
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের আগস্টে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। রিজার্ভে দুর্বলতা, উচ্চমূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগে মন্দাসহ নানা সংকটে দেশকে ফেলে চলে যায় বিগত সরকার। এরপর ব্যবসা বাণিজ্যে হামলা, জ্বালানি সংকট, বিনিয়োগ-কর্মসংস্থানে স্থবিরতায় যখন পুরো অর্থনীতি টালমাটাল, তখনই রাজস্ব কর্মীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা কঠিন আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছে সারাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। এনবিআরের বিদ্যমান সংকট নিরসন নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে সরকার। এতে বলা হয়, এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই আন্দোলন পরিকল্পিত ও দুরভিসন্ধিমূলক, যা জাতীয় স্বার্থ এবং নাগরিক অধিকারের চরম পরিপন্থি। তবে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আন্দোলনরত এনবিআর কর্মকর্তাদের নির্ধারিত বৈঠক হচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর ঐক্য পরিষদ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, রাজধানীসহ সারাদেশে কর ও ভ্যাট আদায় কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে করে আমদানি পণ্য খালাস হচ্ছে না, জাহাজে উঠছে না রফতানিমুখী পণ্য। বন্দরে নেই হাঁকডাক ও ব্যস্ততা। শুল্ক-কর আদায় হচ্ছে না। সারাদেশের কর অফিসেও নেই কোনো কার্যক্রম। অর্থবছরের শেষ সময়ে বিপুল অঙ্কের বকেয়া রাজস্ব আদায়ের কথা থাকলেও তাও আদায় হচ্ছে না।
এদিকে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা অবিলম্বে এই সংকটের সমাধান চেয়েছেন। পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের দাবি, রাজস্ব কর্মীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউনে’ দিনে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ক্ষতি বাড়তেই থাকবে। তাই সরকারকে দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান করতে হবে।
জানা গেছে, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে গত ২৩ জুন থেকে কর্মবিরতি পালন করছে বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, দেশের পোশাক শিল্প হচ্ছে সবচেয়ে বড় খাত। যেখানে রফতানি হয় প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার, আমদানি হয় ২০ মিলিয়ন ডলার। ৬৫ মিলিয়ন ডলার হলো ট্রানজেকশন। এটা যদি কর্মদিবস দিয়ে ভাগ করা হয় তাহলে প্রতিদিন আড়াই হাজার থেকে ২৬০০ কোটি টাকার মতো বলা যাবে না ক্ষতি হচ্ছে এটা ব্যাঘাত হচ্ছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, প্রকৃতপক্ষে আমরা যারা ব্যবসা করি আমাদের এনবিআর, কাস্টমস তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ব্যবসাটা করার চেষ্টা করি। কারণ, বাস্তবতা হলো আমরা তাদের কাছে জিম্মি। ক্ষমতার কন্ট্রোল নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে, টাকা-পয়সার বণ্টন নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। মাঝপথে আমরা বিপদগ্রস্ত হচ্ছি। এরা সারাজীবন আমাদের জ্বালিয়েছে, এখন সরকারকে জ্বালাচ্ছে, এখন পুরা জাতিকে জ্বালাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এই কর্মসূচি অর্থনীতির জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। এটা অর্থনীতির শ্বাসনালিকে একেবারে চেপে ধরার মতো। অর্থনীতি শ্বাস নিতে পারবে না। বাণিজ্য না হলে কারখানায় উৎপাদন হবে না, খামারে চাষ হবে না, এমনকি দোকানে পণ্য আসবে না।
এনবিআর বিভক্তির জেরে সংস্থার চেয়ারম্যানকে অপসারণের দাবিতে প্রায় দুই মাস ধরে আন্দোলন করছেন এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত ১ সপ্তাহ ধরে এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে কলমবিরতি কর্মসূচি পালন হচ্ছে। গত শনিবার প্রথমবারের মতো কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে তারা সারাদেশে সংস্থার সব কাস্টম হাউস, ভ্যাট কমিশনারেট ও আয়কর অফিসে কর্মবিরতি পালন করেন। এতে কোনো অফিসেই কাজকর্ম হয়নি। গত ১২ মে মধ্যরাতে এনবিআর বিলুপ্ত করে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এর বিরুদ্ধে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের যৌক্তিক কর্মসূচির ফলে সরকার গত ২৫ মে একটি বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে এনবিআর বিলুপ্ত না করে বরং এটিকে সরকারের একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত বিভাগের মর্যাদায় আরও শক্তিশালী করা, রাজস্ব নীতি প্রণয়ণের লক্ষ্যে আলাদা একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গঠন করা এবং প্রয়োজনীয় সব সংশোধনের পূর্ব পর্যন্ত জারি করা অধ্যাদেশটি কার্যকর করা হবে না বলে জানায়। তদপ্রেক্ষিতে ঐক্য পরিষদ একইদিনে তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর কাজে যোগ দিলেও আন্দোলনকারীরা এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে অটল থাকেন এবং সংস্থার কার্যালয়ে তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেন। পরে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় অফিসে ফেরেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
এদিকে গতকাল রোববার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের মাধ্যমে এই বিবৃতি বলা হয়, সরকার আশা করে দ্রুত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থলে ফিরে যাবেন এবং আইনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসবেন। অন্যথায় দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় কঠোর হতে বাধ্য হবে সরকার। এতে জানানো হয়, দেশের বাজেট ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নমুখী কার্যক্রম পরিচালনার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো দুর্বল রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের প্রয়োজনের তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহ অনেক কম। এর মূল কারণ হলো রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার নানা দুর্বলতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি। এ প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার সব অংশীজনের পরামর্শ অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সরকার গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে যে, রাজস্ব সংস্কারের কাজ বাধাগ্রস্ত করার জন্য কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী নজিরবিহীনভাবে গত ২ মাস ধরে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি এবং রাজস্ব আদায় কার্যক্রম অন্যায় ও অনৈতিকভাবে ব্যাহত করে আন্দোলনের নামে চরম দুর্ভোগ তৈরি করেছে যা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। সরকারের পক্ষ থেকে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি বিবেচনায় নেয়ার সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয় এবং আলোচনায় আসার আহ্বান জানালেও তারা তা অগ্রাহ্য করে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান না করে তারা আন্দোলনের নামে অনমনীয় অবস্থান নিয়ে ক্রমাগত দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করে চলেছে।
এ পরিস্থিতিতে অতি জরুরি আমদানি-রফতানি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কার্যক্রম চলমান রাখার জাতীয় স্বার্থে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন সব কাস্টমস হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনসমূহের সব শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অপরদিকে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আন্দোলনরত এনবিআর কর্মকর্তাদের নির্ধারিত বৈঠক হচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর ঐক্য পরিষদ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলমান অচলাবস্থা নিরসনের উপায় খুঁজতে গতকাল রোববার বিকেল ৪টায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের যুগ্ম মহাসচিব শফিউল বাসার বাদল বলেন, অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আমাদের বসার কথা ছিল। এজন্য আমরা মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচি স্থগিত করি। আমাদের একটা প্রতিনিধিদল বৈঠকে অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি স্থগিত না করলে তিনি আলোচনায় বসবেন না। আমরা কর্মসূচি স্থগিত করে আলোচনায় বসবো না। তিনি বলেন, আবার ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়তে চাই না। কর্মসূচি চলমান অবস্থায় আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের অপসারণ ও সব পক্ষের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে রাজস্ব খাতের সংস্কারে দাবিতে প্রতিষ্ঠানটিতে দ্বিতীয় দিনের মতো ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ চলছে। এর অংশ হিসেবে আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ফলে বন্দরে পণ্য খালাস ও জাহাজে তুলতে না পারায় আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। কেবল বৈদেশিক যাত্রীসেবা চালু রয়েছে।