
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি বা সুপ্রিম কোর্ট বারের ২০২৫-২৬ মেয়াদের নির্বাচন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী গত মার্চে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। মার্চ পেরিয়ে জুনও এখন শেষ হওয়ার পথে। অথচ নির্বাচন আয়োজন নিয়ে নেই দৃশ্যমান কোনো তোড়জোড়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গঠিত বারের অন্তর্বর্তীকালীন কার্যনির্বাহী কমিটিও নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশায়। কমিটির নেতারা নির্বাচন প্রশ্নে যেন ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতিতে চলছেন। এতে দিনদিন বারের আইনজীবীদের মধ্যে অসন্তোষ যেমন বাড়ছে, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তাও আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্ট বারের ২০২৪-২৫ মেয়াদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২৪ সালের মার্চে। সভাপতি, সহ-সভাপতি (দুটি), সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, সহ-সম্পাদক (দুটি) ও সদস্যের সাতটি পদসহ মোট ১৪টি পদে ৬ ও ৭ মার্চ ২ দিনব্যাপী ভোটগ্রহণ হয়। নির্বাচন ঘিরে শুরু থেকেই নানান বাদানুবাদ, হট্টগোল ও মারধরের মতো সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছিল দুদিন পর ৯ মার্চ দিনগত মধ্যরাতে।
ঘোষিত ফলাফলে বিএনপিপন্থি জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের (নীল প্যানেল) প্রার্থী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন সভাপতি এবং আওয়ামী লীগপন্থি বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের (সাদা প্যানেল) প্রার্থী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। নির্বাচনে ১৪ পদের মধ্যে সভাপতি ও তিনটি সদস্যসহ চারটি পদে জয় পায় নীল প্যানেল। সাধারণ সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, সহ-সভাপতি ও সহ-সম্পাদকের চারটি পদসহ বাকি ১০ পদে জয়ী হন সাদা প্যানেলের প্রার্থীরা। তখন জালভোট ও কারচুপিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিলেন নীল প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস। যদিও শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি।
এরপর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে একই বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে সুপ্রিম কোর্ট বারের কার্যনির্বাহী কমিটি হিসেবে সব কার্যক্রম পরিচালনায় গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী কমিটি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ৯ দিন পর ১৮ আগস্ট সমিতির মিলনায়তনে এক তলবি সভায় ১৪ সদস্যের ওই কমিটি ঘোষণা করা হয়। অন্তর্বর্তী কমিটিতে মাহবুব উদ্দিন খোকনকে সভাপতি এবং রুহুল কুদ্দুস কাজলকে সম্পাদক করা হয়। মাহবুব উদ্দিন খোকন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সহ-সভাপতি। রুহুল কুদ্দুস কাজল বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও ফোরামের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব।
অন্তর্বর্তী কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে আছেন, সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির ও সরকার তাহমিনা বেগম, কোষাধ্যক্ষ রেজাউল করিম, সহ-সম্পাদক মাহফুজুর রহমান ও আবদুল করিম এবং সাতজন সদস্য সৈয়দ ফজলে এলাহি, এ বি এম ইব্রাহিম খলিল, ফাতেমা আক্তার, শফিকুল ইসলাম, মো. আশিকুজ্জামান নজরুল, মহি উদ্দিন হানিফ ও রাসেল আহম্মেদ। বারের সাবেক সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম ওইদিন অন্তর্বর্তী কমিটি ঘোষণা করেন। পরে তার সই করা সভার সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে জানানো হয়, বার নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতি ও কারচুপির প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রেফতার আতঙ্ক দেখিয়ে প্রার্থীদের কেন্দ্রে আসা থেকে বিরত রাখা, ভোট গণনার নাটক সাজিয়ে সব প্রার্থীর নিরপেক্ষ নির্বাচন উপকমিটির অনুপস্থিতিতে তথাকথিত ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এ অবস্থায় পূর্বে ঘোষিত ফলাফল বাতিল করে অন্তর্বর্তী কমিটি গঠন করা হলো।
স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি গঠিত হয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের পেশাগত এ সংগঠনটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, প্রতিবছর মার্চের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সে অনুযায়ী গত আগস্টে গঠিত অন্তর্বর্তী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় তিন মাস আগে (গত মার্চ মাসে)। কিন্তু মেয়াদ শেষ হলেও নির্বাচন আয়োজন নিয়ে দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম বা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচন কবে হবে, এ সম্পর্কে অন্তর্বর্তী কমিটির আনুষ্ঠানিক কোনো দিকনির্দেশনাও নেই। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। আইনাঙ্গনে উঠছে প্রশ্ন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের একটি অংশ ক্ষোভ জানিয়ে বলছেন, মার্চ পেরিয়ে জুনও শেষ হওয়ার পথে। কিন্তু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে কোনো সাড়াশব্দ নেই। নির্বাচন কেন দেওয়া হচ্ছে না? নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো বাধা বা সমস্যা দেখছেন না তারা। বর্তমান অন্তর্বর্তী কমিটি নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতায় থাকতে চান কি না, আইনজীবীদের একাংশ এমন প্রশ্নও তুলছেন। তারা বলছেন, আইন, সংবিধান থেকে শুরু করে দেশের বড় বড় সমস্যার যেখানে সমাধান হয় সেই সর্বোচ্চ বিচারাঙ্গনে আইনজীবীদের সংগঠনে নির্বাচন নিয়ে গড়িমসি কেন।
যদিও বারের সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন জানিয়েছেন, খুব শিগগির নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। বারের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহফুজুর রহমান মিলন বলেছেন, এখনো নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়নি। তবে বার সূত্র বলছে, খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ মহসীন রশিদ বলেন, ঢাকা বার (ঢাকা আইনজীবী সমিতি) বিএনপি-জামায়াতপন্থিরা দখল করে আছে। সুপ্রিম কোর্ট বারও দখলে। এগুলো উচিত নয়। সুপ্রিম কোর্ট বারের মতো জায়গায় নির্বাচনের জন্য দাবি জানাতে হবে কেন? এখানে তো অটোমেটিকেলি সময়মতো নির্বাচন হওয়া উচিত। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ তো এখন প্যানেলও দিতে পারবে না, নির্বাচনে আসতেও পারবে না। কারণ, তারা অতীতে নির্বাচন নিয়ে খারাপ উদাহরণ তৈরি করেছেন। অতীতে যারা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করেছেন তারাই যদি এখন নির্বাচন ছাড়া সমিতি চালাতে চান, তাহলে কী আর বলার থাকে?
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইয়ারুল ইসলাম বলেন, চলতি মেয়াদে নির্বাচন না হওয়ায় বর্তমান কমিটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মেয়াদ কতদিন বাড়ানো হয়েছে সেটি বারের অন্য আইনজীবীরা জানেন না। সাধারণ সভা করে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে নাকি অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় সেটিও অজানা। অন্তর্বর্তী কমিটিকে তো অনন্তকালের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। কমিটির উচিত ছিল মার্চের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা।
আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বারকে বহু আগেই রাজনৈতিক দলীয়করণে নিমজ্জিত করা হয়েছে। অতীতেও ক্ষমতাসীন দলগুলোকে খুশি রাখতে বারকে ব্যবহার করা হয়েছে। বারকে সঠিক ধারায় ফেরাতে সংস্কারের বিকল্প নেই। এজন্য আন্দোলন ও দাবি আদায়ের এখনই মোক্ষম সময়। অথচ বারের আইনজীবীরা নীরব। নির্বাচন ও সংস্কার একে অন্যের পরিপূরক। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন করলে কোনো লাভ হবে না। তাই নির্বাচনের আগে দরকার বার সংস্কার।
বর্তমান অন্তর্বর্তী কমিটির সাধারণ সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব আসবে এটিই স্বতঃসিদ্ধ এবং হওয়া উচিত। অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সাধারণ আইনজীবীদের মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী কমিটি গঠন করা হয়েছে। আইনজীবীদের আস্থা ও শ্রদ্ধার প্রতি সম্মান রেখে আমি বলতে চাই, আমাকে সাধারণ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হলেও আমি দায়িত্ব পালন করছি না। আমি যেহেতু পর পর তিনবার নির্বাচিত সম্পাদক ছিলাম, কাজেই অনির্বাচিত পদে দায়িত্ব পালন করতে বিব্রত বোধ করেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে একাধিকবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বর্তমান কমিটিকে বলেছি। কমিটির সদস্যদের লিখিতভাবে এ-ও জানিয়েছি যে, নির্বাচন না হওয়ায় আইনজীবীরা নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি বলেন, এখন আর নির্বাচন প্রলম্বিত করার কোনো সুযোগ নেই। অবিলম্বে তফসিল ঘোষণা করার জন্য অনুরোধ করেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে আপিল বিভাগে বসে সভাপতিকে (মাহবুব উদ্দিন খোকন) বলেছি, উনি যেন সভাপতি হিসেবে উনার নিজ দায়িত্বে নির্বাচন আয়োজন করেন। কমিটিতে থাকা কেউ কেউ পদ হারানোর ভয়ে নির্বাচন দিতে গড়িমসি করতে পারেন বলেও ধারণা সম্পাদকের।
নির্বাচন বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী কমিটির সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আমি গণতন্ত্র ও নির্বাচনে বিশ্বাসী। আমিও মনে করি, নির্বাচনের ব্যবস্থা করা উচিত। বার বার বলা হচ্ছে এজিএম (সাধারণ সভা) ডাকার জন্য। আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ১৫ বছর আন্দোলন করেছি। তাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বন্ধ করা যাবে না। এটি (নির্বাচন) অব্যাহত রাখতে হবে। আমাকে তো আইনজীবীরা সব পদেই বসিয়েছেন। আমি এখানে ১০ বার নির্বাচিত। দুবার সদস্য, সাতবার সম্পাদক ও সবশেষ সভাপতি। আমার তো পরাজয়ের কোনো ইতিহাস নেই। আমার কোনোরকম ডিমান্ড বা লোভও নেই। তিনি বলেন, যারা এসব পদে বসতে পারেননি বা নির্বাচিত হতে পারিনি তাদের হয়তো লোভ থাকতে পারে, অন্য কোনো চিন্তা থাকতে পারে। তবে আমি মনে করি, নির্বাচন যত তাড়াতাড়ি হবে গণতান্ত্রিক প্রসেস ততো শক্তিশালী হবে। নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব সেক্রেটারির। এখানে সভাপতি নামমাত্র ব্যক্তি। আমি মনে করি তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তারাও নির্বাচন চান। তারা যে চান না সেটা আমি বলবো না। এরমধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়েছে চলতি মেয়াদের বাকি সময়ের জন্য নির্বাচনের দিন ঠিক করার জন্য।