
আগামী আমন মৌসুমের চাষাবাদ নির্বিগ্নে করার জন্য ইউরিয়া সার আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করা হচ্ছে। তবে গেলো বোর মৌসুমের সারের সরবরাহ সঠিক ভাবে না হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংকট দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরিয়া সার সরবরাহ চেইন অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে বিসিআইসি, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো সারের এই ‘সফল’ সরবরাহের গল্পের পেছনে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারেই হারিয়ে যাবে দেশের কৃষি উৎপাদন ও কৃষকের স্বপ্ন। জিটুজি (এ২এ) ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউ.এ.ই) এবং কাতার থেকে আমদানীকৃত ইউরিয়া গ্রানুলার (বড়দানা) সার সরবরাহ করা হয় বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) মাধ্যমে। এই সার আমদানির জন্য দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন। যেখানে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ দেয়া হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) সম্প্রতি প্রায় ৩০ হাজার মে: টন ইউরিয়া সার আমদানির জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে। সাধারণত এমন টেন্ডারে জাহাজ ভাড়া, ট্রাক ভাড়া, লাইটার ভাড়া, লজিস্টিক সাপোর্ট, অপারেশনাল খরচ এবং নির্ধারিত মুনাফা যোগ করে প্রতি মে: টন ইউরিয়ার জন্য আনুমানিক ৫০ থেকে ৫২ মার্কিন ডলার পর্যন্ত খরচ ধরা হয়ে থাকে। তবে এবারের টেন্ডারে দেখা গেছে অস্বাভাবিক একটি প্রবণতা। বিসিআইসি‘র সাধারণ বাজেট কাঠামোর তুলনায় ৬-৮ ডলার কমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মহলে বিষয়টি আলোচনার জন্ম দিয়েছে এবং অনেকেই এটিকে ‘মূল্যযুদ্ধ’ বা প্রাইস ওয়ার হিসেবে দেখছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন কম দরপ্রদান যদি প্রকৃত খরচ কাঠামোর নিচে হয়, তবে তা ভবিষ্যতে পরিষেবা বা ডেলিভারিতে ঘাটতির কারণ হতে পারে। একজন জাহাজ পরিবহন বিশ্লেষক জানান, বাজেট যদি ৫০ ডলার হয় আর কেউ ৪৪ ডলারে কাজ করতে চায়, তাহলে সেখানে হয়তো গুণমান, নিরাপত্তা কিংবা সময়সীমা বিপন্ন হতে পারে। সাধারণত বিসিআইসি প্রতি শিপমেন্টে গড়ে প্রতি মে: টনে ৫০-৫২ মার্কিন ডলার খরচ ধরে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে কিছু শিপিং এজেন্ট ৪২-৪৪ ডলারে টেন্ডার নিচ্ছে। প্রথম দর্শনে বিষয়টি সরকারের ব্যয় সাশ্রয় মনে হলেও এর অন্তরালে লুকিয়ে আছে ভয়াবহ দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং সারের চোরাচালান, যার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের কৃষক সমাজ এবং মুনাফা ভোগ করছে এক শ্রেণীর ব্যাক্তিবর্গ/প্রতিষ্ঠান।
বর্তমানে চারটি প্রতিষ্ঠান বিসিআইসি ইউরিয়া সরবরাহ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তারা হলেনÑবঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড, তাইবা সাইফুল্লাহ জিএল, সামিট অ্যাসোসিয়েট, ইন্টারওশান। যেখানে বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড এবং তাইবা সাইফুল্লাহ জিএল তাদের বরাদ্দকৃত সার যথাসময়ে বিসিআইসি গুদামে বুঝিয়ে দিয়েছে, সেখানে সামিট অ্যাসোসিয়েট ও ইন্টারওশান প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের বরাদ্দকৃত সার পুরোপুরি বুঝিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে সামিট অ্যাসোসিয়েট এর বিরুদ্ধে টেপাখোলা বাফারে ১৫ ট্রাক ইউরিয়া চোরাচালানের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে তৃতীয়পক্ষকে দায়িত্ব দিয়ে সারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। আইন অনুযায়ী পরিবহন ঠিকাদার সরবরাহ কার্যক্রমে সাব-কন্ট্রাক্ট দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তবুও সাব-কন্ট্রাক্টররা নিজ ইচ্ছেমতো সার বিক্রি করে, গুদামে প্রেরণ করে। যখন এই চোরাচালান ধরা পড়ে, তখন দায় চাপানো হয় সাব-কন্ট্রাক্টরের ওপর এবং মামলার মাধ্যমে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়া হয়। একইভাবে ইন্টারওশান এর বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে তারা বরাদ্দকৃত সারের পুরোটা সরবরাহ না করে বিভিন্ন গুদামে বরাদ্দের বিপরীতে অর্থের বিনিময়ে সমন্বয় করছে এবং কিছু অংশ বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। বর্তমানে তাদের কাছে ২২,৯৯৩.৬৫ মেট্রিক টন ইউরিয়া থাকার কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তা নেই। অথচ বিসিআইসির অনেক কর্মকর্তা বিষয়টি জানা সত্ত্বেও রহস্যজনকভাবে নিশ্চুপ রয়েছেন। সামিট অ্যাসোসিয়েটের আরেকটি কেলেঙ্কারির উদাহরণ হলো এমভি সেভেন গেস-৪ জাহাজের তলা ফেটে নদীতে সার নষ্ট হওয়ার ঘটনা। বিসিআইসির তদন্তে দেখা যায় ৪৭ মেট্রিক টন সার কম পাওয়া গেছে। অথচ শিপিং এজেন্ট এমএম শিপিং দাবি করছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ। অথচ খোলা বাজার মূল্যে এই সারের দাম প্রায় ১৩ লাখ টাকা। এই অস্বাভাবিক ক্ষতিপূরণ দাবির পেছনে দুর্নীতির গন্ধ স্পষ্ট। সামিট অ্যাসোসিয়েটের কাছে বর্তমানে তিন জাহাজের অনুকূলে ২০,৩৩১.৮০ মে: টন সার পাওনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার ফলে কৃষকের কাছে সার সঠিক সময়ে পৌঁছায় না, সারের ঘাটতি তৈরি হয়, যার ফলে খোলা বাজারে সারের দাম বেড়ে যায়। কৃষক বাধ্য হয়ে বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য হন। অভিযোগ রয়েছে, সামিট অ্যাসোসিয়েটের সাথে রাজনৈতিক প্রভাবশালী পরিবারের সম্পর্ক আছে। প্রতিষ্ঠানের শুরুর দিকে এর শেয়ারহোল্ডার ছিলেন দেলোয়ার হোসেন, যিনি তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা আমির হোসেন আমুর নিকটাত্মীয় ছিলেন। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মো. ওয়াহিদুর জামান জাকির, যার নেতৃত্বে পূর্বের দুর্নীতির ধারা অব্যাহত রয়েছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমদানি করা সারের সরবরাহে যদি স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করা হয়, তাহলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে। এই দুর্নীতির দায় শুধু কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নয়, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদেরও। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই দুর্নীতি বন্ধে শক্ত পদক্ষেপ না নিলে রাষ্ট্র আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কৃষি খাতে এর প্রভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
ইউরিয়া সারের সরবরাহ চেইনে এই অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে বিসিআইসি, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো সারের এই ‘সফল’ সরবরাহের গল্পের পেছনে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারেই হারিয়ে যাবে দেশের কৃষি উৎপাদন ও কৃষকের স্বপ্ন। নভো ট্রান্সপোর্ট এর স্বত্বাধিকারী সারোয়ার হোসেন সৌরভ বলেছেন, আমাদের ৭১৪০ বস্তা মাল চুরি হয়ে যায়। যার মধ্যে ৩ হাজার ১৫ বস্তা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। বাকিটা উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে থানায় মামলা দায়ের করা হয়। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসির) ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সাইফুল আলমকে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসির) বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে জানাতে পারবো। অপরাধী হলে অবশ্যই শাস্তি পাবে।