চোরাই চিনিতে সয়লাব বাজার

আপলোড সময় : ২০-০৫-২০২৪ ১০:২১:৩৯ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ২০-০৫-২০২৪ ১০:২১:৩৯ পূর্বাহ্ন
দেশে চিনিকল মালিকদের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির সুযোগে বাজার দখল করে নিয়েছে ভারতীয় চোরাই চিনি। বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে দেশি চিনির দর প্রতি কেজি ১৩০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও মাত্র ৫৬ টাকাতেই মিলছে ভারতীয় চিনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভারতের খুচরা বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি চিনির দাম কমবেশি ৪০ রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৬ টাকা। একই চিনি বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। দুই দেশে দামের এমন পার্থক্যের কারণে সীমান্ত দিয়ে প্রচুর ভারতীয় চিনি ঢুকছে বাংলাদেশে। সেই চিনি রাতারাতি মোড়ক বদলে দ্বিগুণের বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। ভারতীয় চিনিতে বাজার সয়লাব হওয়ার পেছনে দেশের চিনির মিল মালিকদের অস্বাভাবিক মুনাফা করার প্রবণতাকে পরোক্ষভাবে দায়ী বলে মনে করেন খুচরা ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ। তারা বলছেন, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দফায় দফায় দাম নির্ধারণ করেও সেই দামে চিনি বিক্রি করেনি। এই অবস্থায় সীমান্তে শিথিলতার সুযোগে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় চিনি নিয়ে আসছে চোরাকারবারিরা। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে বিক্রি হওয়া ৬০ শতাংশ চিনিই ভারতের। গত ৪ মে নারায়ণগঞ্জের তারাব পৌরসভা থেকে ৬২৪ বস্তা ভারতীয় চিনি জব্দ করেছেন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। উদ্ধার করা এসব চিনির ১৪৪ বস্তা ছিল মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ব্র্যান্ডের মোড়কে। বাকি ৪৮০ বস্তা ছিল ভারতীয় ব্র্যান্ডের মোড়কে। এরপর ১৩ মে রাতে শেরপুরের নালিতাবাড়ী থেকে উদ্ধার করা হয় আরও ১ হাজার ২৯২ বস্তা ভারতীয় চিনি। এভাবে দু-একদিন পরপর সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে ভারতীয় চোরাই চিনি।
চট্টগ্রামে পুলিশ এবং র‌্যাবের পৃথক দুটি অভিযানে অন্তত এক হাজার মেট্রিক টন ভারতীয় চিনি জব্দ করা হয়। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে আসে ভারতীয় চিনি পাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাদের দাবি, মেহেরপুর-ঝিনাইদহ এবং কুমিল্লা-আখাউড়াসহ সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন ৫ হাজার মেট্রিক টনের বেশি চিনি বাংলাদেশ ঢুকছে। চোরাকারবারিদের আনা ভারতীয় চিনি দেশীয় ব্র্যান্ডের মোড়কে বাজার দখলে নেওয়ায় ব্যবসা হারাচ্ছেন ভোগ্যপণ্যের প্রকৃত ব্যবসায়ীরা। চিনির আমদানিকারক ও পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। শুধু তা-ই নয়, চিনির আমদানিও কমিয়ে দিয়েছে তারা। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২২ লাখ মেট্রিক টন চিনির চাহিদা রয়েছে। দেশের প্রতিষ্ঠিত ৬ থেকে ৮টি প্রতিষ্ঠান আমদানি করা কাঁচামাল পরিশোধন করে চিনি বাজারজাত করছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি সময়ে দেশে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছিল ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৮৬৫ টন। অথচ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয় ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭৯৯ টন। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের উল্লিখিত ৩ মাসে ১ লাখ ৫২ হাজার ৬৫ টন কম আমদানি হয়। ব্যবসায়ীরা আমদানি কমিয়ে দেওয়ায় আরও সুযোগ পেয়েছে চোরাকারবারিরা। সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে আনা চিনিতে বাজারের ঘাটতি মেটাচ্ছে তারা। জানা গেছে, চোরাইপথে চিনির বড় একটি অংশ আসছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরসহ সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে। পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের চিনি ব্যবসায়ী শাহনেওয়াজ বলেন, ‘ভারতীয় চোরাই চিনির কারণে আমাদের ব্যবসা ৮০ শতাংশ কমে গেছে।’
এ বাজারের খুচরা চিনি ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, বাজারে বিক্রি হওয়া চিনি সিটি, মেঘনা ও ঈগলু কোম্পানির ব্যাগে বিক্রি হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রামপুরা বাজারের একজন মুদি ব্যবসায়ী গত শনিবার বলেন, চিনি চোরাইপথে আনলেও তা বোঝার উপায় নেই। কারণ ভারত থেকে আনা চিনি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের বস্তায় আমাদের কিনতে হয়। তখন কোনটা চোরাই তা বুঝার উপায় নেই। মোল্লাবাড়ি বাজারের আরেক বিক্রেতা  বলেন, চিনি যেটা চোরাই সেটা পাইকারি দোকান থেকে আমরা খুচরা দোকানদাররা কম দামে কিনে থাকি। যদিও খুচরা বিক্রেতারা অনেকেই কম দামে কিনলেও তা চড়া লাভেই বাজার দরে বিক্রি করেন।
মেরাদিয়া বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী ‘বেপারী সুগার এন্টারপ্রাইজ’-এর স্বত্বাধিকারী খালেক বেপারী গণমাধ্যমকে বলেন, কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ কেমনে বুঝবো। সবই তো আমাদের কাছে আসে বাংলাদেশের বড় বড় কোম্পানির প্যাকেটে। ফ্রেশ, ঈগলু, দেশবন্ধু, এস আলমসহ বড় বড় কোম্পানির প্যাকেটে বাজারজাত করা হয়। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের মেসার্স সবুজ কমার্শিয়ালের মালিক মুহাম্মদ শাহেদ উল আলম বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য এই বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এরা চোরাইপথে চিনি এনে আবার বড় বড় ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে থাকে। এদের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নেয়া হলেও তাদের সংখ্যা অনেক। সম্প্রতি বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা কামাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দেয়া এক চিঠিতে চোরাই পথে ভারতীয় চিনি আসা বন্ধের আবেদন জানিয়েছেন। চিঠিতে সারা দেশে তৎপর ৩৬ জন চোরাকারবারির তালিকাও দিয়েছেন তিনি। তালিকায় যাদের চিনির চোরাকারবারি বলে দাবি করা হয়েছে তারা হলেন- ভৈরবের হাজি চান মিয়া ও রশিদ সরকার, বেলকুচির বাংলাদেশ বেকারি, উল্লাপাড়ার শহিদুল্লাহ, সিরাজগঞ্জের পদ্মারমুড়ের শেখ এন্টারপ্রাইজ ও ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ, গৌরীপুরের আব্দুর রশিদ অ্যান্ড সন্স, রামগঞ্জের আবুল বাশার স্টোর, মাধবপুরের বেনু রায়, শেরপুরের চান মিয়া ও বিলু চৌধুরী, নেত্রকোনার দিলীপ ঘোষ, জয়পুরহাটের ফারুক ট্রেডার্স, ভরত প্রসাদ, ঠাকুরগাঁওয়ের রাধা মাধব অয়েল মিল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সামাদ অ্যান্ড সন্স ও ভাই ভাই ট্রেডার্স, কুমিল্লার মোহনার সেলিম স্টোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জাহাঙ্গীর স্টোর ও বিজয় পাল, চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর ফারুক ব্রাদার্স, নবী স্টোর ও ইউনুছ, চট্টগ্রামের রাশেদ (ব্রোকার), ফেনীর ইসমাঈল ব্রাদার্স, বগুড়ার আনন্দকুণ্ড ও ভাই ভাই ট্রেডার্স, কাহালুর আরিফ স্টোর, বেলকুচির ভজন কুমার পাল, রংপুরের বণিক ব্রাদার্স, ময়মনসিংহের বিমল পাল, মৌলভীবাজারের মদনমোহন ভাণ্ডার, সিলেটের বিনীত রায়, আরতি এন্টারপ্রাইজ, হক ব্রাদার্স ও সাদ্দাম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও দেশবন্ধু গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদনের পরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। আরও অবনতি হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টরা চিনি চোরাচালান বন্ধে কাজ করছেন। তাদের আবেদনের পরে অনেক জায়গায় ভারতীয় চিনি ধরা হচ্ছে। বর্ডারেও অনেক ধরা হয়েছে। পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। আমরা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।
 

সম্পাদকীয় :

সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : সৈয়দ এম. আলতাফ হোসাইন।

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক : সৈয়দ মোঃ আতিকুল হাসান।

নির্বাহী সম্পাদক আশীষ কুমার সেন।

ফোন : ৪৯৩৫৭৭৩০ (বার্তা), ৮৩১৫৬৪৯ (বাণিজ্যিক), ফ্যাক্স; ৮৮-০২-৮৩১৪১৭৪

অফিস :

প্রকাশক কর্তৃক রোমাক্স লিমিটেড, তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে মুদ্রিত।

সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : খলিল ম্যানশন (৩য়, ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলা), ১৪৯/এ, ডিআইটি এক্সটেনশন এভিনিউ, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত।

ই-মেইল : [email protected], ওয়েবসাইট : www.dainikjanata.net