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, আমরা অনেক ভালো কাজ করি। এর মধ্যে অন্যতম জুলাই আহতদের নিয়ে এ প্রকল্পটি। এরই মধ্যে প্রোগ্রাম পরিকল্পনা হয়েছে। আমরা কাজ শুরু করেছি। শিগগির দৃশ্যমান হবে আমাদের কাজ।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) কেবিন ব্লকের দুটি ফ্লোরে ৫৪ জন রোগী ছিলেন। তবে ১৩ জুলাই পর্যন্ত ৩৩ জন ছিলেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) আছেন ১০ জন। হাসপাতালটির পরিচালক জানিয়েছেন, তাদেরও এখন হাসপাতালে থাকা জরুরি নয়।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে প্রায় এক হাজার জুলাইতে আহত চিকিৎসা নিয়েছেন। সেখানে ৫৫ জন গত জুন মাস পর্যন্ত ছিলেন। নানান নাটকীয়তার পর তারা বাড়ি ফিরেছেন। সাতজন তুরস্কে চিকিৎসা নিতে গেছেন। তাদের পুনর্বাসন জরুরি। এছাড়া ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ২০ জন চিকিৎসাধীন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ৮৬৪ জন নিহত ও ১৪ হাজার আহত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। গত রোববার (১৩ এপ্রিল) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান। আহতদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আহতদের মধ্যে চোখ হারিয়েছেন ৭০০ জন। এর মধ্যে দুই চোখ হারিয়েছেন ২১ জন। এক চোখ হারিয়েছেন সাড়ে চারশ’র মতো। এসব রোগীর যে মানসিক ট্রমা সেটা চিকিৎসার জন্য যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার দরকার সেটা আমাদের এখানে নেই। তবে, তাদের এ মানসিক ট্রমা কমানোর জন্য আমরা চেষ্টা করছি। এ দায়িত্ব শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের না। এ দায়িত্ব আমাদের সবার।