
* নৌকায় করে তেল সংগ্রহ করেন মাঝিরা
* সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে শত শত কোটি টাকা
* জড়িত অসাধু কর্মকর্তা ও স্থানীয় সিন্ডিকেট
দেশের জ্বালানি খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র চট্টগ্রামের পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল ডিপোতে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তেল চুরির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। জাহাজের নাবিক ও ডিপোর অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গায়েব হয়ে যাচ্ছে শত শত কোটি টাকার তেল।
সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ প্রতিবেদনে তেল চুরির ভয়াবহ চিত্র উঠে আসার পর কর্ণফুলী নদী এবং বঙ্গোপসাগরে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার জন্য কোস্টগার্ডের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা গত ৬ মে তেল চুরি সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তাতে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল ডিপো থেকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তেল চুরির ভয়াবহ চিত্র সামনে এসেছে। এরপর তেল চুরি রোধে বিপিসি পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) ড. এ কে এম আজাদুর রহমান চিঠি দিয়ে কোস্টগার্ডের সহযোগিতা কামনা করেন।
আজাদুর রহমান বলেন, চুরির বিষয়টি উদ্বেগজনক। আমরা ডিপোগুলোকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার কাজ শুরু করেছি। পাশাপাশি অভিযান পরিচালনায় কোস্টগার্ডের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন পর্যায়ে জ্বালানি তেল চুরি ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতি বছর সরকার শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। আমদানি করা জ্বালানি তেল প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃনোঙ্গরে অবস্থানরত মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে ডিপোগুলোতে আনা হয়। এরপর ডিপো থেকে সড়ক, রেল ও নদীপথে ট্যাংকার, ট্যাংক লরি ও রেল ওয়াগনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়।
প্রতিবেদন অনুসারে, এই পুরো প্রক্রিয়ায় নানা স্তরে তেল চুরি হয়। যার পেছনে রয়েছেন তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর কিছু অসাধু কর্মকর্তা, স্থানীয় সিন্ডিকেট, জাহাজের নাবিক ও অন্যান্য সহযোগীরা। তেল পরিবহনের ব্যবহৃত ২০০ লিটারের প্রতিটি ড্রামে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে গড়ে ১৫ থেকে ২০ লিটার করে অতিরিক্ত তেল ভরে দেওয়া হয়। যা পরবর্তীতে কালোবাজারে চলে যায়, উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে দেশি-বিদেশি জাহাজ নিয়মিত পণ্য খালাস করে। সন্ধ্যার পর চোরাই তেল পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এই নদী পথ। জাহাজে কর্মরত নাবিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘জরুরি মালামাল পৌঁছে দেওয়ার’ অজুহাতে মাঝিরা নৌকায় করে তেল সংগ্রহ করেন। এই তেল চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, স্থানীয় পেট্রোল পাম্প, খোলা বাজার ও ইঞ্জিনচালিত নৌযান চালকদের কাছে বিক্রি হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাইটার জাহাজেও অবৈধভাবে বাংকারিং করা হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান—পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল লিমিটেডের নিজস্ব জাহাজ ব্যবহার করেও চুরি চলছে বলে প্রতিবেদনে অভিযোগ আনা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, চুরির সঙ্গে কারা জড়িত তা গোয়েন্দা সংস্থার বিশ্লেষণে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। চুরি ও দুর্নীতির লাগাম টানতে প্রতিবেদনে একাধিক সুপারিশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। যার মধ্যে রয়েছে তেল কোম্পানিগুলোকে দ্রুত অটোমেশন ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় আনা; তেলবাহী ট্যাংক লরিতে জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ডিজিটাল লক স্থাপন; তেল লোড ও আনলোডের সব স্থান সিসিটিভির আওতায় আনা এবং তেল পরিমাপে নিয়োজিত সার্ভেয়ার কোম্পানি, জাহাজ মাস্টার, নাবিকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত ও একটি স্বতন্ত্র ‘ইনস্পেকশন কমিটি’ গঠন করে সরবরাহ পদ্ধতি তদারকি করা। এছাড়া, ‘ট্রানজিট লস’ বা ‘অপারেশন লস’ এর যৌক্তিক হার নির্ধারণ এবং অভ্যন্তরীণ মনিটরিং কমিটির মাধ্যমে প্রকৃত মজুত যাচাই, চট্টগ্রাম-ঢাকা পাইপলাইন প্রকল্প, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্প ও মূল ডিপোর অটোমেশন প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ এসেছে প্রতিবেদনে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এই খাতের ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির রাশ টানতে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। তা না হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে অভিযান চালিয়েছে দুদক। সরকারি এলপি গ্যাস বিক্রয়ে অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাপ্ত অভিযোগে প্রেক্ষিতে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এনফোর্সমেন্ট টিমের সদস্যরা এই অভিযান পরিচালনা করেন। গণমাধ্যমকে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা ও উপ পরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম এমন তথ্য জানিয়ে ছিলেন।
তিনি আরো জানিয়েছিলেন,দুদক কর্মকর্তারা অভিযানকালে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট সংগৃহীত রেকর্ডপত্র, সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য এবং ডিলার ও গ্রাহকদের বক্তব্য গ্রহণ করেন। তাদের বক্তব্য ও রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিপিসি’র সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লি. প্রতি বছর প্রায় ১৩-১৪ হাজার মেট্রিক টন এলপিজি গ্যাস প্রায় ১৪ লাখ সিলিন্ডারে বোতলজাত করে ০৪ টি প্রতিষ্ঠান যথা: পদ্মা, যমুনা, মেঘনা ও এশিয়াটিক -এর মাধ্যমে বাজারজাত করে। যেখানে প্রতি ১২.৫ কেজি এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডারের এর খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৬৯০/-। উক্ত সিলিন্ডারসমূহ উল্লিখিত ৪টি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিবন্ধিত ডিলারদের মাধ্যমে বাজারে সরবরাহের জন্য প্রদান করা হয়, যারা সরকারি ৬৯০ টাকা মূল্যের এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার হতে ক্রস ফিলিং এর মাধ্যমে বেসরকারি সিলিন্ডারে বোতলজাত করে প্রতি সিলিন্ডার ১৪০০ -১৫০০ টাকা দরে অসাধুভাবে বিক্রয় করে।
অভিযানকালে একজন ডিলার কর্তৃক ১০/১৫ জন ডিলারের অথরাইজেশন নিয়ে একাই বরাদ্দকৃত গ্যাস উত্তোলন ও অধিক মূল্যে বিক্রয়ের তথ্য পায় দুদক টিম। সার্বিক বিবেচনায়, মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ও ভুয়া লাইসেন্স ব্যবহার করে সরকারি গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করা হচ্ছে এমনটি টিমের নিকট পরিলক্ষিত হয়, যাতে এলপি গ্যাস লি., বিপিসি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ব্যাপক অবহেলা ও তদারকির অভাব রয়েছে মর্মে টিমের নিকট প্রতীয়মান হয়। এ প্রক্রিয়ায় অসাধুভাবে সরকারি গ্যাস অধিক মূল্যে বিক্রয় করে অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে মর্মে প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে টিম এ অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে কমিশনের পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করবে।
এ বিষয়ে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন্স ও পরিকল্পনা) ড. এ কে এম আজাদুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তিতে করে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে কোস্টগার্ডকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি একটি তদন্ত কমিটি গঠন প্রক্রিয়াধীন। তিনি বলেন,আমদানি করা ক্রুড ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) মাধ্যমে পরিশোধন করে বিপণন কোম্পানিগুলোকে দেওয়া হয়। ইআরএল থেকে সরবরাহ করা জ্বালানিপণ্য পরিমাপের জন্য কাস্টডি ফ্লো মিটার নামে অটোমেশন প্রকল্প এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এটি চালুর জন্য ইআরএল আরও এক মাস সময় চেয়েছে। এরপর ইআরএল পুরোপুরি অটোমেশনের আওতায় চলে আসবে। পাশাপাশি এসপিএম ও ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইন প্রকল্প শেষ হয়েছে। প্রকল্প দুটির কার্যক্রম শুরু হলে জ্বালানি জাহাজ থেকে গ্রহণ থেকে শুরু করে ডিপোগুলোতে পাঠানো পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপে সিস্টেম লস কিংবা চুরি অনেকাংশে কমে যাবে।
বিপিসির এ পরিচালক বলেন, পদ্মা, মেঘনা, যমুনার প্রধান ডিপোসহ সবগুলো ডিপোকে অটোমেশনের আওতায় আনার জন্য একটি প্রকল্পের ফিজিবিলিটি চলছে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে সারাদেশের জ্বালানি তেল বিপণন কার্যক্রম পুরোপুরি অটোমেটেড হয়ে যাবে। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে সময়ের প্রয়োজন। তাছাড়া বিপিসির জনবলেও সংকট রয়েছে।
* সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে শত শত কোটি টাকা
* জড়িত অসাধু কর্মকর্তা ও স্থানীয় সিন্ডিকেট
দেশের জ্বালানি খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র চট্টগ্রামের পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল ডিপোতে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তেল চুরির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। জাহাজের নাবিক ও ডিপোর অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গায়েব হয়ে যাচ্ছে শত শত কোটি টাকার তেল।
সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ প্রতিবেদনে তেল চুরির ভয়াবহ চিত্র উঠে আসার পর কর্ণফুলী নদী এবং বঙ্গোপসাগরে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার জন্য কোস্টগার্ডের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা গত ৬ মে তেল চুরি সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তাতে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল ডিপো থেকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তেল চুরির ভয়াবহ চিত্র সামনে এসেছে। এরপর তেল চুরি রোধে বিপিসি পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) ড. এ কে এম আজাদুর রহমান চিঠি দিয়ে কোস্টগার্ডের সহযোগিতা কামনা করেন।
আজাদুর রহমান বলেন, চুরির বিষয়টি উদ্বেগজনক। আমরা ডিপোগুলোকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার কাজ শুরু করেছি। পাশাপাশি অভিযান পরিচালনায় কোস্টগার্ডের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন পর্যায়ে জ্বালানি তেল চুরি ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতি বছর সরকার শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। আমদানি করা জ্বালানি তেল প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃনোঙ্গরে অবস্থানরত মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে ডিপোগুলোতে আনা হয়। এরপর ডিপো থেকে সড়ক, রেল ও নদীপথে ট্যাংকার, ট্যাংক লরি ও রেল ওয়াগনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়।
প্রতিবেদন অনুসারে, এই পুরো প্রক্রিয়ায় নানা স্তরে তেল চুরি হয়। যার পেছনে রয়েছেন তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর কিছু অসাধু কর্মকর্তা, স্থানীয় সিন্ডিকেট, জাহাজের নাবিক ও অন্যান্য সহযোগীরা। তেল পরিবহনের ব্যবহৃত ২০০ লিটারের প্রতিটি ড্রামে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে গড়ে ১৫ থেকে ২০ লিটার করে অতিরিক্ত তেল ভরে দেওয়া হয়। যা পরবর্তীতে কালোবাজারে চলে যায়, উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে দেশি-বিদেশি জাহাজ নিয়মিত পণ্য খালাস করে। সন্ধ্যার পর চোরাই তেল পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এই নদী পথ। জাহাজে কর্মরত নাবিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘জরুরি মালামাল পৌঁছে দেওয়ার’ অজুহাতে মাঝিরা নৌকায় করে তেল সংগ্রহ করেন। এই তেল চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, স্থানীয় পেট্রোল পাম্প, খোলা বাজার ও ইঞ্জিনচালিত নৌযান চালকদের কাছে বিক্রি হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাইটার জাহাজেও অবৈধভাবে বাংকারিং করা হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান—পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল লিমিটেডের নিজস্ব জাহাজ ব্যবহার করেও চুরি চলছে বলে প্রতিবেদনে অভিযোগ আনা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, চুরির সঙ্গে কারা জড়িত তা গোয়েন্দা সংস্থার বিশ্লেষণে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। চুরি ও দুর্নীতির লাগাম টানতে প্রতিবেদনে একাধিক সুপারিশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। যার মধ্যে রয়েছে তেল কোম্পানিগুলোকে দ্রুত অটোমেশন ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় আনা; তেলবাহী ট্যাংক লরিতে জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ডিজিটাল লক স্থাপন; তেল লোড ও আনলোডের সব স্থান সিসিটিভির আওতায় আনা এবং তেল পরিমাপে নিয়োজিত সার্ভেয়ার কোম্পানি, জাহাজ মাস্টার, নাবিকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত ও একটি স্বতন্ত্র ‘ইনস্পেকশন কমিটি’ গঠন করে সরবরাহ পদ্ধতি তদারকি করা। এছাড়া, ‘ট্রানজিট লস’ বা ‘অপারেশন লস’ এর যৌক্তিক হার নির্ধারণ এবং অভ্যন্তরীণ মনিটরিং কমিটির মাধ্যমে প্রকৃত মজুত যাচাই, চট্টগ্রাম-ঢাকা পাইপলাইন প্রকল্প, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্প ও মূল ডিপোর অটোমেশন প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ এসেছে প্রতিবেদনে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এই খাতের ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির রাশ টানতে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। তা না হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে অভিযান চালিয়েছে দুদক। সরকারি এলপি গ্যাস বিক্রয়ে অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাপ্ত অভিযোগে প্রেক্ষিতে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এনফোর্সমেন্ট টিমের সদস্যরা এই অভিযান পরিচালনা করেন। গণমাধ্যমকে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা ও উপ পরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম এমন তথ্য জানিয়ে ছিলেন।
তিনি আরো জানিয়েছিলেন,দুদক কর্মকর্তারা অভিযানকালে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট সংগৃহীত রেকর্ডপত্র, সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য এবং ডিলার ও গ্রাহকদের বক্তব্য গ্রহণ করেন। তাদের বক্তব্য ও রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিপিসি’র সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লি. প্রতি বছর প্রায় ১৩-১৪ হাজার মেট্রিক টন এলপিজি গ্যাস প্রায় ১৪ লাখ সিলিন্ডারে বোতলজাত করে ০৪ টি প্রতিষ্ঠান যথা: পদ্মা, যমুনা, মেঘনা ও এশিয়াটিক -এর মাধ্যমে বাজারজাত করে। যেখানে প্রতি ১২.৫ কেজি এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডারের এর খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৬৯০/-। উক্ত সিলিন্ডারসমূহ উল্লিখিত ৪টি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিবন্ধিত ডিলারদের মাধ্যমে বাজারে সরবরাহের জন্য প্রদান করা হয়, যারা সরকারি ৬৯০ টাকা মূল্যের এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার হতে ক্রস ফিলিং এর মাধ্যমে বেসরকারি সিলিন্ডারে বোতলজাত করে প্রতি সিলিন্ডার ১৪০০ -১৫০০ টাকা দরে অসাধুভাবে বিক্রয় করে।
অভিযানকালে একজন ডিলার কর্তৃক ১০/১৫ জন ডিলারের অথরাইজেশন নিয়ে একাই বরাদ্দকৃত গ্যাস উত্তোলন ও অধিক মূল্যে বিক্রয়ের তথ্য পায় দুদক টিম। সার্বিক বিবেচনায়, মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ও ভুয়া লাইসেন্স ব্যবহার করে সরকারি গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করা হচ্ছে এমনটি টিমের নিকট পরিলক্ষিত হয়, যাতে এলপি গ্যাস লি., বিপিসি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ব্যাপক অবহেলা ও তদারকির অভাব রয়েছে মর্মে টিমের নিকট প্রতীয়মান হয়। এ প্রক্রিয়ায় অসাধুভাবে সরকারি গ্যাস অধিক মূল্যে বিক্রয় করে অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে মর্মে প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে টিম এ অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে কমিশনের পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করবে।
এ বিষয়ে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন্স ও পরিকল্পনা) ড. এ কে এম আজাদুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তিতে করে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে কোস্টগার্ডকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি একটি তদন্ত কমিটি গঠন প্রক্রিয়াধীন। তিনি বলেন,আমদানি করা ক্রুড ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) মাধ্যমে পরিশোধন করে বিপণন কোম্পানিগুলোকে দেওয়া হয়। ইআরএল থেকে সরবরাহ করা জ্বালানিপণ্য পরিমাপের জন্য কাস্টডি ফ্লো মিটার নামে অটোমেশন প্রকল্প এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এটি চালুর জন্য ইআরএল আরও এক মাস সময় চেয়েছে। এরপর ইআরএল পুরোপুরি অটোমেশনের আওতায় চলে আসবে। পাশাপাশি এসপিএম ও ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইন প্রকল্প শেষ হয়েছে। প্রকল্প দুটির কার্যক্রম শুরু হলে জ্বালানি জাহাজ থেকে গ্রহণ থেকে শুরু করে ডিপোগুলোতে পাঠানো পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপে সিস্টেম লস কিংবা চুরি অনেকাংশে কমে যাবে।
বিপিসির এ পরিচালক বলেন, পদ্মা, মেঘনা, যমুনার প্রধান ডিপোসহ সবগুলো ডিপোকে অটোমেশনের আওতায় আনার জন্য একটি প্রকল্পের ফিজিবিলিটি চলছে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে সারাদেশের জ্বালানি তেল বিপণন কার্যক্রম পুরোপুরি অটোমেটেড হয়ে যাবে। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে সময়ের প্রয়োজন। তাছাড়া বিপিসির জনবলেও সংকট রয়েছে।