
ভূমি বন্দোবস্ত পেয়ে সরেজমিন সবুজ বেষ্টনীর গাছ দেখে অনেকে প্রতারিত হওয়ার হতাশা জানিয়েছেন। কেউ গিয়ে দেখেন তার দাগের উপর বিশাল খাল। আবার কেউ বন্দোবস্ত পাওয়া ম্যানগ্রোভ বনের গাছ কেটে পরিষ্কার করছেন। বন্দোবস্তের জায়গা বুঝে নিতে গিয়ে এমনই চিত্র দেখা যায় নোয়াখালীর নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলে। বনের সীমানা চিহ্নিত না করে অবমুক্ত ও সার্ভেবিহীন সব অব্যবস্থাপনা রোধে গঠিত জেলা টাস্কফোর্সের উদাসীনতায় ধ্বংসের মুখে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সবুজ বেষ্টনী।
জানা যায়, সংরক্ষিত বনভূমির অব্যবস্থাপনা নিরসনে হাইকোর্টে একটি পিআইএল রিট পিটিশন ৭১৪৫/১৪ দায়ের করা হয়। হাইকোর্টের নির্দেশনায় ২০১৮ সালে নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যান রক্ষণাবেক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে ১৬ সদস্যের ‘জেলা টাস্কফোর্স কমিটি’ গঠন হয়। টাস্কফোর্সকে নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যানে ডিজিটাল সার্ভে করে সীমানা চিহ্নিতকরণ, উদ্যানের ভূমি বন্দোবস্ত দিয়ে থাকলে তা বাতিলের সুপারিশ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, গাছ কর্তন, হরিণসহ বন্যপ্রাণী বিক্রি ও পাচাররোধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রতি তিন মাসে একটি সভা করার নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু গত সাত বছরে টাস্কফোর্স কমিটি মাত্র চারটি মিটিং করেছে। এতে টাস্কফোর্স কমিটির সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাবে অব্যবস্থাপনা কার্যক্রম রোধ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
উপজেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটির গত ১১ মার্চের সভা থেকে জানা যায়, নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বনভূমির ১১ মৌজার নাম ভুল্লখ রয়েছে। কিন্তু উপজেলা ভূমি অফিস একই মৌজা বা চরকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বন্দোবস্ত দিয়েছে। বনবিভাগের গেজেটে নাম চরআলীম, কিন্তু ভূমি অফিস থেকে বন্দোবস্ত দেয়া হয় বড়দেইল বর্ধিতাংশ মৌজা নামে। চরইউনুছকে-সুখচর নামে, চরকালামকে-পূর্ববিরবিরি নামে, চরবাহাউদ্দিনকে-দমারচর নামে, চরকমলাকে-চরমাহিদ নামে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বন্দোবস্ত দেয়ার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় বন বিভাগের। ২০০১ সালে ৪০ হাজার ৩৯০ একর বনভূমি নিয়ে নিঝুমদ্বীপকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণার আরো পরে সংরক্ষিত বনভূমির গ্যাজেট প্রকাশিত হয়। কিন্তু ২০০৮ সালে গ্যাজেটেড জাতীয় উদ্যান নিঝুমদ্বীপকে ইউনিয়ন ঘোষণা করে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়। মূলত তিন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীন কাজে অস্তিত্বের হুমকিতে পড়ে নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যান।
সম্প্রতি ভূমি বন্দোবস্তপ্রাপ্তরা তাদের দখল নিতে বেপরোয়া হয়ে উঠে। সি বিচ এলাকায় মাটি কেটে বাড়ি তৈরি করছে। কোনো কোনো ম্যানগ্রোভ বাগানে রাতের অন্ধকারে গাছের গোড়া রিং কেটে দিয়ে বাকল উঠিয়ে গাছ নিধনের উদ্যোগ নিচ্ছে। অব্যাহত গাছকাটা ও ভূমি দখলের বিরুদ্ধে ইতঃপূর্বে বন বিভাগ থেকে শত শত মামলা করা হয়। মামলায় বন বিভাগ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম অস্থিরতা হুমকি এবং সরকারি কর্মচারীদের অনিরাপত্তা চরম আকার ধারণ করে। বিরূপ পরিস্থিতিতে দফতরগুলোর তুঘলকি কর্মকাণ্ডে ক্রমেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায় নিঝুমদ্বীপের জীববৈচিত্র্য ও এর সবুজ বনভূমি।
হাতিয়া নদীভাঙা ভূমিহীন পুনর্বাসন বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম জানান, ভূমি অফিস যথাযথ জরিপ প্রক্রিয়া অবলম্বন না করে হাত বা চর্চা ম্যাপ করে সংরক্ষিত বনের বাফারজোন, নদীর ভেতরে বন-জঙ্গল সব বন্দোবস্ত দেয়। প্রকৃত ভূমিহীনরা না পেলেও বেশির ভাগ জমি স্থানীয় প্রভাবশালীরা টাকার বিনিময়ে নামে-বেনামে বন্দোবস্ত নেয়ার অভিযোগ করেন তিনি।
হাইকোর্টে রিটকারী রফিক উদ্দিন এনায়েত বলেন, তিন-চারটি সভা ছাড়া টাস্কফোর্স কমিটির নিরবতায় সংরক্ষিত বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বনের সীমানা চিহ্নিতকরণের ডিজিটাল সার্ভে করার নির্দেশনা থাকলেও মন্ত্রণালয়গুলোর অসহযোগিতা ও আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। হাইকোর্টের আদেশে বুয়েটের সাবেক ভিসি ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি পরিবেশবাদী তদন্ত দল নিঝুমদ্বীপ পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দায়ের করেন। তাদের পরিদর্শন প্রতিবেদনটির বাস্তবায়ন উপেক্ষিত রয়েছে।
জাহাজমারা রেঞ্জের সহকারী বন-সংরক্ষক এ কে এম আরিফ-উজ-জামান জানান, টাস্কফোর্স কমিটির সর্বশেষ রিজুলেশন মোতাবেক সীমানা চিহ্নিতকরণ ছাড়া কোনো ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে সংরক্ষিত বনভূমি বন্দোবস্ত কিংবা বুঝিয়ে দেয়া যাবে না। সীমানা চিহ্নিতকরণের পর বন্দোবস্তকৃত ভূমি বাতিল বা পুনর্বাসন করতে হবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত না মেনে বন্দোবস্ত ভূমি বুঝিয়ে দেয়ার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট একাধিক চিঠি দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাজী শামীম জানান, উপজেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটি বিগত সভায় নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যানের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ভূমি অফিস কর্তৃক নতুন করে কোনো বন্দোবস্ত জমি বুঝিয়ে না দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিরোধপূর্ণ জমির সীমানা চিহ্নিতকরণের জন্য জরিপ অধিদফতর যাতে দ্রুত জরিপ শুরু করেন এ জন্য জেলা টাস্কফোর্স কমিটির পরবর্তী সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হবে।