
ছয় দফা দাবি মেনে নেওয়ার পদক্ষেপ নিতে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এই সময়ের মধ্যে দৃশ্যমান পদেক্ষেপ নেওয়া না হলে ‘লং মার্চ’ করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। গতকাল রোববার ঢাকা জেলার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর শিক্ষার্থীরা সমাবেশে দাবি আদায়ে ৪৮ ঘণ্টার এই ‘আল্টিমেটাম’ দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম কারিগরি ছাত্র আন্দোলন। কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মো. মাশফিক ইসলাম দেওয়ান বলেন, আমাদের দাবি দাওয়া মেনে নিতে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে, যদি এর মধ্যে দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড না দেখানো হয় তাহলে কঠোর থেকে কঠোর কর্মসূচি, প্রয়োজনে লং মার্চ হবে। “সকল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ভাইদের বলে দিতে চাই, সকল কারিগরি শিক্ষার্থী ভাইদের বলে দিতে চাই, আমরা ৮৭ সালের আন্দোলন ভুলে যাই নাই; আমরা ১৩ সালের আন্দোলন ভুলে যাই নাই, আমার ভাইয়েরা রাজপথে রক্ত ঝরিয়েছে, আমরা ভুলে যাই নাই। সকল ভাইদের বলতে চাই, আপনারা সকল সমাবেশে ঐক্যের ডাক দিয়া দেন। আন্দোলন শুধু আমাদের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নয়। এটা সকল শিক্ষক শিক্ষার্থী ইঞ্জিনিয়ার পেশাজীবী সকলের আন্দোলন। জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে পদোন্নতির জন্য ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের পক্ষে যে রিট আবেদন করা হয়েছে, তাকে ‘কালো রিট’ আখ্যায়িত করেন মাশফিক ইসলাম দেওয়ান। তিনি বলেন, এটি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। যদি দ্রুত থেকে দ্রুততম সময়ে এই রিট বাতিল করা না হয়, তাহলে তো আজকে এ সমাবেশ হয়েছে, কালকে বিক্ষোভ হবে, পরশু দিন সারা বাংলাদেশ ব্লকেড হয়ে যাবে। এদিক বেলা ১২টার দিকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নতুন সড়কে মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে ঢাকা জেলার সমাবেশ শুরু হয়। ঢাকার বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটর শিক্ষার্থীরা মহাসমাবেশে অংশ নেন। তারা জুনিয়র ইন্সট্রাকটর পদে ক্রাফট ইন্সট্রাকটরদের প্রমোশনের হাই কোর্টের রায় বাতিলসহ ছয় দফা দাবি জানান। ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ/ শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘দেশ গড়ার হাতিয়ার/ গর্জে ওঠো আরেকবার’, ‘কুমিল্লায় হামলা কেন/ প্রশাসন জবাব চাই’, ‘এসি রুমের বৈঠক/ আর নয় আর নয়’, ‘পলিটেকনিক এক হও, এক হও এক হও’- ইত্যাদি স্লোগান দেন তারা। এর আগে দুপুরে ছয় দফা দাবি আদায় এবং কুমিল্লার কর্মসূচিতে ‘হামলার’ প্রতিবাদে ঢাকা সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধন শেষে তারা ইনস্টিটিউটের মূল ফটকের নামফলক লাল কাপড়ে ঢেকে দেন। শিক্ষার্থীরা এ কর্মসূচিকে বলছেন ‘রাইজ ইন রেড’। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা ‘মামা থেকে মাস্টার, মামা বাড়ির আবদার’, ‘ডুয়েট যদি একটা হয়, ডিপ্লোমারা যাবে কই?’, ‘কুমিল্লায় হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘কারিগরিতে নন টেক চলবে না চলবে না’-ইত্যাদি স্লোগান দেন। দাবি আদায়ে গত শুক্রবার দুপুরে মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে গণমিছিল করেন পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা। আর বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ দেশের বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ে মশাল মিছিল করেন। এর আগে সেদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করলেও কোনো সমাধান হয়নি। আর বুধবার সকাল থেকে ছয় দফা দাবিতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাত রাস্তা, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই গত বুধবার রাতে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান খানকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাকে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে সংযুক্ত করে ইনস্টিটিউটের উপাধ্যক্ষ শাহেলা পারভীনকে অধ্যক্ষের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ।
শিক্ষার্থীদের ৬ দফা দাবিগুলো-
১) জুনিয়র ইন্সট্রাকটর পদে ক্রাফট ইন্সট্রাকটরদের প্রমোশনের হাই কোর্টের রায় বাতিলসহ ক্রাফট ইন্সট্রাকটর পদবি পরিবর্তন এবং ওই মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলকে স্থায়ীভাবে চাকুরিচ্যুত করা। ২০২১ সালের বিতর্কিত ক্রাফট ইন্সট্রাকটর নিয়োগের জন্য নিয়োগবিধি অনতিবিলম্বে বাতিল করা, সুষ্ঠু তদন্তের ভিত্তিতে নিয়োগ বাতিল করা এবং মামলার প্রধান কারিগর ক্রাফট ইন্সট্রাকটরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। ২) ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চার বছর মেয়াদী অব্যাহত রাখা এবং মানসম্মত সিলেবাস ও কারিকুলাম আধুনিক বিশ্বের আদলে প্রণয়ন করা। ৩) উপ-সহকারী প্রকৌশলী ও সমমান (১০ম গ্রেড) পদে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং ও মনোটেকনোলজি (সার্ভেয়িং) হতে পাস করা শিক্ষার্থী ছাড়া অন্য কেউ আবেদন করতে পারবে না এবং এই পদ সংরক্ষিত করতে হবে। প্রাইভেট সেক্টরে ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা ছাত্রদের ন্যূনতম ১০ম গ্রেডের বেসিক অর্থাৎ ১৬০০০ টাকা দেওয়া। ৪) কারিগরি শিক্ষা সংস্কার কমিটি প্রকাশ করে কারিগরি সেক্টর পরিচালনায় পরিচালক, উপ-পরিচালক, অধ্যক্ষ ও দায়িত্বে থাকা সকল পদে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবলকে দায়িত্ব/নিয়োগ দেওয়া। ৫) কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের বিতর্কিত সকল নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন এবং কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল সকল শূন্য পদে পলিটেকনিক ও টিএসসিতে দক্ষ শিক্ষক ও দক্ষ ল্যাব সহকারীর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা। ৬) ডিপ্লোমা ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং ও মনোটেকনোলজি থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য আধুনিক বিশ্বের আদলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করার গেজেট পাস করতে হবে এবং বর্তমানে প্রস্তাবিত চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও, নড়াইল, খাগড়াছড়ি) শতভাগ সিট নিশ্চিত করা।