* চরম গ্যাস সংকটে কল-কারখানাগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে * টেক্সটাইলসহ উৎপাদন কমেছে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ

শিল্পখাতে অশনি সংকেত

আপলোড সময় : ০৮-০৫-২০২৫ ০৭:২৪:৫৩ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ০৮-০৫-২০২৫ ০৭:২৪:৫৩ অপরাহ্ন
শিল্প খাতে বরাদ্দকৃত গ্যাস বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে সরিয়ে নেয়ায় দেশের কল-কারখানাগুলো চরম গ্যাস সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন খাতে উৎপাদন ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। রফতানি আদেশ বাতিল এবং শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঝুঁকিও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চরম গ্যাস সংকটে শিল্পখাতে বড় বিপর্যয়ে দেখা দিয়েছে অশনি সংকেত।
শিল্পের উদ্যোক্তাদের দাবি, গ্যাস সংকটে শিল্প খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। গ্যাসসংকটে শিল্প খাতে বিনিয়োগও প্রায় থমকে আছে। কর্মসংস্থান বাড়ছে না। শিল্প খাত না বাঁচলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি থেমে যাবে। তাই শিল্পের গ্যাস-বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে জোরালো উদ্যোগ নেয়ার তাগিদ দিচ্ছেন শিল্পোদ্যোক্তা এবং রফতানিকারকরা।
জানা গেছে, চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এ খাতের চার সংগঠনকে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে বাধ্য হতে হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই বিজ্ঞাপনে বলা হয়, গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের আশ্বাসে গত কয়েক বছরে ৩০০ শতাংশের বেশি গ্যাসের দাম বাড়ালেও গত দুই সপ্তাহ ধরে মারাত্মক গ্যাস সংকটে পড়েছে এ খাতের কারখানাগুলো। গ্যাস সংকটের কারণে ভুগছে দেশের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্প। ঝুঁকিতে পড়েছে রফতানি আয়ের প্রধান এই খাতের ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। পাশাপাশি, মার্কিন শুল্কনীতি বিশ্ববাণিজ্যে সৃষ্টি করেছে নতুন অনিশ্চয়তা। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ভুলতা, মাওনা ও টঙ্গীসহ গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় অনেক বস্ত্র কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। বস্ত্র কারখানায় উৎপাদন চলমান রাখতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ জরুরি। এসব কারখানায় বিদ্যুৎ উৎপাদন, স্পিনিং মেশিন সচল রাখা ও কাপড় রং করতে বয়লারে বাষ্প সৃষ্টির জন্য গ্যাস দরকার হয়। সরবরাহ বাড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্প্রতি গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে অনেক কারখানার মালিক বলছেন, গ্যাসের চাপ না থাকায় শিল্পাঞ্চলের কয়েকটি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। তাই গ্যাসের দাম বাড়লেও স্বস্তি মেলেনি।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস্ অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) জানিয়েছে, গ্যাস সংকটের কারণে প্রায় ৪০০ গ্যাসনির্ভর কারখানা পূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারছে না। বিশেষ করে গাজীপুর, কোনাবাড়ি, শফিপুর, নারায়ণগঞ্জ, ধামরাই ও মানিকগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের চাপ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এর ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়ে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্পে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গ্যাস ও ব্যাংকিং সংকটে উৎপাদনমুখী শিল্প চরম বিপর্যয়ে পড়েছে। গ্যাসের চাপ এতটাই কম যে শিল্পাঞ্চলগুলোতে মেশিনারিজ চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কারখানাগুলো বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন উদ্যোক্তারা এবং প্রতিদিনই লোকসান গুনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বিদ্যুতের সমস্যা থাকলেও গ্যাস সংকটই এখন সবচেয়ে বড় বাধা। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও আশুলিয়ায় গ্যাসের চাপ কোথাও কোথাও প্রায় শূন্যের কোঠায়। এ অবস্থায় উৎপাদন চালানো সম্ভব নয়।
ব্যাংকিং খাত নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে বিলম্ব করছে, ওভার ডিও হলেই এলসি বন্ধ করে দিচ্ছে। ফলে পণ্য সময়মতো পাঠানো যাচ্ছে না, অনেক সময় এয়ার শিপমেন্ট বা ডিসকাউন্ট দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এতে প্রতিনিয়ত ক্ষতির মুখে পড়ছে রফতানিকারকরা।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এক কর্মকর্তা জানান, গাজীপুর অঞ্চলে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ নেমে এসেছে ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে। ফলে শিল্পকারখানাগুলো ব্যয়বহুল বিকল্প জ্বালানি ডিজেল, এলপিজি ও সিএনজি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে, যার ফলে উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে।
বিটিএমএ’র তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ১৮৫৪টি টেক্সটাইল কারখানা রয়েছে, যেখানে ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৯০০টি কারখানা গ্যাসনির্ভর, বিশেষ করে স্পিনিং মিলগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মূলধনের পরিমাণ ১০০ কোটি থেকে এক হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা এসব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় রফতানি আদেশ বাতিল এবং বিদেশি ক্রেতা হারানোর ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে।
নাম প্রকাশ না করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান জানান, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে প্রতিদিন গ্যাস সরবরাহ ১০০ থেকে ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে বহু কারখানা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্প উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, গ্যাসের দাম দুই দফায় বৃদ্ধি করা হলেও সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, এতে অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হচ্ছে। বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল জানান, কারখানাগুলোর অনেক সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকছে, অথচ জ্বালানি ও জনবল খরচ ঠিকই বহন করতে হয়েছে, যা মালিকদের মূলধন থেকেই গেছে। ফলে অনেকেই খেলাপিতে পরিণত হচ্ছেন। গাজীপুরের স্প্যারো অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম জানান, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পরও কোনও কোনও দিন মাত্র দুই ঘণ্টার মতো গ্যাস পাই। এভাবে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা পণ্য সরবরাহ সংকটে অন্য দেশে চলে যাচ্ছেন।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, দেশের মোট গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ২ হাজার ৬৯৮ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় উৎপাদন ১৮৪২ মিলিয়ন এবং আমদানিকৃত এলএনজি ৮৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদা ও সরবরাহের এ বিশাল ব্যবধানের কারণে শুধু শিল্প নয়, সিএনজি স্টেশন ও আবাসিক খাতও সংকটে পড়েছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে শিল্প খাতের গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিতাস গ্যাসের অপারেশন বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আগামী মাস থেকে এলএনজি সরবরাহ কিছুটা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ততদিনে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। চট্টগ্রামের চিত্রও ভিন্ন নয়। কর্ণফুলী গ্যাস সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে দৈনিক ৩০-৩৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি চলছে। সার উৎপাদন কারখানা সিইউএফএল ১৮ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। সিরামিক শিল্পে উৎপাদন কমে গেছে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস সরবরাহ সংকট অব্যাহত থাকলে দেশের শিল্প খাতে ভয়াবহ মন্দা দেখা দেবে। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং রফতানি প্রবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিল্প মালিকরা পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানকে একাধিক চিঠি দিয়ে দ্রুত গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক করার অনুরোধ জানিয়েছেন। তাদের মতে, শিল্পকে বাঁচাতে এবং দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ভুলতা, মাওনা ও টঙ্গীসহ শিল্পাঞ্চলগুলোতে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় অনেক কারখানায় উৎপাদন সক্ষমতা ৩০-৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে ৭০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ হুমকির মুখে। স্পিনিং, ডাইং, প্রিন্টিংসহ নানা কাজে প্রতিদিন প্রায় ২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হলেও সরবরাহ তা থেকে অনেক কম।
বিকেএমইএ ও বিটিএমএ বলছে, এই সংকটে প্রতিটি স্পিনিং মিল দিনে গড়ে ২৫ লাখ টাকা লোকসান দিচ্ছে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি, যদিও সাময়িকভাবে স্থগিত, পশ্চিমা ক্রেতাদের মধ্যে দ্বিধা তৈরি করেছে। ফলে নতুন রফতানি আদেশ আসতে দেরি হচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। মাত্র দুই বছরে ডলারের মূল্য ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১২২ টাকায় পৌঁছেছে। এতে তুলা ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে খরচ বেড়েছে, কার্যকরী মূলধনের সংকট দেখা দিয়েছে। বিটিএমএ’র সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘করোনা, যুদ্ধ ও মুদ্রা সংকটের পর ঘুরে দাঁড়ানোর সময়েই নতুন করে গ্যাস ও শুল্ক সংকটে পড়েছে শিল্প খাত।’ তার মতে, এখনই কার্যকর সমাধান না হলে বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এদিকে শিল্প খাতের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে রফতানি আয়েও। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে রফতানি আয় নেমে এসেছে ৩ দশমিক ০১ বিলিয়ন ডলারে, যা চলতি অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। মার্চের তুলনায় এটি প্রায় ১ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার কম। বিশেষ করে ওভেন পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি এবং সামগ্রিক পোশাক খাতে ধীরগতির প্রভাব স্পষ্ট।
 

সম্পাদকীয় :

সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : সৈয়দ এম. আলতাফ হোসাইন।

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক : সৈয়দ মোঃ আতিকুল হাসান।

নির্বাহী সম্পাদক আশীষ কুমার সেন।

ফোন : ৪৯৩৫৭৭৩০ (বার্তা), ৮৩১৫৬৪৯ (বাণিজ্যিক), ফ্যাক্স; ৮৮-০২-৮৩১৪১৭৪

অফিস :

প্রকাশক কর্তৃক রোমাক্স লিমিটেড, তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে মুদ্রিত।

সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : খলিল ম্যানশন (৩য়, ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলা), ১৪৯/এ, ডিআইটি এক্সটেনশন এভিনিউ, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত।

ই-মেইল : [email protected], ওয়েবসাইট : www.dainikjanata.net