প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে বরাদ্দ কমছে বাজেটে

আপলোড সময় : ২০-০৬-২০২৫ ০৩:১৯:১০ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ২০-০৬-২০২৫ ০৩:১৯:১০ অপরাহ্ন
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও ঘনঘনতা বাড়ছে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও খরায় বিপর্যস্ত হচ্ছে ঘরবাড়ি, কৃষি এবং মানুষের জীবন-জীবিকা। অথচ দুর্যোগ মোকাবিলায় জাতীয় বাজেটে প্রত্যাশিত হারে বরাদ্দ বাড়েনি। বরং আগামী অর্থবছর বরাদ্দ কমছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু অর্থায়নে সরকার জিডিপির ১ শতাংশেরও কম বরাদ্দ দিচ্ছে, যেখানে প্রয়োজন অন্তত ৩ শতাংশ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জলবায়ু সম্পর্কিত ২৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ২০৮ কোটি টাকা, যা জিডিপির মাত্র ০.৬৭ শতাংশ। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৪২ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে বরাদ্দ কমছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা।
বিগত কয়েক বছরে জলবায়ু বাজেট ধীরে ধীরে বাড়লেও তা যথেষ্ট নয়। জাতীয় বাজেটে টেকসই উন্নয়ন জলবায়ু অর্থায়ন বাজেট প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে জলবায়ু খাতে বরাদ্দ ছিল ২৪ হাজার ২৭৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, যা জিডিপির শূন্য দশমিক ৬৮ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২৮ হাজার ১০ কোটি টাকা (জিডিপির শূন্য দশমিক ৭১ শতাংশ)। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ হয় ৩২ হাজার ৪৮ কোটি টাকা (জিডিপির শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ) এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছর দেওয়া হয় ৩৭ হাজার ৫১ কোটি টাকা (জিডিপির শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ)। অথচ বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (বিসিসিএসএপি ২০০৯) অনুযায়ী, অভিযোজন খাতে বছরে বরাদ্দের প্রয়োজন ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রয়োজন ৩৮ বিলিয়ন ডলার এবং জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় (ন্যাপ) বছরে বরাদ্দ লাগবে ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।

জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় গৃহীত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পদক্ষেপ বাস্তবায়নে যে বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজন, বার্ষিক বাজেটে তার কোনো প্রতিফলন নেই। বাজেট তো বাড়েইনি উল্টো হ্রাস পেয়েছে। তারা বলছেন, জলবায়ু খাতের জন্য বাজেট বরাদ্দ পরিকল্পিত এবং পর্যাপ্ত নয়। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পর্যাপ্ত জলবায়ু অর্থ বরাদ্দের দাবি করা হলেও বরাদ্দ বাড়ছে না।
উপকূল নিয়ে কাজ করা সংগঠন কোস্ট ফাউন্ডেশনের জলবায়ু পরিবর্তন বিভাগের প্রধান এম এ হাসান বলেন, টেকসই জলবায়ু-সহনশীল বাংলাদেশ গড়তে একদিকে দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা, অপরদিকে মানুষের জীবন-জীবিকা সুরক্ষায় অগ্রাধিকারভিত্তিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রতিবছর জিডিপির আকার বাড়লেও জাতীয় বাজেটে জলবায়ু খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলা এবং পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে অভিযোজন সক্ষমতা অর্জনসহ দেশের বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পরিকল্পনার বিনিয়োগ চাহিদা অনুসারে জাতীয় বাজেটে জিডিপির কমপক্ষে ৩ শতাংশ (১ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা) জলবায়ু অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
কোস্ট ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, দেশের ৩২ শতাংশ এলাকা উপকূলীয়, যেখানে বাস করেন প্রায় ৩ কোটি ৯ লাখ মানুষ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৫ মিটার উঁচু এই ভূমিগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বিপন্ন। পর্যাপ্ত উপকূলীয় সুরক্ষা অবকাঠামোর অভাবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট দুর্যোগে বাংলাদেশের উপকূল দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে, ক্ষয়-ক্ষতির মাত্রা বাড়াচ্ছে। ২০২৪ সালে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুরের লাখ লাখ মানুষ।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত অক্সফাম বাংলাদেশের প্রতিবেদন বলছে, আকস্মিক এ বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনী ও নোয়াখালী জেলা। দুই জেলার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ বন্যায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর।
২০২৪ সালের ২০ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এই বন্যায় ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দেশের ১১ জেলার বিশাল অংশ পানির নিচে তলিয়ে যায়। বাস্তুচ্যুত হয় পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ। এই বন্যায় প্রায় ৫৮ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অবকাঠামো, বাড়িঘর, কৃষি ও মৎস্য খাত।
বাংলাদেশের উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি বেড়েছে। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রিমালে উপকূলীয় এলাকার ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩৫ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে, আর আংশিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার ঘরবাড়ি। এছাড়া রিমালের প্রভাবে ১৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ২০ জেলায় ৬ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের দেশীয় জলবায়ু ও উন্নয়ন প্রতিবেদন (সিসিডিআর) বলছে, শুধু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাংলাদেশের গড় বার্ষিক ক্ষতি ১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে (জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ), যা আগামীতে আরও বাড়বে। প্রতিবেদনটি আরও বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেতে পারে। জলবায়ু সম্পর্কিত সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশে প্রতি বছর ১২ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন হতে পারে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য মতে, জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন বলছে, উপকূলের প্রায় ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি লবণাক্ততার সংকটে রয়েছে। কার্যকর উদ্যোগ নিতে না পারলে কৃষি আয় বার্ষিক ২১ শতাংশ হ্রাস পাবে। উপকূলের ৪০ শতাংশই কৃষিজমি।
এক বছরের ব্যবধানে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ছয় লাখ। ইন্টার্নাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে দুর্যোগজনিত বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা চতুর্থ বছরের মতো বেড়ে ২৪ লাখে পৌঁছেছে, যা দেশের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ। এর আগে দেশে সর্বোচ্চ বাস্তুচ্যুতি ঘটেছিল ২০১৯ সালের বর্ষার বন্যা এবং ২০২০ সালের বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আম্পানের যৌথ প্রভাবে। দুর্যোগে বাস্তুচ্যুতির বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। আইডিএমসির গবেষণা অনুযায়ী, ২০৫০ সালে বাংলাদেশে প্রতি সাতজনের একজন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, প্রতি বছর চার লাখ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছে।
জাতীয় বাজেটে জিডিপির ন্যূনতম ৩ শতাংশ জলবায়ুতে বরাদ্দের দাবি জানিয়েছে কোস্ট ফাউন্ডেশন। এবারের বাজেট পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটি জানিয়েছে, প্রস্তাবিত জলবায়ু বরাদ্দ সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য, অপর্যাপ্ত এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ায় বাধা সৃষ্টি করবে। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাসঙ্গিকতা এবং চলমান জলবায়ু ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে, নিজস্ব সম্পদের ওপর ভিত্তি করে গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া উচিত এবং জাতীয় বাজেটে জলবায়ু অর্থায়নের জন্য জিডিপির ন্যূনতম ৩ শতাংশ বরাদ্দ পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান বলেন, আমাদের দেশে সবসময় রিসোর্সের অভাব। আমাদের সম্পদের অভাব। সে অনুযায়ী বাজেটও কম। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু যতটুকু বরাদ্দ হয় সেটার কি যথাযথ ব্যবহার হয়? যতটুকু বাজেট হয় সেটা স্বচ্ছ কি না? জবাবদিহিতার আওতায় আছে কি না? বাজেট অন্তর্ভুক্তিমূলক জায়গায় ব্যয় হয় কি না, এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। যে দুর্যোগের শিকার, যার জন্য বাজেট, সে কি এই বাজেটের অংশ? তার জন্য যে উন্নয়ন দরকার সেই বাজেট কি হয়? এটা বোঝা দরকার। এই প্রশ্নগুলোর উত্তরেই আছে সমাধান। মনিরুজ্জামান খান বলেন, যারা দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ তাদের প্রাক-বাজেট আলোচনায় রাখা হয় না। যারা দুর্যোগের স্বীকার, তাদের মতামত নেওয়া হয় না, যে তারা আসলে কোন কোন খাতে বরাদ্দ আর উন্নয়ন চায়। আমাদের সমস্যা এখানেই। দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের মানুষের প্রয়োজনীয়তা বোঝে না, মানুষ কি চায় সেটার গবেষণা নেই। বরাদ্দ আর অগ্রাধিকারের জায়গা দেখতে হবে। যতটুকু বরাদ্দ তার যথাযথ ব্যবহার করতে হবে।
 

সম্পাদকীয় :

সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : সৈয়দ এম. আলতাফ হোসাইন।

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক : সৈয়দ মোঃ আতিকুল হাসান।

নির্বাহী সম্পাদক আশীষ কুমার সেন।

ফোন : ৪৯৩৫৭৭৩০ (বার্তা), ৮৩১৫৬৪৯ (বাণিজ্যিক), ফ্যাক্স; ৮৮-০২-৮৩১৪১৭৪

অফিস :

প্রকাশক কর্তৃক রোমাক্স লিমিটেড, তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে মুদ্রিত।

সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : খলিল ম্যানশন (৩য়, ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলা), ১৪৯/এ, ডিআইটি এক্সটেনশন এভিনিউ, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত।

ই-মেইল : [email protected], ওয়েবসাইট : www.dainikjanata.net