
কত কষ্ট করে সংসারের প্রত্যেক জিনিস গড়েছি। নিজে পোশাক কারখানায় কাজ করি, স্বামী চালান রিকশা। দুজনে কত কষ্ট করে এগুলো করেছি। এক রাতের আগুনে সব শেষ। কিছুই বাঁচাতে পারলাম না। পরনের কাপড় পর্যন্ত বাঁচাইতে পারলাম না। এভাবে আর্তনাদ করে পোড়া আবর্জনার মধ্যে নিজেদের অক্ষত সম্পদ খুঁজছিলেন রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তির বাসিন্দা নিলুফা বেগম। শুধু নিলুফা নন, এমন আর্তনাদ বিধ্বংসী আগুনে পোড়া ঘর হারানো প্রায় প্রত্যেক পরিবারের। দীর্ঘ জীবনের কষ্টে অর্জিত সম্পদ হারিয়ে পাগলপ্রায় মহাখালী সাততলা বস্তির বাসিন্দারা।
বস্তিবাসীর অভিযোগ-বস্তির প্রবেশমুখে বৈদ্যুতিক পিলারে অবস্থিত ট্রান্সফরমার থেকে আগুনের সূত্রপাত। মাঝে-মধ্যেই এই ট্রান্সফরমারে বৈদ্যুতিক গোলযোগ হলেও এর সুষ্ঠু প্রতিকার মেলেনি। ফলে এই ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ হয়েই আগুন লাগে একটি ভাঙারি দোকানে। আর সেখান থেকেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে বস্তিজুড়ে। গতকাল বুধবার সরেজমিনে রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তি ঘুরে ও বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
পুড়ে যাওয়া বস্তির বাসিন্দা নিলুফা বেগম বলেন, কত কষ্ট করে সংসারের সব জিনিস গড়েছি। স্বামী-স্ত্রী দুজনে কত কষ্ট করে সব বানালাম। কিছুই বাঁচাইতে পারলাম না। পরনের কাপড়টা পর্যন্ত বাঁচাইতে পারলাম না। ফ্রিজ, র্যাক, দুটি ওয়ারড্রব, আলমারি সব শেষ। কিছুই নেই। কত কষ্ট করে পুরো মাসের বাজার করছি। সব শেষ, কিছুই বাঁচাতে পারলাম না। সালমা বেগম নামের অন্য এক বাসিন্দা বলেন, রাত ৩টা ১৫ মিনিটে যখন আগুন লাগে প্রথমে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ হয়। পরে সেই ট্রান্সফরমারের নিচে একটা ভাঙারির দোকান ছিল সেই দোকানে আগুন লাগে। তারপর পুরা বস্তিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এই ট্রান্সফরমারে প্রায়ই আগুন লাগে। কিন্তু এটা ঠিক করে না।
তিনি বলেন, আমার এখানে ঘর ছিল। আমার ঘরের ওপরে আমাদেরই আরেকটা রুম করা ছিল। এই দুই ঘর মিলিয়ে আমার ৩-৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আজ ১৭-১৮ বছর ধরে কষ্ট করে যা যা করেছি সব শেষ হয়ে গেছে চোখের সামনে। কিছুই করতে পারিনি। মাথার ওপর একটি বিছানার চাদর টাঙিয়ে পরিবার নিয়ে বসে আছেন বশির আহমেদ। তিনি বলেন, রাত ৪টার দিকে উঠে দেখি আগুন টিনের ওপর উঠে গেছে। তখন আমরা সবাই চেষ্টা করেও আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। আগুন তখন আওতার বাইরে চলে গেছে। তিনি বলেন, এখানে ভাড়া থাকতাম। ঘরে টিভি, ফ্রিজ, খাট, আলমারি নগদ টাকা সব ছিল। পুড়ে সব শেষ হয়ে গেছে। এখন আর কিছুই নেই। এখন কোথায় থাকবো তারও ঠিক নেই। কোনো আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে। তাছাড়া আর কি করার। পরিবার নিয়ে বিছানার চাদর টাঙিয়ে বসে আছি। আমাদের আর কিছুই নেই। কিছুই বের করতে পারিনি রুম থেকে। সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। আগুনে পোড়া আবর্জনা পরিষ্কারে ব্যস্ত মো. রুবেল হাসান। কাজ করতেন রাজমিস্ত্রির। ৯ সদস্যের সংসারে তিনিই চালাতেন পরিবার। রুবেল বলেন, সব পুড়ে শেষ। টিভি-ফ্রিজ সবকিছু মিলিয়ে লাখ দুই টাকার সম্পদ পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। এখন রাতে যে পরিবার নিয়ে থাকবো সেই থাকার জায়গায়ও নেই। তাই থাকার ব্যবস্থা করছি। ময়লা-আবর্জনা সরিয়ে এখানেই কিছু পেতে নিয়ে রাত কাটাতে হবে। এছাড়া আর কিছু করার নেই আমাদের। নবম শ্রেণির মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল প্রতিভা সর্দার। সে বলে, বইখাতা কিছুই নেই। সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। কত টাকা দিয়ে বই কিনেছিলাম সব শেষ। সরকার থেকেও কিছু বই দিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার বই কিনবো কোথা থেকে। কীভাবে করবো পড়াশোনা।
এদিকে ঘটনাস্থলে থাকতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর থেকে ত্রাণ নিয়ে হাজির হন বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক। পার্শ্ববর্তী এলাকার স্বেচ্ছাসেবক রাসেল বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর থেকে ত্রাণগুলো পাঠিয়েছে। আমরা রাস্তা থেকে এনে এখানে বিতরণ করছি। তাদের হিসাব অনুযায়ী কত ঘরের বসবাস ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের হিসাব অনুযায়ী ৩০০ ঘর আর সেখানে ৩০০ পরিবার বসবাস করতো।
এদিকে বুধবার দিনগত রাত ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিটের আপ্রাণ চেষ্টায় দেড় ঘণ্টা পর নেভানো সম্ভব হয় মহাখালীর সাততলা বস্তির আগুন। ভোর ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার রাকিবুল ইসলাম।