
* প্রতিদিন গড়ে ১৩ জনের বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে
* ধর্ষণের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান জিরো টলারেন্স
* শেষ দশকে নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা বেড়েছে ১.৩ শতাংশ
* গত দুই বছরে সারাদেশে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৯৯৭৭টি
* ৭০ শতাংশ নারী একবার হলেও শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার
দেশজুড়ে ধর্ষণের ঘটনায় বাড়ছে আতঙ্ক, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও মানুষ নামে নরপিশাচের লালসায় শিকার হচ্ছেন শিশু-তরুণী থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী নারীরাও। ধর্ষকদের টার্গেট থেকে বাদ পড়ছেন না স্কুল-কলেজের ছাত্রী, গামের্ন্টকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার নারীরা। প্রতিদিন গড়ে ১৩ জনের বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৭০ শতাংশ নারী একবার হলেও শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার। গত দুই বছরে রাজধানীসহ সারাদেশে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৯৯৭৭টি। মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনায় দেশের নাগরিক সমাজ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। অব্যাহতভাবে চলতে থাকা নারী ও শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন, নারীদের দলবদ্ধভাবে হেনস্তা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাতেদিনে প্রতিবাদ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সড়কে। প্রতিবাদ চলার সময়েও নারী-শিশু ধর্ষণের পরপর কয়েকটি ঘটনা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান জিরো টলারেন্স’বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। দেশের কোথাও নারীর প্রতি কোনো সহিংসতা বা ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটলে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া এ যাবত নারীর প্রতি যত সহিংসতা হয়েছে সেগুলোর তালিকা করে দ্রুত তদন্ত সম্পন্নপূর্বক আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে ব্যাপক সমালোচনার পর ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সরকার।
নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিদের মতে, নারী ও পুরুষের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও অপরাধকে ছোট করে দেখার কারণে অপরাধীরা অপরাধ করার প্রশয় পাচ্ছে। অপর দিকে মামলা হওয়ার পর দীর্ঘ সময় নিয়ে তদন্ত করা, ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে ডিএনএ প্রতিবেদন আবশ্যক সেই প্রতিবেদন দেরিতে দেয়া, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, বড় অপরাধেও আসামির জামিন হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনায় অপরাধ বাড়ছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয় ৮ আগস্ট। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথেষ্ট সক্রিয় না হওয়ায় সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধী চক্র। নারী ও শিশু এখানে বড় টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
গত ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশে অন্তত ৬ হাজার ৩০৫ জন নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার ৪৭১ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। অপরদিকে চলতি বছরের গত দুই মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে কমপক্ষে ১০৭ জন। যাদের মধ্যে ৬৬ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এ ছাড়া আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ৪০১ জন নারী ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর পুলিশ সদর দফতরের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে দেশে নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ১৭ হাজার ৫৭১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে ২৪১টি।
গত শনিবার দিবাগত ১২টার দিকে রাজধানীর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। একই সঙ্গে ঘটনায় জড়িত দু’জনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। একই দিন গাজীপুরের শ্রীপুরে তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে সে দৃশ্য নিজের স্মার্টফোনে ধারণ করে মো. আরমান (২৭) নামে এক তরুণ। ঘটনার সময় ধর্ষণকারীকে হাতেনাতে আটক করে পুলিশে দিয়েছেন স্থানীয় জনতা। এর আগে গত ৬ জানুয়ারি মাগুরা শহরে বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে আছিয়া নামে আট বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পরে অচেতন অবস্থায় শিশুটিকে উদ্ধার করে প্রথমে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে আনা হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। অবস্থার অবনতি হলে একপর্যায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ধর্ষিত আছিয়াকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছিয়া ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) মারা যায় বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়। সন্ধ্যার আগে তার মরদেহ সিএমএইচ থেকে মাগুরার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সেনাবাহিনী।
মাগুরায় মরদেহ পৌঁছানোর পর অ্যাম্বুলেন্সে আছিয়ার মরদেহ শহরের নোমানী ময়দানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় মানুষের ঢল নামে। বাদ এশা আছিয়ার বাড়ি শ্রীপুর উপজেলার জারিয়া গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম সোনাইকুন্ডী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সোনাকুন্ডী সম্মিলিত ঈদগা ও গোরস্থান ময়দানে তাকে দাফন করা হয়।
গত ৮ মার্চ রাতে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় ১৪ বছরের এক কিশোরীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নগ্ন ভিডিও ধারণ এবং পরে সেই ভিডিও দেখিয়ে ধর্ষণচেষ্টা করেন মেয়েটির সৎবাবা। রাতেই ওই ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশে দেন স্থানীয় লোকজন। পরে তার বিরুদ্ধে বন্দর থানায় পর্নোগ্রাফি ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে পৃথক দু’টি মামলা করেন ভুক্তভোগী কিশোরীর মা। ১০ মার্চ রাঙামাটি জেলা শহরে তিন বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে সুভাষ কুমার চাকমা (৬০) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এছাড়া ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলায় চকলেটের প্রলোভন দেখিয়ে সাড়ে চার বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী শিশুর মা বাদী হয়ে হরিণাকুন্ডু থানায় মামলা করেন। এ ঘটনায় ১০ মার্চ বিকেলে ১৫ বছর বয়সী অভিযুক্ত কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। একই দিন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে প্রতিবন্ধী এক তরুণীকে ধর্ষণের মামলায় হাবিবুর রহমান হাবু (৪২) নামে একজনকে গ্রেফতার করে র?্যাব-১১। এসব ঘটনার মতো দেশে প্রতিদিন ১৩ জনের বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ধর্ষণের ঘটনায় আসামি গ্রেফতার করতেও পুলিশ অনেক সময় অনীহা প্রকাশ করে। গ্রেফতার হলেও ভুক্তভোগীর পরিবারকে হুমকি-ধামকি দিয়ে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে যান। জড়িতদের সঠিক বিচারের আওতায় আনা যায় না। ভুক্তভোগী নারী ও শিশুরা সমাজে গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। কেউ আবার আত্মহত্যার পথও বেছে নেন।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ১০ বছর বয়সী এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের ঘটনা ধামাচাপা দিতে স্থানীয় মাতবররা গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি ফিরোজ মিয়াকে চড়-থাপ্পড় আর দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয় সালিশে। জরিমানার ৯২ হাজার টাকা দিলেও ৫৮ হাজার বাকি রাখা হয়। ভুক্তভোগী ওই শিশুর পরিবার জানায়, ভয়ে তারা মুখ খোলেনি। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে সম্প্রতি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে অভিযান চালায়। যশোরের শার্শা উপজেলায় বাকপ্রতিবন্ধী এক কিশোরীকে ধর্ষণে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর ভয়ভীতি দেখিয়ে গর্ভপাত ঘটায় ৬০ বছর বয়সী আবু তালেব। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ভুক্তভোগীর মা বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ধর্ষণের পর কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে তার বাবা-মা বিষয়টি স্থানীয় ব্যক্তিদের জানান এবং বিচার চান। স্থানীয় ব্যক্তিরা বিচার না করে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ওই কিশোরীর বাবা-মাকে ভয়ভীতি দেখান। পরে পল্লী চিকিৎসক দিয়ে ওই কিশোরীর গর্ভপাত করানো হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা অজুহাতে শিশু ও নারী ধর্ষণ, নারীকে হেনস্তা এবং নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার চিত্র দেশে সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি, স্বাভাবিক জীবনযাপন এবং তাদের অগ্রযাত্রার পথে প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর বিচার কার্যক্রম অনেক দেরিতে হচ্ছে। এতে ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের সদস্যরা মানসিকভাবে সমাজের বোঝা মনে করছেন। দ্রুত বিচার করে ধর্ষককে জনসম্মুখে শাস্তি দেয়া গেলে ধর্ষণের ঘটনা কমে আসবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ধর্ষণ মামলার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের ঘটনায় ২০২৩ সালে মামলা হয়েছে পাঁচ হাজার ১৯১টি। ২০২৪ সালে মামলা হয়েছে চার হাজার ৩৯৪টি। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ২৫ মাসে সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে নয় হাজার ৯৭৭টি। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এদিকে, ২০২৩, ২০২৪ ও ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে দায়ের করা ধর্ষণ মামলার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তিন বছরের জানুয়ারির মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৫৪টি, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ৩০৮টি এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ৩৯২টি মামলা হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে শিশু ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৩৪টি করে। চলতি বছর জানুয়ারিতে এক মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২১টি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ২০২৪ সালে করা এক জরিপে উঠে এসেছে, দেশের ৭০ শতাংশ নারী তাদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হন। গত ১২ মাসে বাংলাদেশে ৪১ শতাংশ নারী নানান রকম সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ যৌন সহিংসতাজনিত। গত দশকে নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা ১ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৫ সালে যৌন সহিংসতার হার ছিল ২৭ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২৪ সালে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ; শহরে ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ ও গ্রামে ২৮ শতাংশ।
জরিপে বলা হয়েছে, সহিংসতার শিকার নারীদের প্রায় ৬৪ শতাংশ তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কাউকে কখনো বলেননি। পরিবারের সুনাম রক্ষার আকাক্সক্ষা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ এবং এ ধরনের সহিংসতাকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে করার প্রবণতাসহ বিভিন্ন কারণ থেকে মূলত এই নীরবতা।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে জীবিত ৩৭ কোটি নারী, অর্থাৎ প্রতি আটজনে একজন নারী ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গত আট বছরে তিন হাজার ৪৩৮ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৫৩৯ জনের বয়স ছয় বছরের কম। সাত থেকে ১২ বছরের মধ্যে ৯৩৩ জন। কেবল ২০২৪ সালেই ছেলে শিশু বলাৎকারের ঘটনা ঘটেছে ৩৬টি আর বলাৎকারের চেষ্টা হয়েছে তিনটি।
ইউনিসেফ বলছে, সারা বিশ্বে হিসাব করলে এ সংখ্যা ২৪ থেকে ৩১ কোটি অর্থাৎ প্রতি ১১ জনে একটি ছেলে শিশু শৈশবে বলাৎকার বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ছেলে শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, বলছিলেন এ খাত নিয়ে কাজ করা একাধিক অধিকারকর্মী। ছেলে শিশুর যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও খুব কম ক্ষেত্রেই এ নিয়ে সচেতনতা দেখা যায়। এক্ষেত্রে সরকারের শক্তিশালী ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০২৩ সালের নভেম্বরে ঢাকা মহানগরের শিশুদের ওপর হওয়া যৌন সহিংসতা নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। এতে শিশুদের যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হয়। যেমন: শিশুদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে নির্যাতনকারীর যৌনতৃপ্তি লাভ কিংবা নিজেকে নিয়ে পৌরুষযাচিত চিন্তা এক্ষেত্রে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। এছাড়া শিশুর বাহ্যিক সৌন্দর্যও একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। শিশু কোন পরিবেশে থাকছে, সে বিষয়টিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। যেমন, সুবিধাবঞ্চিত বা বিপজ্জনক স্থানে থাকা শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। একই কথা বলা হচ্ছে নিম্নবিত্ত শ্রেণির ক্ষেত্রেও। দরিদ্রতার কারণে মা হয়তো বাসার বাইরে কাজ করতে চলে গেলেন, বাচ্চাকে বাসায় রেখে যেতে হলো-এরকম ক্ষেত্রে অনেক ঘটনা ঘটে। আর দরিদ্রতার জন্য নিরাপত্তার অভাবও থাকে। এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, বৈরী মনোভাব, পারিবারিক দ্বন্দ্বসহ আরও কিছু বিষয়কে শিশু ধর্ষণের কারণ হিসেবে গবেষণাটিতে উল্লেখ করা হয়।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এনামুল হক সাগর বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ দমনের পাশাপাশি নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে। নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ পুলিশ অঙ্গীকারবদ্ধ। ধর্ষণের ঘটনায় সারাদেশে গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি আক্রমণাত্মক ভঙ্গি, কটূক্তি, ইভটিজিং, হেনস্তা, যৌন হয়রানি বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স হটলাইন (০১৩২০০০২০০১, ০১৩২০০০২০০২, ০১৩২০০০২২২২) সেবা চালু করেছে ইতোমধ্যে। দেশের যে কোনো স্থানে এমন ঘটনা ঘটলে এ হটলাইন নম্বরে অভিযোগ দেয়া যাবে। এছাড়া সাইবার অপরাধের শিকার নারীদের আইনি সেবা ও সুরক্ষা প্রদানে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন ফেসবুক পেজেও অভিযোগ জানাতে পারবেন ভুক্তভোগীরা।
সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজের সভাপতি অধ্যাপক ইশরাত শামীম বলেন, বিচার, বিচার, বিচার। দ্রুত বিচার ছাড়া ধর্ষণ কমবে না। দ্রুত বিচার আইনে বিচার করলে ধর্ষণের ঘটনা অনেক কমে যেত। কারণ অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা এক সময় বেড়ে গিয়েছিল, তখন যাবজ্জীবনসহ মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত বিচারের আওতায় আনা হয়। এরপর অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা কমে আসে। সমাজে এত ধর্ষক, তাদের খুঁজে বিচার করতে পারছি না কেন আমরা? ধর্ষকরা কী এতই প্রভাবশালী? মিডিয়া এত লিখছে কিন্তু তবু কমছে না। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ধর্ষকদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি। বিচার হবে এক বছর ধরে, এটা মানুষ ভুলে যায়। এভাবে হবে না। দ্রুত বিচার আইন ছাড়া কোনো উপায় নেই।
ধর্ষকদের শাস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহান আরা হক বলেন, যে পরিস্থিতি! আমার বাচ্চাটাকেও বাইরে পাঠাতে ভয় করছে। দেশবাসীকে জানিয়ে একজন রেপিস্টকে যদি জনসম্মুখে সামরিক ট্রায়াল করে শাস্তি দেয়া যায় তবেই ধর্ষণের মতো ঘটনা কমে আসবে। তাহলে বোঝা যাবে বিচার হয়। যারা ভুক্তভোগী তারা থানায় যেতে পারেন না, তাদের জন্য কোথাও কোনো স্পেস থাকে না। মামলা করলেও পরবর্তী সময়ে তারা কোনো সুফল পান না। তাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখানো হয়।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, একটি ঘটনার পর কয়েক দিন খুব আলোচনা হয়, তারপর আবার আগের অবস্থা ফিরে আসে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও তা কার্যকরের নজির কম। শিশুদের প্রতিবাদ করার সক্ষমতা ও সাহস থাকে না, ফলে সহজ টার্গেট হয় তারা। যারা ধর্ষণের শিকার হয়, তারা ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও আইনি সুরক্ষা পান না। আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। সামাজিক অনুশাসন ও আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
* ধর্ষণের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান জিরো টলারেন্স
* শেষ দশকে নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা বেড়েছে ১.৩ শতাংশ
* গত দুই বছরে সারাদেশে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৯৯৭৭টি
* ৭০ শতাংশ নারী একবার হলেও শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার
দেশজুড়ে ধর্ষণের ঘটনায় বাড়ছে আতঙ্ক, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও মানুষ নামে নরপিশাচের লালসায় শিকার হচ্ছেন শিশু-তরুণী থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী নারীরাও। ধর্ষকদের টার্গেট থেকে বাদ পড়ছেন না স্কুল-কলেজের ছাত্রী, গামের্ন্টকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার নারীরা। প্রতিদিন গড়ে ১৩ জনের বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৭০ শতাংশ নারী একবার হলেও শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার। গত দুই বছরে রাজধানীসহ সারাদেশে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৯৯৭৭টি। মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনায় দেশের নাগরিক সমাজ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। অব্যাহতভাবে চলতে থাকা নারী ও শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন, নারীদের দলবদ্ধভাবে হেনস্তা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাতেদিনে প্রতিবাদ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সড়কে। প্রতিবাদ চলার সময়েও নারী-শিশু ধর্ষণের পরপর কয়েকটি ঘটনা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান জিরো টলারেন্স’বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। দেশের কোথাও নারীর প্রতি কোনো সহিংসতা বা ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটলে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া এ যাবত নারীর প্রতি যত সহিংসতা হয়েছে সেগুলোর তালিকা করে দ্রুত তদন্ত সম্পন্নপূর্বক আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে ব্যাপক সমালোচনার পর ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সরকার।
নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিদের মতে, নারী ও পুরুষের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও অপরাধকে ছোট করে দেখার কারণে অপরাধীরা অপরাধ করার প্রশয় পাচ্ছে। অপর দিকে মামলা হওয়ার পর দীর্ঘ সময় নিয়ে তদন্ত করা, ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে ডিএনএ প্রতিবেদন আবশ্যক সেই প্রতিবেদন দেরিতে দেয়া, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, বড় অপরাধেও আসামির জামিন হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনায় অপরাধ বাড়ছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয় ৮ আগস্ট। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথেষ্ট সক্রিয় না হওয়ায় সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধী চক্র। নারী ও শিশু এখানে বড় টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
গত ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশে অন্তত ৬ হাজার ৩০৫ জন নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার ৪৭১ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। অপরদিকে চলতি বছরের গত দুই মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে কমপক্ষে ১০৭ জন। যাদের মধ্যে ৬৬ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এ ছাড়া আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ৪০১ জন নারী ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর পুলিশ সদর দফতরের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে দেশে নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ১৭ হাজার ৫৭১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে ২৪১টি।
গত শনিবার দিবাগত ১২টার দিকে রাজধানীর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। একই সঙ্গে ঘটনায় জড়িত দু’জনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। একই দিন গাজীপুরের শ্রীপুরে তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে সে দৃশ্য নিজের স্মার্টফোনে ধারণ করে মো. আরমান (২৭) নামে এক তরুণ। ঘটনার সময় ধর্ষণকারীকে হাতেনাতে আটক করে পুলিশে দিয়েছেন স্থানীয় জনতা। এর আগে গত ৬ জানুয়ারি মাগুরা শহরে বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে আছিয়া নামে আট বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পরে অচেতন অবস্থায় শিশুটিকে উদ্ধার করে প্রথমে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে আনা হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। অবস্থার অবনতি হলে একপর্যায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ধর্ষিত আছিয়াকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছিয়া ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) মারা যায় বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়। সন্ধ্যার আগে তার মরদেহ সিএমএইচ থেকে মাগুরার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সেনাবাহিনী।
মাগুরায় মরদেহ পৌঁছানোর পর অ্যাম্বুলেন্সে আছিয়ার মরদেহ শহরের নোমানী ময়দানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় মানুষের ঢল নামে। বাদ এশা আছিয়ার বাড়ি শ্রীপুর উপজেলার জারিয়া গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম সোনাইকুন্ডী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সোনাকুন্ডী সম্মিলিত ঈদগা ও গোরস্থান ময়দানে তাকে দাফন করা হয়।
গত ৮ মার্চ রাতে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় ১৪ বছরের এক কিশোরীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নগ্ন ভিডিও ধারণ এবং পরে সেই ভিডিও দেখিয়ে ধর্ষণচেষ্টা করেন মেয়েটির সৎবাবা। রাতেই ওই ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশে দেন স্থানীয় লোকজন। পরে তার বিরুদ্ধে বন্দর থানায় পর্নোগ্রাফি ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে পৃথক দু’টি মামলা করেন ভুক্তভোগী কিশোরীর মা। ১০ মার্চ রাঙামাটি জেলা শহরে তিন বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে সুভাষ কুমার চাকমা (৬০) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এছাড়া ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলায় চকলেটের প্রলোভন দেখিয়ে সাড়ে চার বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী শিশুর মা বাদী হয়ে হরিণাকুন্ডু থানায় মামলা করেন। এ ঘটনায় ১০ মার্চ বিকেলে ১৫ বছর বয়সী অভিযুক্ত কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। একই দিন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে প্রতিবন্ধী এক তরুণীকে ধর্ষণের মামলায় হাবিবুর রহমান হাবু (৪২) নামে একজনকে গ্রেফতার করে র?্যাব-১১। এসব ঘটনার মতো দেশে প্রতিদিন ১৩ জনের বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ধর্ষণের ঘটনায় আসামি গ্রেফতার করতেও পুলিশ অনেক সময় অনীহা প্রকাশ করে। গ্রেফতার হলেও ভুক্তভোগীর পরিবারকে হুমকি-ধামকি দিয়ে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে যান। জড়িতদের সঠিক বিচারের আওতায় আনা যায় না। ভুক্তভোগী নারী ও শিশুরা সমাজে গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। কেউ আবার আত্মহত্যার পথও বেছে নেন।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ১০ বছর বয়সী এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের ঘটনা ধামাচাপা দিতে স্থানীয় মাতবররা গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি ফিরোজ মিয়াকে চড়-থাপ্পড় আর দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয় সালিশে। জরিমানার ৯২ হাজার টাকা দিলেও ৫৮ হাজার বাকি রাখা হয়। ভুক্তভোগী ওই শিশুর পরিবার জানায়, ভয়ে তারা মুখ খোলেনি। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে সম্প্রতি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে অভিযান চালায়। যশোরের শার্শা উপজেলায় বাকপ্রতিবন্ধী এক কিশোরীকে ধর্ষণে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর ভয়ভীতি দেখিয়ে গর্ভপাত ঘটায় ৬০ বছর বয়সী আবু তালেব। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ভুক্তভোগীর মা বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ধর্ষণের পর কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে তার বাবা-মা বিষয়টি স্থানীয় ব্যক্তিদের জানান এবং বিচার চান। স্থানীয় ব্যক্তিরা বিচার না করে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ওই কিশোরীর বাবা-মাকে ভয়ভীতি দেখান। পরে পল্লী চিকিৎসক দিয়ে ওই কিশোরীর গর্ভপাত করানো হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা অজুহাতে শিশু ও নারী ধর্ষণ, নারীকে হেনস্তা এবং নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার চিত্র দেশে সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি, স্বাভাবিক জীবনযাপন এবং তাদের অগ্রযাত্রার পথে প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর বিচার কার্যক্রম অনেক দেরিতে হচ্ছে। এতে ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের সদস্যরা মানসিকভাবে সমাজের বোঝা মনে করছেন। দ্রুত বিচার করে ধর্ষককে জনসম্মুখে শাস্তি দেয়া গেলে ধর্ষণের ঘটনা কমে আসবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ধর্ষণ মামলার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের ঘটনায় ২০২৩ সালে মামলা হয়েছে পাঁচ হাজার ১৯১টি। ২০২৪ সালে মামলা হয়েছে চার হাজার ৩৯৪টি। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ২৫ মাসে সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে নয় হাজার ৯৭৭টি। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এদিকে, ২০২৩, ২০২৪ ও ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে দায়ের করা ধর্ষণ মামলার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তিন বছরের জানুয়ারির মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৫৪টি, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ৩০৮টি এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ৩৯২টি মামলা হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে শিশু ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৩৪টি করে। চলতি বছর জানুয়ারিতে এক মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২১টি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ২০২৪ সালে করা এক জরিপে উঠে এসেছে, দেশের ৭০ শতাংশ নারী তাদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হন। গত ১২ মাসে বাংলাদেশে ৪১ শতাংশ নারী নানান রকম সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ যৌন সহিংসতাজনিত। গত দশকে নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা ১ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৫ সালে যৌন সহিংসতার হার ছিল ২৭ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২৪ সালে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ; শহরে ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ ও গ্রামে ২৮ শতাংশ।
জরিপে বলা হয়েছে, সহিংসতার শিকার নারীদের প্রায় ৬৪ শতাংশ তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কাউকে কখনো বলেননি। পরিবারের সুনাম রক্ষার আকাক্সক্ষা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ এবং এ ধরনের সহিংসতাকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে করার প্রবণতাসহ বিভিন্ন কারণ থেকে মূলত এই নীরবতা।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে জীবিত ৩৭ কোটি নারী, অর্থাৎ প্রতি আটজনে একজন নারী ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গত আট বছরে তিন হাজার ৪৩৮ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৫৩৯ জনের বয়স ছয় বছরের কম। সাত থেকে ১২ বছরের মধ্যে ৯৩৩ জন। কেবল ২০২৪ সালেই ছেলে শিশু বলাৎকারের ঘটনা ঘটেছে ৩৬টি আর বলাৎকারের চেষ্টা হয়েছে তিনটি।
ইউনিসেফ বলছে, সারা বিশ্বে হিসাব করলে এ সংখ্যা ২৪ থেকে ৩১ কোটি অর্থাৎ প্রতি ১১ জনে একটি ছেলে শিশু শৈশবে বলাৎকার বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ছেলে শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, বলছিলেন এ খাত নিয়ে কাজ করা একাধিক অধিকারকর্মী। ছেলে শিশুর যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও খুব কম ক্ষেত্রেই এ নিয়ে সচেতনতা দেখা যায়। এক্ষেত্রে সরকারের শক্তিশালী ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০২৩ সালের নভেম্বরে ঢাকা মহানগরের শিশুদের ওপর হওয়া যৌন সহিংসতা নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। এতে শিশুদের যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হয়। যেমন: শিশুদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে নির্যাতনকারীর যৌনতৃপ্তি লাভ কিংবা নিজেকে নিয়ে পৌরুষযাচিত চিন্তা এক্ষেত্রে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। এছাড়া শিশুর বাহ্যিক সৌন্দর্যও একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। শিশু কোন পরিবেশে থাকছে, সে বিষয়টিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। যেমন, সুবিধাবঞ্চিত বা বিপজ্জনক স্থানে থাকা শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। একই কথা বলা হচ্ছে নিম্নবিত্ত শ্রেণির ক্ষেত্রেও। দরিদ্রতার কারণে মা হয়তো বাসার বাইরে কাজ করতে চলে গেলেন, বাচ্চাকে বাসায় রেখে যেতে হলো-এরকম ক্ষেত্রে অনেক ঘটনা ঘটে। আর দরিদ্রতার জন্য নিরাপত্তার অভাবও থাকে। এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, বৈরী মনোভাব, পারিবারিক দ্বন্দ্বসহ আরও কিছু বিষয়কে শিশু ধর্ষণের কারণ হিসেবে গবেষণাটিতে উল্লেখ করা হয়।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এনামুল হক সাগর বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ দমনের পাশাপাশি নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে। নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ পুলিশ অঙ্গীকারবদ্ধ। ধর্ষণের ঘটনায় সারাদেশে গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি আক্রমণাত্মক ভঙ্গি, কটূক্তি, ইভটিজিং, হেনস্তা, যৌন হয়রানি বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স হটলাইন (০১৩২০০০২০০১, ০১৩২০০০২০০২, ০১৩২০০০২২২২) সেবা চালু করেছে ইতোমধ্যে। দেশের যে কোনো স্থানে এমন ঘটনা ঘটলে এ হটলাইন নম্বরে অভিযোগ দেয়া যাবে। এছাড়া সাইবার অপরাধের শিকার নারীদের আইনি সেবা ও সুরক্ষা প্রদানে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন ফেসবুক পেজেও অভিযোগ জানাতে পারবেন ভুক্তভোগীরা।
সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজের সভাপতি অধ্যাপক ইশরাত শামীম বলেন, বিচার, বিচার, বিচার। দ্রুত বিচার ছাড়া ধর্ষণ কমবে না। দ্রুত বিচার আইনে বিচার করলে ধর্ষণের ঘটনা অনেক কমে যেত। কারণ অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা এক সময় বেড়ে গিয়েছিল, তখন যাবজ্জীবনসহ মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত বিচারের আওতায় আনা হয়। এরপর অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা কমে আসে। সমাজে এত ধর্ষক, তাদের খুঁজে বিচার করতে পারছি না কেন আমরা? ধর্ষকরা কী এতই প্রভাবশালী? মিডিয়া এত লিখছে কিন্তু তবু কমছে না। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ধর্ষকদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি। বিচার হবে এক বছর ধরে, এটা মানুষ ভুলে যায়। এভাবে হবে না। দ্রুত বিচার আইন ছাড়া কোনো উপায় নেই।
ধর্ষকদের শাস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহান আরা হক বলেন, যে পরিস্থিতি! আমার বাচ্চাটাকেও বাইরে পাঠাতে ভয় করছে। দেশবাসীকে জানিয়ে একজন রেপিস্টকে যদি জনসম্মুখে সামরিক ট্রায়াল করে শাস্তি দেয়া যায় তবেই ধর্ষণের মতো ঘটনা কমে আসবে। তাহলে বোঝা যাবে বিচার হয়। যারা ভুক্তভোগী তারা থানায় যেতে পারেন না, তাদের জন্য কোথাও কোনো স্পেস থাকে না। মামলা করলেও পরবর্তী সময়ে তারা কোনো সুফল পান না। তাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখানো হয়।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, একটি ঘটনার পর কয়েক দিন খুব আলোচনা হয়, তারপর আবার আগের অবস্থা ফিরে আসে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও তা কার্যকরের নজির কম। শিশুদের প্রতিবাদ করার সক্ষমতা ও সাহস থাকে না, ফলে সহজ টার্গেট হয় তারা। যারা ধর্ষণের শিকার হয়, তারা ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও আইনি সুরক্ষা পান না। আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। সামাজিক অনুশাসন ও আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।