
কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি
সারাদেশেই শিশুশ্রম দেখা গেলেও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে এর পরিমাণ অনেক বেশি। একটি পর্যটন কেন্দ্র যত উন্নত হয়, সেখানে শিশুশ্রম ততো বাড়ে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের বর্তমান অবস্থা অনেকটা এমনই। দিনদিন পর্যটক বাড়ছে, বিনিয়োগকারী বাড়ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে শিশুশ্রমও। আর এই শিশুশ্রম বাড়ার কারণ হিসেবে পরিবারের অভাব এবং দেশের প্রচলিত আইন সংশোধনের সঙ্গে পুঁজিবাদের সিস্টেমকেও দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের সেবা দেয় প্রায় ১৬টি পেশার লোকজন। এরমধ্যে বেশকিছু পেশায় শিশুশ্রম হয় শতভাগ, আবার অনেক পেশায় তা খুবই সামান্য।
স্থানীয়রা বলছে, পর্যটক যখন বৃদ্ধি পায় তখনই শিশুশ্রম বাড়ে, তবে এসব শিশুরা স্থানীয় কিছু সংখ্যক হলেও, বাইরে থেকে আসে বেশি। এদের অনেকের পরিবার তাদেরকে ফিরিয়ে নিলেও বেশিরভাগ শিশু থেকে যায়। সমুদ্র সৈকতে বাড়তি বিনোদন নিতে ঘোড়ার পিঠে চড়ে পর্যটকরা। ঘোড়ার পিঠে চড়ে তারা সৈকতে ঘোরাঘুরি করে, ছবি তোলে। সৈকতে প্রায় ২০টি ঘোড়া রয়েছে যেগুলোর মালিক ৩-৪ জন। এই ঘোড়াগুলো একজন নিয়ন্ত্রণ করে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো ২০টি ঘোড়ার যারা পরিচালক তারা সবাই শিশু। সবার বয়স ৭ থেকে ১৬ বছর।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সারা বছরই ঘোড়াগুলোকে এই কাজ করানো হয়। তবে মালিকরা নিজেরা করেন না। তারা শিশুদের দিয়ে পরিচালনা করেন। তেমনই একজন সানাউল্লাহ (১৩)। দুই বছর যাবত ঘোড়া চালায় সে। কুয়াকাটা এলাকার মধু নামের এক মালিকের কাছ থেকে সে ঘোড়া নিয়েছে। সেটা থেকে যা আয় হয় তার অর্ধেক সানাউল্লাহ পায়, বাকিটা পায় ঘোড়ার মালিক। সানাউল্লাহর বাবা অটোভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতে না পারায় এই কাজ বেছে নেয় সে। তবে সানাউল্লাহ পরিবারের হাল ধরতে এলেও ৭ বছরের ইয়াসিন এসেছে বাড়ি থেকে পালিয়ে। বরগুনার আমতলী থেকে ২ মাস আগে পালিয়ে কুয়াকাটায় আসে সে। এরপর তার পরিবার তাকে নিতে এলেও সে না গিয়ে নিজেই শিখেছে ঘোড়ার নিয়ন্ত্রণ। এরপর থেকে একটি ঘোড়ার দায়িত্ব নিয়েছে। এসব শিশু প্রতিদিন ১০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকে। তবে তাদের অনেকের পরিবার নিতে চাইলেও তারা কুয়াকাটা ছেড়ে যেতে চায় না।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে বিকেল থেকেই দেখা মেলে ভ্রাম্যমাণ চ-কফি বিক্রেতাদের। যা চলে গভীর রাত পর্যন্ত। এর মধ্যে প্রাপ্ত বয়সের বেশ কয়েকজন থাকলেও দেখা মিলবে অনেক শিশুর, যাদের বয়স ১০ থেকে ১৬ বছর। তাদের একজন শাহ জালাল (১৪)। মায়ের সঙ্গে কুয়াকাটায় নানা বাড়িতে থাকে। বাবা ঢাকায় রিকশা চালান। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও করোনার পরে আর করা হয়নি। এরপর দৈনিক ৩০০ টাকা বেতনে ফিস ফ্রাই মার্কেটে কাজ করলেও পরে ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় শাহ জালাল। মাত্র ১ হাজার টাকা খরচ করে চা বিক্রি শুরু করলেও ৩ মাসে এবার ছোট্ট গাড়ি বানিয়ে দৈনিক তার আয় ৩০০-৬০০ টাকা। শুধু শাহজালাল না, এরকম ২০ থেকে ২৫ জন ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতা পাওয়া যায়। যার মধ্যে ৯-১০ জন শিশু। যার অর্ধেক স্থানীয় হলেও বাকিরা বিভিন্ন জেলা থেকে আগত। এই পর্যটন কেন্দ্রে প্রতিনিয়ত সড়কগুলো উন্নত হচ্ছে। বাড়ছে যানবাহনও। তবে পর্যটকদের বিভিন্ন স্পট ভ্রমণে ভ্যান-অটোরিকশার বেশ চাহিদা রয়েছে। ফলে প্রতিনিয়ত ভ্যানগুলো নিয়ে রাস্তায় নামছেন অনেকে। এর মধ্যে অনেকেই চালক হিসেবে অপরিপক্ক।
অটোরিকশা মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, কুয়াকাটার আশপাশে অটোভ্যানের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। যার মধ্যে পাঁচ শতাধিক চালকের বয়স ১২ থেকে ১৮ বছর। তবে এসব অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের অদক্ষতার কারণে বিভিন্ন সময় ঘটছে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। শুধু তা-ই নয়, এভাবে চলতে থাকলে এদের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত বলে মনে করেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট নেতারা।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে কিটকট ছাতার নিচে বসে বেশিরভাগ পর্যটক সমুদ্র উপভোগ করেন। তবে এই কিটকটগুলোকে জোয়ার ভাটায় ওঠানোর কাজগুলো করে অনেকে। তাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা তুলনামূলক কম। তবে কিটকট ছাতা মোছা, ভাড়া ওঠানো, সময় নির্ধারণের কাজগুলো করে থাকে শিশুরা। সৈকতে এমন শিশুর সংখ্যাও প্রায় ৮-১০ জন। এই সকল শিশুদেরকে মালিকপক্ষ মাসিক বেতন দিয়ে রাখেন, যাদের মাসিক বেতন ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। এছাড়াও আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট, ডাব বিক্রেতা, শুঁটকি পল্লিসহ সব জায়গাতেই দেখা মেলে শিশু শ্রমিকের। স্থানীয় সংগঠকেরা বলছেন, কর্মসংস্থান থাকায় এসব শিশুরা এখানে ঝুঁকছে। যে কারণে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ কম হচ্ছে।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার (টোয়াক) সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, কুয়াকাটা একটি পর্যটন কেন্দ্র, এখানে কর্মের খোঁজে অনেক মানুষ আসে। তার মধ্যে শিশুরাও আসে, কেউ পরিবারের হাল ধরতে, কেউ স্কুল ফাঁকি দিয়ে আবার অনেকে সখের বসে এসে কাজ করে। প্রতিটি সেক্টরে শিশুদের দিয়ে কাজ করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ কম পুঁজিতে শ্রমিক পাওয়া। অন্যদিকে অসহায় পরিবারের দিকে তাকিয়ে তাদের কাজ দেয়া হয়। শিশুশ্রম যেরকম একটি সমাজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে, পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে কর্মস্থান থাকায় শিশু অপরাধ কম হচ্ছে। তবে শিশুদের দিক বিবেচনায় সরকারের আরও জোরালো পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগীয় প্রধান ড. হাফিজ আশরাফুল হকের মতে, এই অল্প বয়সে শিশুদের কাজে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে শুধু যে পারিবারিক অসচ্ছলতাই দায়ী এমনটা নয়, বাংলাদেশে আইনের সঠিক ব্যবহার না করা এবং সিস্টেমের অনিয়ম বড়ভাবে দায়ী। পাশাপাশি দেশের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এই আইনকে আরও ভঙ্গুর করে তোলে। তাই পর্যটন আইন, শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন, পরিবারের সচ্ছলতা বৃদ্ধিতে সরকারের দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি এবং দেশে প্রচলিত সিস্টেমকে পরিবর্তন করে এসব শিশুদের পাশে দাঁড়াতে পারলেই শিশুশ্রম কমানো সম্ভব। তা না হলে একটি সময়ে এই শিশুদের একটি বড় অংশ শিক্ষা ও সমাজের সভ্যতা থেকে ছিটকে পড়বে।