
* যত্রতত্র রাখা হচ্ছে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার
* গ্যাস দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সর্তক বার্তা তিতাসের
* লিকেজ পরীক্ষা করতে গ্যাস ডিকেকটর ব্যবহার করতে হবে
গ্যাসজনিত অগ্নি দুর্ঘটনা বা বিস্ফোরণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ওসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও আহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এতে ব্যাপকভাবে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি অগ্নিদুগ্ধ আহতরা পার করছে দুর্বিষহ জীবন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিষফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে গত ২০২৪ সালে ৭০৪টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে ঘটে ৪৪টি দুর্ঘটনা। তাছাড়া গ্যাস সরবরাহের লাইন লিকেজ থেকে ৪৬৫টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বড় বড় দোকানে যত্রতত্র রাখা হয় এলপি গ্যাস সিলিন্ডার। যদিও সঠিকভাবে রাখা হলে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায় একটি গ্যাস সিলিন্ডার। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। তাছাড়া প্রতি ১০ বছর পর বিস্ফোরক অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে সিলিন্ডার পরীক্ষা করার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই গ্যাসজনিত অগ্নি দুর্ঘটনা বা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। এতে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এই দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সতর্কবার্তা দিয়েছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। শনিবার তিতাস গ?্যাসের ব?্যবস্থাপক (মিডিয়া ও জনসংযোগ) মো. আল আমিন স্বাক্ষরিত এক বার্তায় এই সতর্কতার কথা জানানো হয়। এতে বলা হয়, গ্যাসের চুলা জ্বালানোর কমপক্ষে ২০ মিনিট আগে রান্না ঘরের দরজা-জানালা খুলে দিয়ে বায়ু চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। চুলার নব, বাটন, হুসপাইপ ও পিতলের চাবিতে কোনো গ্যাস লিকেজ আছে কিনা পরীক্ষা করতে হবে। লিকেজ হলে রাইজারের চাবি বন্ধ করতে হবে এবং প্রয়োজনে দক্ষ মিস্ত্রি দিয়ে লিকেজ মেরামত করতে হবে। বার্তায় আরও বলা হয়, গ্যাসের লিকেজ বা গ্যাসের গন্ধ পেলে এই নম্বরসমূহে ০১৯৫৫-৫০০৪৯৭-৫০০ ও কল সেন্টার ১৬৪৯৬ এ যোগাযোগ করা যাবে। একইসঙ্গে গ্যাস ব্যবহারে সচেতন হওয়া এবং দুর্ঘটনার হাত থেকে নিরাপদ থাকতে বার্তায় উল্লেখ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে আবাসিকের লাইনের গ্যাস কিংবা সিলিন্ডারের লিকেজ থেকে অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনা। ঢাকা ও তার আশপাশে এসব দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। তবে গ্যাসের লিকেজ থেকে অগ্নি-দুর্ঘটনা বাড়লেও সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা কম। কারণ সিলিন্ডারের ধারণক্ষমতা অনেক বেশি। মূলত বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে অবৈধ গ্যাসের লাইনের কারণে। দেশের গ্যাস লাইনগুলো দীর্ঘদিনের পুরনো। ফলে দেশে বেশ কয়েকবার সংঘটিত ভূমিকম্পে মাটির নিচের ওসব গ্যাসের পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে লিকেজ হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত না। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগে সাধারণত লিকেজ বেশি হয়। তাছাড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ রান্নাঘরে ভেন্টিলেশন। কোনো স্থানে দীর্ঘ সময় বাতাস চলাচলের পথ বন্ধ থাকলে এবং সেখানে কোনো গ্যাস লিকেজ থাকলে তা তখন জমাটবদ্ধ গ্যাসে পরিণত হয়। তখন যেকোনো স্পার্ক বা ম্যাচের কাঠি জ্বালালেই তা বিস্ফোরকে পরিণত হয়। তবে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ সহজেই হয় না। কারণ সিলিন্ডারের একটি মেয়াদ থাকে, যা এর গায়ে লেখা থাকে। মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও বিস্ফোরক অধিদফতর সিলিন্ডার পরীক্ষা করতে পারে। ওই পরীক্ষার মাধ্যমে সিলিন্ডারের মান যাচাই করা যায়। প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছর পর সিলিন্ডার পরীক্ষা করা প্রয়োজন। তাছাড়া সিলিন্ডারের হোসপাইপ, রেগুলেটর, বাল্বের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। সেগুলোর মান পরীক্ষাও করা প্রয়োজন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানের এবং কমদামি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান, আগুন জ্বালিয়ে গ্যাসের লিকেজ পরীক্ষা করা ঠিক না। বরং কোনো স্থানে সন্দেহ হলে সাবান পানি দিয়ে পরীক্ষা করে এতে বুদবুদ হচ্ছে কি না দেখা যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে নির্ধারিত স্থানে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায়। গ্যাস লিকেজ হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করতে গ্যাস ডিকেকটর ব্যবহার করা যেতে পারে। রান্নাঘরের ভেন্টিলেশন ঠিক রাখতে হবে।
সর্বশেষ চলতি মাসের ১১ জুন রাত ৯টায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের হিরনাল এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে একটি বসতবাড়ি সম্পূর্ণভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও সৌভাগ্যক্রমে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
স্থানীয়রা জানান, হিরনাল ফকিরবাড়ি এলাকার বাসিন্দা হালিম ফকিরের বাড়ি থেকে হঠাৎ বিকট শব্দে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের তীব্র শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বিস্ফোরণের পরপরই ওই বাড়িতে আগুন ধরে যায় এবং মুহূর্তের মধ্যেই আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার সময় বাড়ির কেউ উপস্থিত ছিলেন না। ঈদুল আযহার ছুটিতে হালিম ফকির ও তার পরিবারের সদস্যরা আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন, ফলে তারা অগ্নিকাণ্ডের কবল থেকে রক্ষা পান।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলেন, যদি পরিবারের কেউ বাড়িতে থাকত, তাহলে বড় ধরনের প্রাণহানির আশঙ্কা ছিল। আল্লাহর রহমতে সবাই বাইরে থাকায় দুঃখজনক ঘটনা হলেও প্রাণহানির মতো ভয়াবহতা ঘটেনি। বিস্ফোরণের পর স্থানীয়রা পানি ও বালতি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন, তবে ততক্ষণে বাড়ির ভেতরের সমস্ত আসবাবপত্র, মূল্যবান সামগ্রী এবং গৃহস্থালি জিনিসপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ধরনের ঘটনা আবারও প্রমাণ করে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে সতর্কতা ও নিয়মিত তদারকি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় প্রশাসন এবং ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ জনগণকে গ্যাস সিলিন্ডার সংযোগ ব্যবহারে নিয়ম মেনে চলার এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
গত ২২ মে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে একটি ভাড়া বাসায় রান্না করার সময় গ্যাসে লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে দগ্ধ হয়েছেন চারজন। এদের মধ্যে আফ্রিদীর শরীরের ৮ শতাংশ, আতিকের ৫ শতাংশ, কামরুলের ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সোহাগের ১ দশমিক ৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তারা সবাই স্থানীয় একটি কারখানায় শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত।
স্থানীয়দের বরাতে ওই কারখানার পরিচালক হিমেল খান জানান, ওই এলাকায় শ্রমিকরা একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। বৃহস্পতিবার ভোরে রান্না করার সময় গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে চারজন শ্রমিক দগ্ধ হন। তাদের ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। আহতের সবাই শঙ্কামুক্ত বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। আমরা নিয়মিত তাদের খোঁজ খবর রাখছি।
গত ২০ মে রাজধানীর আফতাবনগরের দক্ষিণ আনন্দনগর এলাকায় গ্যাস লিকেজ থেকে ঘটে যাওয়া আগুনের ঘটনায় একই পরিবারের পাঁচ সদস্য দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে বুধবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তোফাজ্জল হোসেন (৩৫)। আগের দিন তার স্ত্রী মানসুরা ও চার বছর বয়সী মেয়ে তানজিলা আগুনে দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। গত ২৮ এপ্রিল গাজীপুরের বাসন থানা এলাকায় রান্নার সময় গ্যাস লিকেজ থেকে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়। ওইদিন সন্ধ্যা সাতটায় বাসন থানার মোগরখাল এলাকায় একটি বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শিশুসহ পাঁচজন দগ্ধ হন। তাদের উদ্ধার করে ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। একইভাবে সারাদেশে গ্যাসজনিত লিকেজ থেকে আগুনের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে এবং দগ্ধ হয়ে দুর্বিসহ কাটছে জীবন।