
* ব্যাপক হারে হ্রাস পাবে উৎপাদন * নিরুৎসাহিত হবেন নতুন বিনিয়োগকারীরা * শিল্প কারখানার মালিকদের মধ্যে চলছে ক্ষোভ * দাম বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ভোক্তা
রাজধানীসহ সারাদেশে এমনিতেই নানা সংকটে শিল্পোদ্যোক্তারা। শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানোতে নতুন বিনিয়োগ নয় পুরোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানও টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যাপক হারে হ্রাস পাবে উৎপাদন শিল্পে। নিরুৎসাহিত হবেন নতুন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়াও গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ভোক্তা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এমন সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর শিল্প কারখানার মালিকদের মধ্যে চলছে চরম ক্ষোভ। অর্থনীতির গতি কম, ব্যাংকঋণের সুদের চড়া হার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এসবের মধ্যে নতুন কারখানার জন্য বাড়ল গ্যাসের দাম।
জানা গেছে, চলমান গ্যাসসংকটসহ নানা কারণে ক্ষতির মুখে রয়েছে দেশের শিল্প খাত। দীর্ঘদিন ধরেই চাহিদামতো গ্যাস মিলছে না শিল্প-কারখানাগুলোতে। গ্যাসসংকটের কারণে তাদের উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। শিল্প-কারখানার পাশাপাশি সিএনজি স্টেশন, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও আবাসিক খাতসহ সব ক্ষেত্রে চলছে গ্যাসের সংকট। এরই মধ্যে গ্যাসের দাম নির্ধারণের এই প্রক্রিয়া শিল্পের জন্য বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। একই খাতে ব্যবসারত পুরোনো কারখানা কম দামে গ্যাস পাবে। নতুন কারখানাকে বাড়তি দাম দিতে হবে। ফলে নতুনেরা পুরোনোদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিপাকে পড়বেন। এতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। পাশাপাশি দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় প্রভাব পড়বে যা অর্থনীতির জন্য বড় ক্ষতির সম্মুখিন হবে।
এদিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ঘোষিত গ্যাসের নতুন মূল্যহারকে বৈষম্যমূলক আখ্যায়িত করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি)। তারা বলছেন, সরকারের টেকসই ও নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহের যে লক্ষ্য রয়েছে তাতে পূর্ণ সমর্থন জানালেও বিইআরসি ঘোষিত প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যহারের ফলে নতুন বিনিয়োগ ও শিল্প সম্প্রসারণ চরমভাবে বাঁধাগ্রস্ত হবে। বিইআরসি’র নির্দেশনা অনুযায়ী বিদ্যমান গ্রাহকদের চেয়ে নতুন গ্রাহক, নতুন গ্যাস সেলস অ্যাগ্রিমেন্ট, অনুমোদিত লোডের চেয়ে অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহারকারী এবং প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হবে, এমনকি তা একই খাতের কোম্পানি হলেও। এই দ্বৈত-মূল্য নীতি কেবল ন্যায্য প্রতিযোগিতার নীতিকে লঙ্ঘন করে না বরং প্রতিযোগিতামূলক এই বাজারে সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি অনিশ্চিত করে। ভিন্ন ভিন্ন মূল্যের যে মডেলটি বিইআরসি ঘোষণা করেছে তা নজিরবিহীন এবং এর কারণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। একই খাতে পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে আলাদা আলাদা জ্বালানি খরচের কারণে উৎপাদন খরচে পার্থক্য তৈরি হবে এবং এ ধরনের মূল্য কাঠামো সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরির নীতির পরিপন্থী। সর্বোপরি বাংলাদেশ সরকার যখন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে নানাবিধ পদক্ষেপ নিচ্ছে তখন শুধুমাত্র নতুন শিল্প কিংবা নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত একটি বিপরীতমুখী আচরণ। এধরনের সিদ্ধান্ত সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করবে, ভবিষ্যৎ বিনিয়োগকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে এবং ইনভেস্টমেন্ট সামিটের মতো ইতিবাচক পদক্ষেপের মাধ্যমে অর্জনকে ধ্বংস করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি গত ফেব্রুয়ারিতে যে পর্যায়ে নেমেছে, তা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন (৬ দশমিক ৮২ শতাংশ)। গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৫ শতাংশের মতো। শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণও কমছে। ব্যাংকঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করে দেয়ার পর থেকে তা বাড়ছে। এখন ব্যাংকঋণের সুদহার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে বেসরকারি খাতে প্রকল্প ঋণ কমেছে।
শীর্ষ ১০টি ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাংকগুলো গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে নতুন প্রকল্প এড়িয়ে চলছে। আগে অনুমোদন হয়েছে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এমন ঋণও স্থগিত করেছে কিছু ব্যাংক। এর মধ্যে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে প্রকল্প করতে আগ্রহ কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার গ্যাসের দাম বাড়ালেও সরবরাহ তেমন বাড়াতে পারবে না। কারণ ধারাবাহিকভাবে দেশীয় কূপগুলো থেকে গ্যাসের উৎপাদন কমে আসছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে সর্বোচ্চ আমদানির সক্ষমতা ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ না হলে আমদানি আর বাড়ানো যাবে না। আগামী দুই বছরেও নতুন টার্মিনাল চালুর তেমন সম্ভাবনা নেই। টার্মিনাল নির্মাণে কোনো চুক্তি হয়নি। আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া দুটি চুক্তি বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাই যেভাবেই হোক অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর জোরালো উদ্যোগ নেয়ার পরমার্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকার সাভার, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদী এলাকার শিল্প-কারখানাগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় উৎপাদন ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় এসব এলাকার বেশ কিছু শিল্প-কারখানা কখনো চলছে, কখনো বন্ধ থাকছে। গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিজস্ব ব্যবস্থা থাকলেও গ্যাসের সংকটে শিল্প-কারখানাগুলো সেগুলোও চালাতে পারছে না। এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের এক শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এমনিতেই আগে থেকেই শিল্পে গ্যাসের দাম বেশি। তার পরও তা ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না, কারখানা চালানোও যাচ্ছে না। এ ছাড়া উচ্চ সুদহার, ডলারের সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলারসংকটসহ নানা সমস্যা ব্যবসায় খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ উৎপাদিত পণ্যের রফতানি পর্যায়ে দাম বাড়েনি। ব্যবসায়ীদের যখন চরম সংকটের মুখে টিকে থাকাই দায়, তখনই নতুন করে আবার গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা ব্যবসায়ীদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, একই পণ্যে উৎপাদনে দুই ধরনের গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে বৈষম্যবিরোধীদের হাতে গড়া সরকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করছে। বাজারে অনৈতিক প্রতিযোগিতা তৈরি করছে। বিনিয়োগ করা যাবে না, এমন বার্তা দেয়া হচ্ছে। না হলে এত বড় বিনিয়োগ সম্মেলনের পর কীভাবে গ্যাসের দাম এভাবে নির্ধারণ করা হয়।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, সম্প্রতি এত বড় বিনিয়োগ সম্মেলনের পর কীভাবে গ্যাসের দাম এভাবে নির্ধারণ করা হয়। এটি দেশের জন্য ক্ষতি বয়ে আনবে। এভাবে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে নতুন ইন্ড্রাস্ট্রি তৈরি হবে না। একইভাবে আগের শিল্প কারখানাগুলো অনেকাংশই বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। এই খাতের প্রসার করতে চাইলে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি খাতকে শক্ত অবস্থানে নিতে হয় তাহলে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি তো দুরের কথা আগের দাম থেকেও কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবেই এই খাতের প্রসার সম্ভব।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, শিল্পের প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে একটি স্বচ্ছ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ জ্বালানি মূল্য নির্ধারণ কাঠামো আবশ্যক। আমরা জ্বালানির চাহিদা ও তা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বিইআরসিকে নতুন এই গ্যাসের মূল্য কাঠামো পুনঃবিবেচনা করার আহ্বান জানাচ্ছি এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের মতো বৃহৎ লক্ষ্যগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে নীতি নির্ধারণে দাবি জানাই।
রাজধানীসহ সারাদেশে এমনিতেই নানা সংকটে শিল্পোদ্যোক্তারা। শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানোতে নতুন বিনিয়োগ নয় পুরোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানও টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যাপক হারে হ্রাস পাবে উৎপাদন শিল্পে। নিরুৎসাহিত হবেন নতুন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়াও গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ভোক্তা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এমন সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর শিল্প কারখানার মালিকদের মধ্যে চলছে চরম ক্ষোভ। অর্থনীতির গতি কম, ব্যাংকঋণের সুদের চড়া হার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এসবের মধ্যে নতুন কারখানার জন্য বাড়ল গ্যাসের দাম।
জানা গেছে, চলমান গ্যাসসংকটসহ নানা কারণে ক্ষতির মুখে রয়েছে দেশের শিল্প খাত। দীর্ঘদিন ধরেই চাহিদামতো গ্যাস মিলছে না শিল্প-কারখানাগুলোতে। গ্যাসসংকটের কারণে তাদের উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। শিল্প-কারখানার পাশাপাশি সিএনজি স্টেশন, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও আবাসিক খাতসহ সব ক্ষেত্রে চলছে গ্যাসের সংকট। এরই মধ্যে গ্যাসের দাম নির্ধারণের এই প্রক্রিয়া শিল্পের জন্য বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। একই খাতে ব্যবসারত পুরোনো কারখানা কম দামে গ্যাস পাবে। নতুন কারখানাকে বাড়তি দাম দিতে হবে। ফলে নতুনেরা পুরোনোদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিপাকে পড়বেন। এতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। পাশাপাশি দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় প্রভাব পড়বে যা অর্থনীতির জন্য বড় ক্ষতির সম্মুখিন হবে।
এদিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ঘোষিত গ্যাসের নতুন মূল্যহারকে বৈষম্যমূলক আখ্যায়িত করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি)। তারা বলছেন, সরকারের টেকসই ও নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহের যে লক্ষ্য রয়েছে তাতে পূর্ণ সমর্থন জানালেও বিইআরসি ঘোষিত প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যহারের ফলে নতুন বিনিয়োগ ও শিল্প সম্প্রসারণ চরমভাবে বাঁধাগ্রস্ত হবে। বিইআরসি’র নির্দেশনা অনুযায়ী বিদ্যমান গ্রাহকদের চেয়ে নতুন গ্রাহক, নতুন গ্যাস সেলস অ্যাগ্রিমেন্ট, অনুমোদিত লোডের চেয়ে অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহারকারী এবং প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হবে, এমনকি তা একই খাতের কোম্পানি হলেও। এই দ্বৈত-মূল্য নীতি কেবল ন্যায্য প্রতিযোগিতার নীতিকে লঙ্ঘন করে না বরং প্রতিযোগিতামূলক এই বাজারে সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি অনিশ্চিত করে। ভিন্ন ভিন্ন মূল্যের যে মডেলটি বিইআরসি ঘোষণা করেছে তা নজিরবিহীন এবং এর কারণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। একই খাতে পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে আলাদা আলাদা জ্বালানি খরচের কারণে উৎপাদন খরচে পার্থক্য তৈরি হবে এবং এ ধরনের মূল্য কাঠামো সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরির নীতির পরিপন্থী। সর্বোপরি বাংলাদেশ সরকার যখন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে নানাবিধ পদক্ষেপ নিচ্ছে তখন শুধুমাত্র নতুন শিল্প কিংবা নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত একটি বিপরীতমুখী আচরণ। এধরনের সিদ্ধান্ত সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করবে, ভবিষ্যৎ বিনিয়োগকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে এবং ইনভেস্টমেন্ট সামিটের মতো ইতিবাচক পদক্ষেপের মাধ্যমে অর্জনকে ধ্বংস করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি গত ফেব্রুয়ারিতে যে পর্যায়ে নেমেছে, তা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন (৬ দশমিক ৮২ শতাংশ)। গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৫ শতাংশের মতো। শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণও কমছে। ব্যাংকঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করে দেয়ার পর থেকে তা বাড়ছে। এখন ব্যাংকঋণের সুদহার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে বেসরকারি খাতে প্রকল্প ঋণ কমেছে।
শীর্ষ ১০টি ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাংকগুলো গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে নতুন প্রকল্প এড়িয়ে চলছে। আগে অনুমোদন হয়েছে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এমন ঋণও স্থগিত করেছে কিছু ব্যাংক। এর মধ্যে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে প্রকল্প করতে আগ্রহ কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার গ্যাসের দাম বাড়ালেও সরবরাহ তেমন বাড়াতে পারবে না। কারণ ধারাবাহিকভাবে দেশীয় কূপগুলো থেকে গ্যাসের উৎপাদন কমে আসছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে সর্বোচ্চ আমদানির সক্ষমতা ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ না হলে আমদানি আর বাড়ানো যাবে না। আগামী দুই বছরেও নতুন টার্মিনাল চালুর তেমন সম্ভাবনা নেই। টার্মিনাল নির্মাণে কোনো চুক্তি হয়নি। আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া দুটি চুক্তি বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাই যেভাবেই হোক অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর জোরালো উদ্যোগ নেয়ার পরমার্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকার সাভার, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদী এলাকার শিল্প-কারখানাগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় উৎপাদন ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় এসব এলাকার বেশ কিছু শিল্প-কারখানা কখনো চলছে, কখনো বন্ধ থাকছে। গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিজস্ব ব্যবস্থা থাকলেও গ্যাসের সংকটে শিল্প-কারখানাগুলো সেগুলোও চালাতে পারছে না। এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের এক শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এমনিতেই আগে থেকেই শিল্পে গ্যাসের দাম বেশি। তার পরও তা ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না, কারখানা চালানোও যাচ্ছে না। এ ছাড়া উচ্চ সুদহার, ডলারের সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলারসংকটসহ নানা সমস্যা ব্যবসায় খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ উৎপাদিত পণ্যের রফতানি পর্যায়ে দাম বাড়েনি। ব্যবসায়ীদের যখন চরম সংকটের মুখে টিকে থাকাই দায়, তখনই নতুন করে আবার গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা ব্যবসায়ীদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, একই পণ্যে উৎপাদনে দুই ধরনের গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে বৈষম্যবিরোধীদের হাতে গড়া সরকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করছে। বাজারে অনৈতিক প্রতিযোগিতা তৈরি করছে। বিনিয়োগ করা যাবে না, এমন বার্তা দেয়া হচ্ছে। না হলে এত বড় বিনিয়োগ সম্মেলনের পর কীভাবে গ্যাসের দাম এভাবে নির্ধারণ করা হয়।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, সম্প্রতি এত বড় বিনিয়োগ সম্মেলনের পর কীভাবে গ্যাসের দাম এভাবে নির্ধারণ করা হয়। এটি দেশের জন্য ক্ষতি বয়ে আনবে। এভাবে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে নতুন ইন্ড্রাস্ট্রি তৈরি হবে না। একইভাবে আগের শিল্প কারখানাগুলো অনেকাংশই বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। এই খাতের প্রসার করতে চাইলে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি খাতকে শক্ত অবস্থানে নিতে হয় তাহলে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি তো দুরের কথা আগের দাম থেকেও কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবেই এই খাতের প্রসার সম্ভব।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, শিল্পের প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে একটি স্বচ্ছ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ জ্বালানি মূল্য নির্ধারণ কাঠামো আবশ্যক। আমরা জ্বালানির চাহিদা ও তা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বিইআরসিকে নতুন এই গ্যাসের মূল্য কাঠামো পুনঃবিবেচনা করার আহ্বান জানাচ্ছি এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের মতো বৃহৎ লক্ষ্যগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে নীতি নির্ধারণে দাবি জানাই।