
কোস্টগার্ডের আধুনিকায়নে সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.)। তিনি বলেন, সে জন্যই বোট ওয়ার্কশপ ও স্লিপওয়ে স্থাপন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারও সংযোজন করার পরিকল্পনা রয়েছে। গতকাল শনিবার দুপুরে বাগেরহাটের মোংলায় বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের পশ্চিম জোনের অপারেশনাল কার্যক্রম পরিদর্শন এবং নবনির্মিত বোট ওয়ার্কশপ ও স্লিপওয়ের উদ্বোধন শেষে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, কোস্টগার্ডের সদস্যদের প্রত্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় নানা ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে হয়। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনে আধুনিক সুবিধা সম্বলিত ও প্রযুক্তি নির্ভর বোট ওয়ার্কশপ উদ্বোধন করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই সংযোজনের মাধ্যমে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশনাল সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। নবনির্মিত বোট ওয়ার্কশপ কোস্টগার্ডের পাশাপাশি মোংলা বন্দর, নৌবাহিনী, বিজিবি, নৌ পুলিশ এবং বনবিভাগের বোটগুলোতে মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে এই অঞ্চলে একটি প্রযুক্তি নির্ভর ‘মেরামতের হাব’ হিসেবে অবদান রাখবে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেন, কোস্টগার্ডকে একটি যুগোপযোগী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে নৌ বহরে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত ইনশোর পেট্রোল ভেসেল, ফ্লোটিং ক্রেন এবং টাগ বোট সংযুক্ত করা হয়েছে। কোস্টগার্ডের আধুনিকায়নে বুলেট প্রুফ হাই স্পিড বোট, সারভাইল্যান্স ড্রোন, দ্রুতগামী জাহাজ ও বোটের সংযুক্তির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যা পশ্চিম জোনেও অন্তর্ভুক্ত হবে। তিনি বলেন, কোস্টগার্ডকে প্রযুক্তিনির্ভর বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভবিষ্যতে অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারও সংযোজন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশের জলসীমায় সার্বভৌমত্ব এবং উপকূলীয় এলাকার নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশ কোস্টগার্ড ভবিষ্যতে অধিকতর কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, অতি সম্প্রতি কোস্টগার্ড গোপনে দেশের অভ্যন্তরে পুশ-ইন করা ৭৫ জন বাংলাদেশিকে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উদ্ধার করেছে এবং পুশ-ইন প্রতিরোধে সর্বদা তৎপর রয়েছে। তিনি বলেন, কোস্টগার্ড সদস্যরা চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সমুদ্রে অবস্থানরত থেকে জাহাজে ফ্ল্যাগ মিটিংয়ের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে জেলেদের বিনিময় কাজ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন যা তাদের পেশাদারত্বেরই প্রমাণ বহন করে। এ সময় গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দেশের আইনশৃঙ্খলা এবং জননিরাপত্তা রক্ষায় সদা জাগ্রত থেকে কার্যকরী ভূমিকা পালনের জন্য কোস্টগার্ড সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। সুন্দরবনে জলদস্যুদের নতুন করে উৎপাত প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, জলদস্যুর উৎপাত বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে কোনও সন্ত্রাসী কার্যক্রম ঘটতে দেওয়া হবে না। জলদস্যু বা বনদস্যু যে ধরনের দস্যুই থাকুক না কেন- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (জনসংযোগ) ফয়সল হাসান জানান, অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, কোস্টগার্ডকে শক্তিশালী করার জন্য খুব তাড়াতাড়ি আরও ৫টি বড় ধরনের বোট কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। যা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। তাছাড়া প্রয়োজন সাপেক্ষে অদূর ভবিষ্যতে কোস্টগার্ডের জন্য হেলিকপ্টার ক্রয় করা হবে।
ভারতের মতো পুশ ইন নয়, কূটনৈতিক সমাধানে বিশ্বাসী: বাংলাদেশ কাউকে ভারতের মতো পুশ ইন করে না, কূটনৈতিক সমাধানে বিশ্বাসী বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.)। গতকাল শনিবার সকালে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার রায়মঙ্গল নদী ও বয়েসিং খালের সংযোগস্থলে সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতে ‘বয়েসিং ভাসমান বিওপি’র উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের কাছে তিনি এ মন্তব্য করেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পুশ ইন সমস্যা প্রতিরোধে বাংলাদেশ কূটনৈতিক সমাধানে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ সবসময় আন্তর্জাতিক আইন ও প্রটোকল অনুসরণ করে আসছে। আমরা ইতোমধ্যে এ সমস্যা সমাধানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতকে চিঠি লিখেছি। আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান এ সমস্যার সমাধানে কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। তিনি বলেন, আমরা ভারতকে জানিয়েছি, বাংলাদেশি কেউ যদি অবৈধভাবে ভারতে থেকে থাকে, তবে তারা যেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঠায়। আর বাংলাদেশে যদি অবৈধ ভারতীয় নাগরিক থেকে থাকে, তাদেরকে আমরা যথাযথ চ্যানেলের মাধ্যমে ভারতে ফেরত পাঠাবো। সেজন্য ভারতীয় পক্ষকে বলা হয়েছে, তারাও যেন পুশ ইন না করে যথাযথ চ্যানেলে ফেরত পাঠায়। তিনি বলেন, গত শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তে ভারত পুশ-ইনের চেষ্টা করেছে। যা বিজিবি, আনসার এবং স্থানীয় জনগণের সহায়তায় প্রতিহত করা হয়েছে। তিনি বলেন, সীমান্ত এলাকায় সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে ও সহযোগিতা করলে ভারত পুশ ইন করতে পারবে না। লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেন, ভারত গুজরাটে অবস্থিত একটি বাঙালি বস্তি ভেঙে দিয়েছে। সেখানে আমাদের দেশেরও কিছু রোহিঙ্গা গিয়েছিল। ওই বস্তি ভেঙে দেওয়ার পরই মূলত পুশ-ইন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে পুশ-ইন করা ব্যক্তিদের মধ্যে ইউএনএইচসিআর এর কার্ডধারী কিছু রোহিঙ্গাও রয়েছে। আবার যারা ভারতীয় রোহিঙ্গা তাদেরও পুশ ইন করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেজন্য আমরা একটা প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ভারত যেহেতু ৩৭০ জনকে পুশ ইন করেছে, বাংলাদেশেরও একইভাবে পুশ ব্যাক করার ইচ্ছা আছে কিনা, এ সংক্রান্ত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, তারা যদি আমার দেশের দেশের নাগরিক হয়, তাহলে তো পুশব্যাক করার অধিকার আমাদের নাই। তিনি বলেন, আমাদের দেশে যারা অবৈধ ভারতীয় আছে, তাদের আমরা এভাবে পুশ ব্যাক করবো না। আমরা তাদেরকে যথাযথ চ্যানেলে ফেরত পাঠাবো। কেননা, পুশ ইন বা পুশব্যাক কোনও আইনসম্মত পদ্ধতি নয়। উপদেষ্টা আরও বলেন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পরিচালিত এই ভাসমান বিওপি একটি অপারেশনাল প্লাটফর্ম, যা জলপথে সীমান্ত এলাকায় টহল ও নজরদারি জোরদার করবে। তিনি বলেন, ‘বয়েসিং ভাসমান বিওপি’ শুধুমাত্র একটি স্থাপনা নয়— এটি একটি কৌশলগত নিরাপত্তা পদক্ষেপ, যা সীমান্ত এলাকায় শান্তি, স্থিতিশীলতা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিজিবির অঙ্গীকারের প্রতিফলন। এই উদ্যোগ সীমান্তে নতুন নিরাপত্তা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে এবং কার্যকর বর্ডার ম্যানেজমেন্টে সহায়ক হবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সীমান্তে কার্যকর জলভিত্তিক নজরদারি নিশ্চিত করতে বিজিবি’র অধীনে একটি বিশেষ ‘রিভারাইন বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন’ গঠনের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, যা ভবিষ্যতে সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। উপদেষ্টা বলেন, সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ জলাভূমি ও নদীঘেরা সীমান্ত এলাকাগুলোতে স্থলপথে নিয়মিত টহল ও নিরাপত্তা বজায় রাখা কঠিন। এই ভাসমান বিওপি চোরাচালান, মানবপাচার, বনজ সম্পদ লুণ্ঠন এবং সীমান্ত অপরাধ প্রতিরোধে বিজিবিকে তাৎক্ষণিক এবং কার্যকর প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (জনসংযোগ) ফয়সল হাসান জানান, বাংলাদেশ-ভারত ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ১৮০ কিলোমিটার নদীমাতৃক। যার মধ্যে প্রায় ৭৯ কিলোমিটার এলাকা সুন্দরবনের অন্তর্গত। পূর্বেও দুটি ভাসমান বিওপি একটি কাঁচিকাটায়, অপর আরেকটি আঠারোবেকিতে স্থাপন করা হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় বয়েসিং-এ তৃতীয় ভাসমান বিওপি হিসেবে গতকাল শনিবার উদ্বোধন করা হলো। বয়েসিং ভাসমান বিওপি এর উদ্বোধনকালে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার এডমিরাল মো. জিয়াউল হক, বিজিবি’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন। পরে উপদেষ্টা সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় অবস্থিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর নীলডুমুর ব্যাটালিয়ন পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি একটি বৃক্ষ রোপণ করেন এবং ব্যাটালিয়নের সদস্যদের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা বক্তৃতা করেন।