ফ্ল্যাট বিক্রিতে ধস, নির্মাণ খাতে ছাঁটাইয়ের শঙ্কা

আপলোড সময় : ২৭-০৬-২০২৫ ০১:০১:৪৩ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ২৭-০৬-২০২৫ ০১:০১:৪৩ অপরাহ্ন
রাজধানীসহ দেশের আবাসন ও নির্মাণ খাত বর্তমানে এক গভীর সংকট পার করছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এ খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একদিকে ফ্ল্যাট বিক্রি অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে, অপরদিকে নতুন প্রকল্প হাতে নিতে পারছে না বেশিরভাগ আবাসন প্রতিষ্ঠান। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে-অনেক ডেভেলপার প্রকল্প বাতিল বা স্থগিত করছেন, কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, এমনকি কেউ কেউ নির্মাণ ব্যয়ের চেয়েও কম দামে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
রিহ্যাবের (রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) পরিচালক আইয়ূব আলী জানান, গত কয়েক মাসে ফ্ল্যাট বিক্রি গড়ে ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। বড় প্রতিষ্ঠান কিছুটা টিকে থাকলেও ছোট ও মাঝারি ডেভেলপাররা বেতন, অফিস ভাড়া ও কিস্তি পরিশোধেও হিমশিম খাচ্ছেন। কেউ কেউ নির্মাণ ব্যয়ের নিচে গিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রি করছেন, শুধু চলতে পারার জন্য।
ক্রিডেন্স হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিল্লুল করিম বলেন, নতুন ফ্ল্যাট বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে। দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে এটা হয়তো কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ হলো ‘ড্যাপ’ (ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান)। জমি পাওয়া যাচ্ছে না, নকশা পাস করাও দুরূহ হয়ে পড়েছে। রাজউক কর্মকর্তারাও অনেক সময় স্পষ্ট ব্যাখ্যাও দিতে পারছেন না।
বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে চাহিদার পতন আরও বেশি। বিটিআইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ আর খান বলেন, বেশি দামের ইউনিটগুলো বিক্রির ক্ষেত্রে আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তবে মাঝারি দামের ফ্ল্যাট কিছুটা বিক্রি হচ্ছে। কারণ সেগুলোর চাহিদা নির্ভর করে বসবাসের প্রয়োজনীয়তার ওপর।
২০২২-৩৫ সালের জন্য প্রণীত ঢাকা মহানগরের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) কার্যকর হওয়ার পর থেকে আবাসন খাতে নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। পুরনো নিয়মে যেসব এলাকায় ১০ তলা বা তার বেশি ভবন নির্মাণ সম্ভব ছিল, সেখানে এখন ৫ থেকে ৬ তলার অনুমোদন মিলছে। আয়তনের এই হ্রাস জমির মালিকদের অনাগ্রহী করে তুলেছে যৌথ প্রকল্পে। ফলে নতুন প্রকল্পের সম্ভাবনাও সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
রিহ্যাবের সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, আবাসন খাতে এক ধরনের স্থবিরতা এসেছে। ড্যাপের মাধ্যমে উচ্চতা ও ঘনত্বের সীমাবদ্ধতা এমনভাবে আরোপ করা হয়েছে যা বেশিরভাগই বৈষম্যমূলক ও বাস্তবতাবিবর্জিত। আমরা ২০০৮ সালের ড্যাপের মতো উচ্চতা সীমা ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছি, যাতে আবাসন খাতের গতি ফেরে। তিনি বলেন, ড্যাপ অনুযায়ী ভবনের উচ্চতা ও আয়তনে কঠোর সীমাবদ্ধতা আরোপ করায় বর্তমানে জমির মালিকরা তাদের জমি ডেভেলপারদের কাছে হস্তান্তর করতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছেন। এতে নতুন আবাসন প্রকল্প শুরু করা কঠিন হয়ে পড়েছে। যা শুধু আবাসন খাতই নয়, এর সঙ্গে যুক্ত প্রায় ২০০টিরও বেশি লিংকেজ শিল্পে মারাত্মক মন্দা সৃষ্টি করেছে।
রিহ্যাব সভাপতি বলেন, রড, সিমেন্ট, ইট, কেবল, রঙ, টাইলস, লিফট, থাই অ্যালুমিনিয়াম, স্যানিটারি সামগ্রীসহ আবাসন-নির্ভর শিল্পগুলো চরম ধসের মুখে। চাহিদা না থাকায় রডের বাজার ৫০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন হ্রাসে বাধ্য হচ্ছে, শুরু হয়েছে শ্রমিক ছাঁটাইও। তিনি আরও জানান, এই খাতে সরাসরি প্রায় ৪০ লাখ মানুষ কর্মরত, আর পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন অন্তত ২ কোটি মানুষ। এই সংকট যদি দীর্ঘায়িত হয়, তবে এর প্রভাব হতে পারে আরও ভয়াবহ। সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে দেশের অর্থনীতির এক বৃহৎ খাত চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
বাজেটে কালোটাকা বৈধ করার সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। বাড়তি কর দিয়ে কালো টাকা বৈধ করার যে সুযোগ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেওয়া হয়েছিল তা বাতিল করে নতুন অর্থবছরের বাজেটে পাস করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। ফলে কালোটাকা সাদা করার পথ বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান।
গত রোববার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি। এ সময় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে বাড়তি কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তবে বিভিন্ন পক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেই বিধান বাতিল করা হয়েছে। ফলে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ আর থাকছে না। ২০২৩ সালে মাথাপিছু আয় বাড়লেও মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের বাস্তব ক্রয়ক্ষমতা কমে যায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে। ফলে আবাসনে নতুন চাহিদা তৈরি হয়নি। ২০২৪ সালে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি পেলেও তা বাজারের গতিকে তেমনভাবে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রম অসন্তোষ, বৈদেশিক চাপে রফতানি খাতে ধস এবং আর্থিক বাজারে অনিশ্চয়তার কারণে আবাসন খাত চূড়ান্ত সংকটে পড়েছে। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে— বুকিং বাতিল, কিস্তি বকেয়া, প্রকল্প স্থগিত, ঋণ স্থবিরতা এবং কর্মী ছাঁটাইয়ে। নির্মাণসামগ্রীর দাম গত এক বছরে অন্তত ২০-২৫ শতাংশ বেড়েছে। একইসঙ্গে বেতন বাড়ছে শ্রমিকদের, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জমি ভাড়া সব কিছুতেই খরচ বেড়েছে। অথচ বাজারে বিক্রি কমে যাওয়ায় ডেভেলপারদের লাভ তো দূরের কথা, নিজেদের মূলধনই টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান বাধ্য হচ্ছে নির্মিত ইউনিটগুলো আগের দামে বা তার চেয়েও কমে বিক্রি করতে, শুধু ব্যালান্স শিট বাঁচানোর জন্য। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছে বিশেষ করে নতুন বা মাঝারি পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলো। আবাসন ও নির্মাণ খাতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে ইট, সিমেন্ট, রড, সিরামিক, আসবাব, পাইপ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, পেইন্টস, জানালা-দরজাসহ অন্তত ৫০টির বেশি সহায়ক শিল্প। এখানে জড়িত প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ শ্রমিক, প্রকৌশলী, স্থপতি, কর্মী ও সরবরাহকারী। ডেভেলপাররা আশঙ্কা করছেন, বাজার এমন থাকলে আগামী এক-দুই মাসের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক ও অফিস কর্মী ছাঁটাই শুরু হবে। এই চাপ সরবরাহ চেইনজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে, যা পুরো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনের সময় উৎসে কর হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট উপস্থাপনকালে এই ঘোষণা দেন। এতে দীর্ঘদিনের এক গুরুত্বপূর্ণ দাবি পূরণ হওয়ায় আবাসন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে জমি বা স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের সময় উৎসে কর দিতে হয়, যা অনেক সময় মূলধনি মুনাফার ওপর কর হিসাবেও গণ্য করা হয়। এ করহারে এলাকাভেদে কমানো হয়েছে: ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন: ৮ শতাংশ?৬ শতাংশ। অন্যান্য সিটি করপোরেশন: ৬ শতাংশ?৪ শতাংশ। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়: ৪ শতাংশ?৩শতাংশ। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকায় ১ কোটি টাকার একটি ফ্ল্যাট হস্তান্তরের সময় আগে কর দিতে হতো ৮ লাখ টাকা (৮ শতাংশ)। এখন সেটি কমে দাঁড়াবে ৬ লাখ টাকা (৬ শতাংশ)। অর্থাৎ, একবারের লেনদেনে কর কমবে ২ লাখ টাকা। এতে করে ফ্ল্যাট কেনাবেচার সময় নিবন্ধন খরচ কমে যাবে, যা ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্যই উপকারী।
সরকার বলছে, প্রকৃত বিক্রির দাম অনুযায়ী দলিল রেজিস্ট্রেশনে জনগণকে উৎসাহিত করতেই এই করহারে পরিবর্তন আনা হয়েছে। অতীতে বেশি করের কারণে অনেকে দলিলে কম দাম দেখিয়ে লেনদেন করতেন, যার ফলে সরকার রাজস্ব হারাতো এবং বাজারে স্বচ্ছতা নষ্ট হতো। এছাড়া, রিয়েল এস্টেট খাতকে পুনরুজ্জীবিত করাও এই উদ্যোগের অন্যতম উদ্দেশ্য। বাজেটে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব রাখা হয়েছে- জমি বা ফ্ল্যাট হস্তান্তরের সময় দলিলের মূল্য ছাড়াও যদি অতিরিক্ত অর্থ লেনদেন হয়, তবে তা ব্যাংক বিবরণী বা দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে যাচাই করে মূলধনি আয়ের আওতায় করযোগ্য হবে। এই নতুন নীতিগুলো বাস্তবায়িত হলে একদিকে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আসবে, অপরদিকে নির্মাণ ও আবাসন খাতও চাঙা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, আবাসন ও নির্মাণ খাত এখন এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। এ খাতকে অবহেলা করা মানে শুধু এক খাত নয়, অর্থনীতির বহু স্তম্ভকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেওয়া। অবিলম্বে সমন্বিত নীতিনির্ধারণ, বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে এই খাতের ধস ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।
 

সম্পাদকীয় :

সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : সৈয়দ এম. আলতাফ হোসাইন।

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক : সৈয়দ মোঃ আতিকুল হাসান।

নির্বাহী সম্পাদক আশীষ কুমার সেন।

ফোন : ৪৯৩৫৭৭৩০ (বার্তা), ৮৩১৫৬৪৯ (বাণিজ্যিক), ফ্যাক্স; ৮৮-০২-৮৩১৪১৭৪

অফিস :

প্রকাশক কর্তৃক রোমাক্স লিমিটেড, তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে মুদ্রিত।

সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : খলিল ম্যানশন (৩য়, ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলা), ১৪৯/এ, ডিআইটি এক্সটেনশন এভিনিউ, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত।

ই-মেইল : [email protected], ওয়েবসাইট : www.dainikjanata.net