
এবার গ্রীষ্মে দেশে বিদ্যুতের মোট চাহিদা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এর বেশি উৎপাদন চাইলে তিনগুণ খরচের তেলভিত্তিক উৎপাদন কেন্দ্র চালু করতে হবে। বিদ্যুতে ভর্তুকির বিষয়ে আইএমএফের শর্তেও নজর রাখতে হচ্ছে সরকারকে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা বরাবরই বলে আসছেন লোডশেডিং থাকবে। গরম বাড়লে লোডশেডিং বাড়বে। তবে তিনি এ-ও বলছেন, প্রয়োজন হলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবেন। লোডশেডিং থাকলেও সেটা স্বস্তিদায়ক পর্যায়ে থাকবে।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত লোডশেডিং গত বছরের মতো পর্যায়ে যায়নি। এর অন্তরালে বড় ভূমিকা আছে প্রকৃতিরও। গত বছরের এপ্রিল ছিল ৭৬ বছরের মধ্যে উষ্ণতম। তাপমাত্রা ছাড়িয়েছিল ৪৩ ডিগ্রি।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছিল মাত্র ১২৭৮ মিলিমিটার। মাসের ৮ দিনই তাপমাত্রা ছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। চলতি বছর এপ্রিলে সারাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। মাসটিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে গত ২৩ এপ্রিল যশোরে ৩৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর মধ্যে তীব্র কিংবা অতি তীব্র তাপপ্রবাহ ছিল না। গরম বেশি থাকলে বিদ্যুতের চাহিদা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত তাপমাত্রা ও বিদ্যুতের যে চাহিদা-সে অনুযায়ী লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে থাকা যৌক্তিক। সামনে তাপমাত্রা বাড়লে যে চাহিদা তৈরি হতে পারে, সেটাও মোকাবিলায় প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, গত ২৮ এপ্রিল ১২ হাজার ৩৯৭ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে কোনো লোডশেডিং ছিল না। ২৭ এপ্রিল সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ৩৮৮ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে ঢাকা জোনে ৫৫ এবং ময়মনসিংহে ৯৬ মিলে ১৫১ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। এর আগের দিন ২৬ এপ্রিল ১৫ হাজার ৩৯২ মেগাওয়াটের বিপরীতে লোডশেডিং এক হাজার ৪৯১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ঢাকা জোনে ৩১০ মেগাওয়াট, খুলনায় ৪১৬, রাজশাহীতে ৭৫, কুমিল্লায় ২৫০, ময়মনসিংহে ২১০, সিলেটে ৮০, বরিশালে ৮০ এবং রংপুরে ৭০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। গত ২৫ এপ্রিল ১৫ হাজার ৮৫ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে লোডশেডিং ছিল ১২৬ মেগাওয়াট। ২৪ এপ্রিল ১৫ হাজার ৭৮৪ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে লোডশেডিং হয় ১৩৯ মেগাওয়াট। একইভাবে ২৩ এপ্রিল ১৫ হাজার ৫৪৩ মেগাওয়াটের বিপরীতে ১৭৫ মেগাওয়াট, ২২ এপ্রিল ১৫ হাজার ২০১ মেগাওয়াটের বিপরীতে ৯৬ মেগাওয়াট, ২১ এপ্রিল ১৪ হাজার ৫৯১ মেগাওয়াটের বিপরীতে ৬৬ মেগাওয়াট এবং ২০ এপ্রিল ১৫ হাজার ৯৪ মেগাওয়াটের বিপরীতে ১৪৭ মেগাওয়াট লোডশেডিং দেখানো হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের হিসাব বলছে, ২৮ এপ্রিল ১৬ হাজার ২৪৬ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে লোডশেডিং ছিল ১২৭৪ মেগাওয়াট। ২৭ এপ্রিল সারাদেশে বিদ্যুতের ১৫ হাজার ৯১৫ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে লোডশেডিং ছিল ৮৯৮ মেগাওয়াট। ২৬ এপ্রিল ১৫ হাজার ১৬১ মেগাওয়াটের বিপরীতে লোডশেডিং ৩০৬ মেগাওয়াট। ২৫ এপ্রিল ১৫ হাজার ৯৭৫ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে লোডশেডিং ছিল ৯২৩ মেগাওয়াট। ২৪ এপ্রিল ১৫ হাজার ৯৬০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে লোডশেডিং হয় ৮০০ মেগাওয়াট। একইভাবে ২৩ এপ্রিল ১৬ হাজার ৩৪ মেগাওয়াটের বিপরীতে ৭৩৮ মেগাওয়াট, ২২ এপ্রিল ১৫ হাজার ৮৯২ মেগাওয়াটের বিপরীতে লোডশেডিং ছিল ৪৪৬ মেগাওয়াট। অর্থাৎ, গত বছর একই সময়ে লোডশেডিং ছিল কয়েকগুণ বেশি।
বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কিত পিডিবির তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৪০টি। সবগুলো কেন্দ্রের সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ১৩ মেগাওয়াট। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ৫৭টি গ্যাসচালিত কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১১ হাজার ৬২৫ মেগাওয়াট, ৫৫টি এইচএফচালিত (হেভি ফুয়েল অয়েল) কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৫ হাজার ৬৬৩ মেগাওয়াট এবং পাঁচটি ডিজেলচালিত কেন্দ্রের ৬২২ মেগাওয়াট, সাতটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের ৫ হাজার ৬০৩ মেগাওয়াট, একটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের ২৩০ মেগাওয়াট, ১৫টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের ৭৬২ মেগাওয়াট এবং ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের পরিমাণ ২ হাজার ৫০৮ মেগাওয়াট।
পিডিবির হিসাব বলছে, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে খরচ হয় ১২-১৩ টাকা, গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রে ১৫ টাকা, আর তেলচালিত কেন্দ্রে খরচ হয় ৩৫-৪৫ টাকা। পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, সরকার লোডশেডিং পূর্ণমাত্রায় সামাল দিতে চাইলে বিদ্যমান তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে হবে। এতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে খরচ বেশি হবে তিনগুণ। আবার বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। এখন তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকার চালু করবে কি না, সেটি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।
তবে এইচএফও বা তেলভিত্তিক বিদ্যুতে নির্ভরতায় ঝুঁকি রয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোতে বেশি মাত্রায় নির্ভর হলে বিদ্যুৎ বিভাগের ভর্তুকি ১০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আইএমএফ। এই ঋণ মোট সাত কিস্তিতে দেয়ার কথা। ইতোমধ্যে তিন কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির শর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত দিয়েছে। ফলে সরকার চাইলেই ভর্তুকি বাড়িয়ে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে নিতে পারছে না।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (উৎপাদন) মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি। মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের যেভাবে নির্দেশনা দেবে সেভাবে কাজ করবো। তিনি বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। এখন সরকার যদি মনে করে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করে চাহিদা সামাল দিতে, সেটিও করা যায়। এতে ভর্তুকি বাড়বে। এটি সম্পূর্ণ সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। তবে আশা করছি পরিস্থিতি ঠিক থাকবে। স্বাভাবিকভাবে হয়তো কিছুটা লোডশেডিং থাকতে পারে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন মনে করেন, এখনকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছুটা লোডশেডিং দেয়া যেতে পারে। তবে সেটা সব সময়ের জন্য নয়। কারণ এখন তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করলে অতিরিক্ত ডলার খরচ হবে, যেটার চাপ লোডশেডিংয়ের চেয়ে বেশি হবে। তিনি বলেন, দিনে ১৬ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা পর্যন্ত লোডশেডিং দেয়া উচিত হবে না। এর বেশি চাহিদা হলে কিছুটা দেয়া উচিত। তবে আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে ভবিষ্যতে কীভাবে এটা সামাল দেয়া যায়। সেই পরিকল্পনা নিয়েই এগোতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, আমরা বলছি না যে একেবারে লোডশেডিং হবে না। তবে স্বস্তি থাকবে। যদি প্রয়োজন হয় আমরা তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করবো। তিনি বলেন, আমি এখন রূপপুরে আছি। পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ঝিনাইদহে কোনো লোডশেডিং নেই। অনেকে বলছে লোডশেডিং হবে। আমরা বলেছি এবার লোডশেডিং হলেও তা স্বস্তিদায়ক থাকবে।