
বিএনপির প্রভাবশালী নেতা প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার পুত্র প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে ঘোষণা না করায় ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠছেন নগরবাসী। এরইমধ্যে বিষয়টি নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। ইশরাকের শপথ চেয়ে আজ শনিবার সচিবালয় অভিমুখে বিক্ষোভ করার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকাবাসী। এতে উত্তাল হয়ে উঠতে পারে প্রেসক্লাব ও সচিবালয়সহ আশপাশের এলাকা।
জানা গেছে, অবিভক্ত ঢাকার মেয়র ছিলেন বিএনপির বর্ষিয়ান নেতা প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা। তারই পুত্র প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকাবাসীর ব্যানারে নগর ভবনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি থেকে নতুন এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। আজ শনিবার সকাল ১০টায় নগরভবন থেকে প্রেসক্লাব হয়ে সচিবালয় পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল করার ঘোষণা দিয়েছে দ্বিতীয় দিনের মতো গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দেয়া নগরবাসী। এর আগে গত বুধবার প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথ পাঠ না করানোয় বিক্ষোভ সমাবেশ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দারা। এর আগে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার দাবিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন ঢাকাবাসী। একইসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় তালাবদ্ধ করে দিয়ে নগরভবনের সামনে অবস্থান নেন বিক্ষোভকারীরা।
এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২০২০ সালের মেয়র নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেনের দায়েরকৃত নির্বাচনী মামলার রায় ও নির্বাচন কমিশনের আপিল দায়ের না করা বিষয়ে কোনো আইনি জটিলতা আছে কি না, সে বিষয়ে আইন ও বিচার বিভাগে চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব মাহবুবা আইরিন স্বাক্ষরিত ‘মতামত প্রদানসংক্রান্ত’ শিরোনামে চিঠিটি গত বৃহস্পতিবার আইন ও বিচার বিভাগের সচিব বরাবর পাঠানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়, ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে বিচারিক আদালতের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন আপিল না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯-এর ধারা ৬ অনুযায়ী পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণে কোনো আইনগত জটিলতা আছে কি-না, এ বিষয়ে আইন ও বিচার বিভাগের কাছে জানতে চেয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া চিঠিতে আরও বলা হয়, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে নির্বাচন কমিশনকে বিবাদী করে মামলা হলেও তাতে কমিশন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। মামলায় একতরফা রায় হয়েছে। আবার মামলার আরজি সংশোধনীর বিষয়ে হাইকোর্টের রায় আমলে না নিয়ে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে রায় হয়। এ রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন হয়েছে। অথচ বরিশাল সিটি করপোরেশনের পরাজিত মেয়র প্রার্থীর একই ধরনের আবেদন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে খারিজ হয়েছে। আবার সিটি করপোরেশনে নির্বাচনে প্রার্থীদের মেয়াদকাল-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে আইনগত বাধা রয়েছে কি না, সে বিষয়েও মতামত চেয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
এদিকে, আদালতের রায় এবং নির্বাচন কমিশনের গেজেট বিজ্ঞপ্তির পর ও বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নির্বাচিত মেয়র হিসেবে পদে না বসানোর কারণে ক্রমশ ক্ষোভ বাড়ছে নগরবাসীর মাঝে। অনির্বাচিত প্রশাসকের চাইতে জনতার মেয়র অনেক উত্তম এ স্লোগানকে সামনে রেখে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ডেমরা থানা বিএনপি এবং সাধারণ মানুষ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তার একটি কর্মসূচি হিসেবে গত বুধবার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র আলহাজ্ব নবী উল্লাহ নবীর তত্বাবধানে ডেমরা থানা বিএনপির সভাপতি পদ প্রত্যাশী এসএম রেজা সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক আনিসুজ্জামান এর নেতৃত্বে নগর ভবন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে। এ ছাড়া ডেমরা থানা বিএনপির নেতা-কর্মী এবং নগরবাসী আরো বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে বলে জানা গেছে।
গতকাল শুক্রবার সকাল ১১ টায় ডেমরা থানা বিএনপির কার্যালয়ে একটি প্রস্তুতি সভা করেছে থানা বিএনপি ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড নগরবাসী।এ সময়ে উপস্থিত নগরবাসী এবং বিএনপি নেতারা বলেন, অনির্বাচিত প্রশাষকের চেয়ে নির্বাচিত মেয়র পারে এলাকার উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে। একজন প্রশাসক এলাকার কোন খোজ খবর রাখে না। মহানগর অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। উন্নয়ন হচ্ছে না। কিছু কিছু সড়কে সারা বছরই পানি জমে থাকে এসব কাজে তাদের মনোযোগ নাই তাই উন্নয়নের জন্য নির্বাচিত জনতার মেয়র ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে অতি দ্রুত শপথ গ্রহণের দিন ধার্য্য করে শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানান। এ সময় মাহফুজ আলম বলেন, স্টাফ কোয়ার্টারের সাথে ৬৮ নং ওয়ার্ডের সংযোগ সেতু সাধারণ মানুষের ভোগান্তি অন্যতম একটি কারণ এ সেতুর জন্য বিভিন্ন সময়ে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টদের কাছে ধর্না দিতে দিতে পেরেশান হয়ে গেছি কোনো কাজ হচ্ছে না। এ সময় যদি নির্বাচিত মেয়র থাকতো তাহলে হয়তো আমাদের এত পেরেশানী হওয়া লাগতো না। মেয়রের নিজের প্রয়োজনে এ সেতুটি পূর্ননির্মাণ করা হয়ে যেত আমরা সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লাঘব করার জন্য জনতার মেয়র ইশরাকের বিকল্প নাই। এ সময়ে ডেমরা থানা বিএনপির সভাপতি পদ প্রত্যাশী এসএম রেজা সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক আনিসুজ্জামান বলেন, নির্বাচিত জনতার মেয়র ইঞ্জিনিয়ার মো. ইশরাক হোসেনকে তার প্রাপ্য অধিকার মেয়র পদে বাসানোর জন্য মাননীয় আদালতের রায় এবং নির্বাচন কমিশনের গেজেট বিজ্ঞপ্তির বাস্তবায়ন দেখতে চায় নগরবাসী নয়তো রাজধানীর ডেমরা থেকে বৃহত্তর কর্মসূচী দেয়া হবে এবং দেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর সাথে রাজধানীর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে এবং ঢাকা ব্লকেট কর্মসূচি পালন করতে বাধ্য হবো। বিএনপি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এখনো পর্যন্ত অপেক্ষা করে আসছে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলে নগরবাসী তাদের দাবি আদায়ের লক্ষে সড়কে নেমে আসতে বাধ্য হবে।
এরআগে গত বৃহস্পতিবার বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার দাবিতে নগর ভবনের প্রধান ফটকসহ বিভিন্ন গেইট অবরুদ্ধ করেন বিক্ষোভকারীরা। এদিন সকাল থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নগর ভবনে ঢুকতে পারেননি। এছাড়া বিভিন্ন সেবা নিতে আসা নাগরিকরাও ভোগান্তিতে পড়েন।
গত বুধবার ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে নগর ভবন প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করে কয়েকশ’ মানুষ। এই দাবিতে গত বৃহস্পতিবার থেকে লাগাতার কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে নগর ভবনের সামনে অবস্থান নেন বিক্ষোভকারীরা। তারা নগর ভবনের প্রধান ফটক থেকে মূল ভবনের সামনের ফাঁকা জায়গা, নগর ভবনের নিচতলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন। ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে বসানোর দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। গোপীবাগ থেকে আসা আমিনুল হক নামে একজন বলেন, ইশরাক হোসেনকে মেয়র করে গেজেট হয়েছে। কিন্তু তার শপথ নিয়ে টালবাহানা করা হচ্ছে। এটা চলবে না। ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব দিতে হবে। বিক্ষোভকারীরা নগর ভবনের প্রধান ফটকসহ প্রবেশপথগুলো আটকে রেখেছেন। তাতে নগর ভবনে কেউ ঢুকতে পারছেন না বলে জানান প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তা রাসেল মাহমুদ। তিনি বলেন, বিক্ষোভকারীরা সকাল থেকেই নগর ভবন প্রাঙ্গণে অবস্থান নিয়েছেন। আমাদের কাউকে সেখানে ঢুকতে দিচ্ছে না। নগর পরিকল্পনা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত বৃহস্পতিবার সকালে অফিসে এসে দেখি মূল গেইট আটকে রেখেছে। এখন বাইরে আরেক জায়গায় অপেক্ষা করছি।
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটির নির্বাচন হয়। বিএনপির ইশরাক হোসেনকে পৌনে ২ লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হন। অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর গেল ২৭ মার্চ ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম মেয়র পদে তাপসকে বিজয়ী ঘোষণার সেই ফল বাতিল করে বিএনপি নেতা ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ের কপি পেয়ে ২২ এপ্রিল গেজেট প্রকাশের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চায় নির্বাচন কমিশন। এরপর ২৭ এপ্রিল ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নতুন মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাকের শপথের আয়োজন এখনো হয়, যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন আন্দোলনকারীরা। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের বাসিন্দা পাভেল আহমেদ বলেন, আমাদের ঢাকাবাসীর দাবি ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেব শপথ পড়ানো এবং মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া। এ বিষয়টি কোর্ট থেকে রায় দেয়া হয়েছে, এখন পর্যন্ত সবকিছু হয়েছে আইন মেনে। তারপরও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব দিতে টালবাহানা করছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তো আর কোর্টের চেয়ে বেশি ক্ষমতা দেখাতে পারে না।