
* বিশ্বের ইসরায়েলসহ ৮৫ দেশে পিআর পদ্ধতি চালু আছে
* ভোটার প্রায় পৌনে ১৩ কোটি, কেন্দ্র বাড়ছে ৪৫ হাজার
* পিআর পদ্ধতি কী, এটা বাংলাদেশের মানুষ শুনে নাই: মির্জা আব্বাস
* পরিস্থিতি সুখকর নয়, নতুন সংকটের মুখে দেশ: প্রিন্স
‘নির্বাচনে হতে হবে ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর) পদ্ধতিতে’- জামায়াত ইসলামী নেতাদের এমন বক্তব্য নতুন করে আলোচনা তৈরি করেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। প্রশ্ন উঠছে যে, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন পদ্ধতিকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্কই আগামী নির্বাচনকে সংকটে ফেলে দেয় কী না। কারণ দেশের এ মুহূর্তের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি দৃশ্যতই এই পিআর পদ্ধতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত হলে দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। এজন্য নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজনীয়তার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন রাজনীতিবিদরা। তবে বিশ্বের ইসরায়েলসহ ৮৫ দেশে পিআর পদ্ধতি চালু আছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী শনিবারের সমাবেশ থেকে এই পদ্ধতিতেই ভোটের পক্ষে তার অবস্থান আরও সুদৃঢ়ভাবে প্রকাশ করেছে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। তবে বিএনপি সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে জামায়াতের এই তৎপরতাকে দেখছে ‘নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল’ হিসেবে। দলটির নেতারা মনে করেন, সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি অংশ নিজেদের স্বার্থে ‘নতুন ইস্যু’ সামনে এনে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করতে পারে। তবে জামায়াত বলছে, প্রচলিত পদ্ধতিতে জনমতের প্রতিফলন ঘটছে না বলেই তারা পিআর পদ্ধতি চাইছেন। দলটির একজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, ‘কোয়ালিটি নির্বাচনের’ জন্যই নতুন পদ্ধতিতে নির্বাচন হওয়া উচিত বলে তারা মনে করেন। এমন পরিস্থিতিতে দু’পক্ষই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিজেদের পক্ষে টানা এবং নিজেদের অবস্থানের পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, ক্ষমতার ভাগাভাগিসহ রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য সরকার কিংবা অন্য কারও ওপর চাপ তৈরির জন্যই ‘পিআর পদ্ধতিতে’ নির্বাচনের দাবিটি সামনে আনা হয়ে থাকতে পারে। তবে তারা এটাও মনে করেন যে, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব না ঘুচলে সেটি আগামী বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে সংকটে ফেলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে লন্ডনে বৈঠকের পর দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় জামায়াতে ইসলামীর নেতারা ছাড়াও তাদের সমমনা বিভিন্ন দলের নেতারা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে ভোটের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। এই সমাবেশে জামায়াতের সিনিয়র নেতারা কেউ কেউ ‘পিআর পদ্ধতির দাবি না মানলে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে আদায়ে’র কথা বলেছেন। দলটি তাদের যে সাত দফা দাবিতে এই সমাবেশের আয়োজন করেছিল তার মধ্যে একটি হলো- এই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি। সমাবেশের মঞ্চেও এটি গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করা ছিল। জামায়াতের এই সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে অন্য কয়েকটি দলের নেতারাও পিআর পদ্ধতির কথা বলেছেন। এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, নির্বাচনে উচ্চকক্ষে যারা পিআর চায় না তারা ফ্যাসিবাদী হতে চায়। ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনূস আহমাদ বলেছেন, নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতেই হতে হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এর আগে পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হলেও তাতে একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপি পিআর পদ্ধতিতে ভোটের প্রস্তাবকে আমলেই নিতে রাজি নয়। অন্যদিকে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি ও গণ অধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে। এ কারণেই প্রশ্ন উঠছে যে, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এই বিরোধ নতুন কোনো পরিস্থিতির জন্ম দেয় কি-না, যা আগামী বছরের প্রথমার্ধের সম্ভাব্য নির্বাচনকে সংকটে ফেলে দিতে পারে।
এ বিষয়ে কথা হয় বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, নির্বাচনকে বিলম্বিত করার ‘ষড়যন্ত্র ও কৌশল’ হিসেবেই এসব ইস্যু সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। তিনি বলেন, নির্বাচন সময়মতো অনুষ্ঠিত হলে সংকট থাকবে না। মানুষ ভোট দিয়ে তার প্রতিনিধি নির্বাচন করবে এবং সেই প্রতিনিধিরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। সেই ভোটই মানুষ দেখতে চায় বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, পিআর পদ্ধতি, এই নাম বাংলাদেশের মানুষ শোনে নাই। কাকে পিআর পদ্ধতি বলা হয়, পিআর পদ্ধতি কী, এটা বাংলাদেশের মানুষ শোনে নাই। তিনি বলেন, পৃথিবীর ৮০টা দেশে পিআর পদ্ধতি আছে। এই ৮০ দেশের পিআর পদ্ধতি ৮০ রকম। সুতরাং যারা পিআর নিয়ে কথা বলেন, পিআর নিয়ে একটু পড়াশোনা করেন। পিআর নিয়ে একটু জানবেন, জেনে তারপরে কথা বলবেন। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, যারা পিআর পদ্ধতির কথা বলছে, তারাও পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে জানে না। তিনি বলেন, একেক রাজনৈতিক দল একেক সময় একেক কথা বলছে, একটি দল বারবার বলছে নির্বাচন হবে, আবার বলছে এই অবস্থায় নির্বাচনে যাওয়া যায় না। একজন বলে দিল আর আমরা নাচলাম, এটা তো হবে না ভাই। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ প্রচলিত প্রক্রিয়ায় আমাদের পূর্বপুরুষরা যেভাবে নির্বাচন করে এসেছেন, সেই নির্বাচন সুষ্ঠু সুন্দর হলে দেশের কোনো কিছুর প্রয়োজন হবে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, দেশের বর্তমান অবস্থায় সরকারের ভেতরে আওয়ামী লীগের আমলারা যা করছে, তাতে আমার ধারণা, এই সরকার নির্বাচন করতে পারবে না। আমরা এসব আমলাকে প্রতিহত করব। অতঃপর আমরা নির্বাচন আদায় করব। শুধু বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসই নয়, দলটির নেতাদের অনেকে প্রকাশ্যেই বিভিন্ন সভা সমাবেশে এই পিআর পদ্ধতির প্রস্তাবের সমালোচনা করছেন। তাদের অভিযোগ ‘নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য বড় জয়’ ঠেকানোর জন্যই এসব প্রস্তাব সামনে আনা হচ্ছে। যদিও এমন অভিযোগ মানতে রাজি নন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে মানুষ দলকেই ভোট দেয় এবং কোয়ালিটি নির্বাচন ও সংসদের জন্য পিআর পদ্ধতিই সর্বোত্তম বলে মনে করেন তারা। তিনি অবশ্য এ বিষয়টিকে ঘিরে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমরাও একই ধরনের কথা বলতে পারি। কিন্তু এটি আলোচনার টেবিলে রয়েছে। এটা নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি করে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। একটা সমাধান ঐকমত্য কমিশনের সভা থেকে আসবে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, দেশের পরিস্থিতি ‘সুখকর’ নয়। দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা না হলে, দেশ ভয়াবহ সংকটে পড়তে পারে। তিনি বলেন, সরকারে থাকা কিছু মানুষের কথা ও কাজে দেশে নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, পিআর পদ্ধতিকে ঘিরে যে বিতর্ক হচ্ছে তার মূল্য উদ্দেশ্য রাজনৈতিক স্বার্থ ও ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্ন। দলগুলো নিজের স্বার্থ অনুযায়ী অবস্থান নিয়েছে। কেউ নিজ স্বার্থে বিরোধিতা করছে। আবার কেউ নিজেদের স্বার্থে এর পক্ষে কথা বলছে। এখানে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নই বড়। নির্বাচন পর্যন্ত এটা চলতে থাকবে। নির্বাচনের আগে মীমাংসা না হলে যেভাবে আছে সেভাবেই নির্বাচন হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, যেহেতু সরকার প্রধান নিজেই নির্বাচন ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে হওয়ার কথা বলেছেন সেটি এখন আর পেছানোর সুযোগ নেই। সরকার দৃঢ় থাকলে নির্বাচন নিয়ে সংকট আমি দেখি না। দলগুলো হয়তো এসব ইস্যু এনে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে কিছুটা সুবিধা নিতে চাইছে বলে জানান মহিউদ্দিন আহমেদ।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় ৩০০টি আসনে আলাদা আলাদা প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলো। অন্যদিকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোনো দল মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবেন। পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুক্ত, গোপন ও মিশ্র তিনটি আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ এবং ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
ভোটার প্রায় পৌনে ১৩ কোটি, কেন্দ্র বাড়ছে ৪৫ হাজার: আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে প্রায় ১২ কোটি ৭৫ লাখে। নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তির ফলে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভোটকেন্দ্র বাড়িয়ে প্রায় ৪৫ হাজারে উন্নীত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ছিল ৪২ হাজার ১৪৮টি।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্র বৃদ্ধির বিষয়টি চূড়ান্ত করতে শিগগিরই একটি সমন্বয় সভা ডাকা হবে। ওই সভায় কেন্দ্র নির্ধারণ, ব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। বর্তমানে অধিকাংশ ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে অনেক স্কুল-কলেজে নেই সীমানা প্রাচীর কিংবা দরজা-জানালাগুলো জরাজীর্ণ। এসব কেন্দ্রকে নিরাপদ ও ব্যবহারযোগ্য করতে শিক্ষা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং এলজিইডিকে নির্দেশ দিয়েছে ইসি। কেন্দ্র বাড়ার ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়বে বলে জানা গেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আনসার, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ড মিলিয়ে প্রায় সাড়ে সাত লাখ সদস্য মোতায়েন ছিল। এবার সে সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দৈনিক ভাতা ৪০০ টাকা থেকে ১,৮২০ টাকা পর্যন্ত নির্ধারিত ছিল। কেন্দ্র বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনায় ব্যয়ও বাড়বে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। যদিও ইসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোটের নিরাপত্তা, অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সবধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পিআর পদ্ধতি কী, জানে না সাধারণ মানুষ: পিআর পদ্ধতি কী এটা বাংলাদেশের অনেক নাগরিকের একেবারেই অভিজ্ঞতা নেই এবং পিআর সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো জনগণের মতামতের যথাযথ প্রতিফলন। তবে অনেক সময় প্রচলিত ভোট পদ্ধতিতে দেখা যায়, একটি দল সীমিত ভোট পেয়েও অধিকাংশ আসনে জয়ী হয়ে যায়, আর অধিক ভোট পাওয়া দলের কোনো আসনই থাকে না। এমন বৈষম্য থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে বিশ্বের বহু দেশ গ্রহণ করেছে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (চজ) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা। এই পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দল বা জোট যে পরিমাণ ভোট পায়, তার আনুপাতিক হারে সংসদে আসন পায়। ফলে গড়ে ওঠে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায্য প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদ। তবে আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা হলো এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে ভোটারদের রায় প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলগুলোর ভোট প্রাপ্তির হার অনুযায়ী। উদাহরণস্বরূপ, কোনো দল যদি ১০% ভোট পায়, তাহলে সংসদে তাদের আসনও হবে প্রায় ১০% হারে। তবে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে বর্তমানে প্রচলিত ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ (এফপিটিপি) পদ্ধতিতে যে দল বেশি আসনে জয় পায়, তারা সরকার গঠন করে, ভোটের মোট শতাংশ নয়। যেমন: ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৪০.৮৬% ভোট পেয়ে পেয়েছিল ১৯৩টি আসন, আর আওয়ামী লীগ ৪০.২২% ভোট পেয়ে মাত্র ৬২টি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৮.০৪% ভোট পেয়ে ২৩০টি আসন পেয়েছিল, আর বিএনপি ৩২.৫০% ভোট পেয়ে পেয়েছিল মাত্র ৩০টি। এমন পরিস্থিতিতে পিআর পদ্ধতি চালু থাকলে দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব আরও ভারসাম্যপূর্ণ হতো। তবে বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে-চারটি দল একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। একজন প্রার্থী ২৫% ভোট পেলেও বাকিরা মিলে ৭৫% ভোট পেলেও, প্রচলিত পদ্ধতিতে সেই ২৫% প্রার্থীই জয়ী হবে। অর্থাৎ ৭৫% ভোটের কোনো কার্যকর প্রতিনিধিত্ব থাকবে না। প্রথমবার ১৮৯৯ সালে বেলজিয়ামে চালু হয় পিআর পদ্ধতি। বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ৯১টি, অর্থাৎ ৫৪% দেশে, পিআর ভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উন্নত দেশের সংগঠন ওইসিডি’র ৩৬টি দেশের মধ্যে ২৫টি, অর্থাৎ প্রায় ৭০% দেশ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে।
পিআর পদ্ধতির ধরন: ১. মুক্ত তালিকা পদ্ধতি: দলগুলো ভোটের ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে আসন পায়। ২. বদ্ধ তালিকা পদ্ধতি: দল ঠিক করে দেয় কে হবেন সংসদ সদস্য। ৩. মিশ্র পদ্ধতি: কিছু আসনে প্রতীকভিত্তিক, কিছু আসনে পিআর ভিত্তিতে নির্বাচন হয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে কিছু রাজনৈতিক দল এই পদ্ধতি চালুর পক্ষে মত দিয়েছে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা শুধু রাজনৈতিক ভারসাম্যই নয়, গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর করার একটি বড় মাধ্যম। উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতা ও দেশে বিভিন্ন নির্বাচনের বৈষম্যমূলক ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের এখন এ বিষয়টি নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
বিশ্বের ইসরায়েলসহ ৮৫ দেশে পিআর পদ্ধতি চালু: আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। যদি কোনো দল মোট প্রদত্ত ভোটের ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবে। ১৭৭৬ সালে আমেরিকান বিপ্লবের সময় দেশটির রাষ্ট্রপতি জন অ্যাডামস তাঁর প্রভাবশালী পুস্তিকা ‘থটস অন গভর্নমেন্ট’-এ আনুপাতিকতার প্রথম প্রস্তাবনাগুলি দিয়েছিলেন। তবে আধুনিক বিশ্বে সর্বপ্রথম ১৮৯৯ সালে বেলজিয়ামে পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ৯১টি দেশ, অর্থাৎ প্রায় ৫৪ শতাংশ রাষ্ট্র, তাদের আইনসভা নির্বাচনে কোনো না কোনো ধরনের পিআর পদ্ধতি অনুশীলন করে। মূলত উন্নত বিশ্বে পিআর পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বেশি। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডির ৩৬টি সদস্য দেশের মধ্যে ২৫টি, অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ দেশ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন ও লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশে এই ব্যবস্থা প্রচলিত। তবে পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়নের একাধিক উপায় রয়েছে। প্রধান তিনটি উপায় হলো-মুক্ত তালিকা, গোপন তালিকা ও মিশ্র পদ্ধতি। আরেকটি তথ্যৈ দাবি করা হয়েছে, তালিকাভিত্তিক সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনীব্যবস্থা ৮৫টি দেশে রয়েছে। মিশ্র সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনীব্যবস্থা সাতটি দেশে ব্যবহৃত হয়। আর একক স্থানান্তরযোগ্য ভোটদান, যা আয়ারল্যান্ড, মাল্টা, অস্ট্রেলিয়ার সিনেট ও ভারতের রাজ্যসভা সদস্য নির্বাচনে ব্যবহৃত হয়। মোটামুটিভাবে ইউরোপের নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানি (আংশিক); এশিয়ায় ইসরায়েল, ইন্দোনেশিয়া ও নেপাল; আফ্রিকায় দক্ষিণ আফ্রিকা ও নামিবিয়া; লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা এবং উত্তর আমেরিকায় আংশিকভাবে কানাডার পিআর পদ্ধতিই আলোচনার দাবি রাখে। তবে বিশ্বে পিআর পদ্ধতির একটি ক্লাসিক উদাহরণ হচ্ছে ইসরায়েল, যেখানে পুরো দেশই একক ভোট এলাকা। যে দল মাত্র ৩.২৫ শতাংশ ভোট পায়, তারাও আসন পায়। এতে ছোট দলগুলো সব সময় সংসদে প্রবেশ করে। কিন্তু এ পদ্ধতির কারণে দেশটির সরকার নানা ধরনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জটিলতার মুখে রয়েছে।