
দেশের পুরাতন, ক্ষতিগ্রস্ত ও জরাজীর্ণ খাদ্যগুদামগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্যশস্য সংরক্ষণের জন্য বর্তমানে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৪৭৬টি উপজেলায় ৬৩৩টি স্থানীয় সরবরাহ ডিপো (এলএসডি), বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে ১৩টি কেন্দ্রীয় সংরক্ষণাগার (সিএসডি), সমুদ্র ও নদী বন্দরকেন্দ্রিক ছয়টি সাইলো এবং বগুড়া জেলার সান্তাহারে একটি আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার (ওয়্যারহাউজ) আছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিগত পাঁচ বছরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালন বাজেটে যে বরাদ্দ পাওয়া যায়, যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘ক্ষতিগ্রস্ত খাদ্যগুদাম এবং অন্যান্য স্থাপনার সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ প্রকল্প’ হাতে নেওয়া হয়। ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। যদিও এ প্রকল্পের জন্য ৬৪৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়। জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত খাদ্যগুদাম এবং অন্যান্য স্থাপনার সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে প্রতি বর্গমিটার সংস্কার ও মেরামতের জন্য ব্যয় প্রস্তাব করা হয় ৪৫ হাজার টাকা। এর অর্ধেক খরচেই নতুন ভবন নির্মাণ করা হয় জানিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এই ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। বলা হয়, সাধারণত নতুন ভবন নির্মাণ করতেই প্রতি বর্গমিটারের ২৫ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। এই ব্যয় প্রস্তাব অত্যাধিক। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগে প্রকল্পটির প্রস্তাবের ওপর পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা সূত্র বলছে, প্রকল্প গ্রহণের যৌক্তিকতা তুলে ধরে সভায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. সোহেলুর রহমান খান বলেন, দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্যশস্য সংরক্ষণের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৬৩৩টি স্থানীয় সরবরাহ ডিপো, ১৩টি কেন্দ্রীয় সংরক্ষণাগার, সমুদ্র ও নদীবন্দর কেন্দ্রিক ৬টি সাইলো এবং ১টি আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার রয়েছে। সংরক্ষণাগারগুলোর সম্মিলিত ধারণক্ষমতা ২১ দশমিক ৮৬ লক্ষ মেট্রিক টন। তবে, অধিকাংশ খাদ্যগুদাম অত্যন্ত পুরাতন ও জরাজীর্ণ হয়ে ধারণক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। স্বল্পব্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এসব খাদ্যগুদাম এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক অবকাঠামো মেরামত ও সংস্কার করলে খাদ্যশস্য ধারণ ক্ষমতা সমুন্নত রাখাসহ সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এমন প্রেক্ষাপটে ৪২৪টি খাদ্যগুদাম ও আনুষঙ্গিক অবকাঠামো সংস্কারের লক্ষ্যে সম্পূর্ণ জিওবি অনুদানে ৬৪৫ কোটি টাকা প্রাক্কলনে প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়। তবে, ৬৪৫ কোটি টাকা চাওয়া হলেও প্রকল্পটিতে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভায় বলা হয়েছে, বর্তমানে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর (এমটিবিএফ) সিলিং অনুযায়ী প্রকল্পের চাহিদার চেয়ে বাজেট ঘাটতি ২ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। চলমান প্রকল্পেই চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেয়া যাচ্ছে না, তার ওপর এই প্রকল্পে কীভাবে বরাদ্দ পাবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। তাই প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৩০টি গুদামের সংস্কার কাজ করতে হবে। এ ছাড়া পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় গত ৫ বছরে যে সকল খাদ্যগুদাম সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে সে সকল স্থাপনা ফের সংস্কারের প্রস্তাবনা থেকে বাদ দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অনুবিভাগ) মো. মহসীন বলেন, দেশে অনেক জরাজীর্ণ খাদ্যগুদাম রয়েছে। বিশেষ করে কক্সবাজার ও উপকূলীয় এলাকায় বিদ্যমান খাদ্যগুদামগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। কারণ এসব এলাকার পানি লবণাক্ত। যেগুলো আছে সেগুলো সংস্কার করা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কখন কী দুর্যোগ দেশে হানা দেয় তা বোঝা দায়। এসব কারণে খাদ্যনিরাপত্তা বাড়ানো জরুরি। খাদ্য ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে। কোনো কারণে যদি একটা ফসল নষ্ট হয় তখন কী অবস্থা হবে একবার ভেবে দেখেন। বন্যা-খরা-শিলাবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হতে পারে। আমরা পুরোনো খাদ্যগুদামগুলো সংস্কার করলে খাদ্যনিরাপত্তা বাড়বে। পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান ছায়েদুজ্জামান বলেন, যে খাদ্যগুদামগুলো বেশি জরাজীর্ণ সেগুলো প্রকল্পের মাধ্যমে দ্রুত সংস্কারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দ্রুত বাস্তবায়নেই প্রকল্পের আকার ও ব্যয় কমানো হয়েছে। এমটিবিএফের সিলিং থেকে চলমান প্রকল্পগুলোতেই তারা চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দিতে পারছে না। বেশি কাজ নিয়ে বরাদ্দ না পেয়ে ৭ থেকে ৮ বছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার চেয়ে কম কাজ নিয়ে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা ভালো। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে খাদ্য সংরক্ষণের সক্ষমতা বাড়াতে গুদামগুলো দ্রুত সংস্কার দরকার। এদিকে আগের পিইসি সভায় ক্ষতিগ্রস্ত খাদ্যগুদাম ও অন্যান্য স্থাপনা মেরামত ও সংস্কার অংশ বাদ দিয়ে শুধু ১৬টি জরাজীর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত খাদ্যগুদাম এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্থাপনা পুনর্নির্মাণের লক্ষ্যে ডিপিপি পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয় হতে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো ওই প্রকল্পের পুনর্গঠিত ডিপিপিতে ১৬টি খাদ্যগুদাম ও অন্যান্য স্থাপনা পুনর্নির্মাণের পরিবর্তে পুনরায় বিভিন্ন ধারণ ক্ষমতার খাদ্যগুদাম ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক অবকাঠামোর মেরামত ও সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ পিইসি সভার সিদ্ধান্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বর্তমানে পুনর্গঠিত ডিপিপিতে পুনর্নির্মাণ কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত না করে মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শাখাওয়াত হোসেন সভায় অবহিত করে বলেন, দেশের সকল মানুষের জন্য সর্বদা খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খাদ্য সংকট ও বিভিন্ন দুর্যোগের সময় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ভবিষ্যতে সরকারের অধিক পরিমাণে খাদ্য মজুত সক্ষমতার প্রয়োজন হবে। এ লক্ষ্যে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের সার্বিক মজুত সক্ষমতার লক্ষ্যমাত্রা ২০২৫ সালের মধ্যে ৩৭ লাখ টন নির্ধারণ করা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় প্রকল্পটির আওতা বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তিনি। উল্লেখ্য, দেশের খাদ্য সংরক্ষণাগারগুলোর সম্মিলিত ধারণক্ষমতা ২১ লাখ ৮৬ হাজার মেট্রিক টন। অধিকাংশ খাদ্যগুদাম পাঁচ-ছয় দশক আগে নির্মিত। এসব স্থাপনা জরাজীর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে কমছে ধারণক্ষমতা। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার গুদামগুলোর অবস্থা বেশি নাজুক। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় খাদ্যনিরাপত্তা বাড়াতে জরাজীর্ণ খাদ্যগুদামগুলো সংস্কারের এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।