
* গত ১৫ বছর জাতীয় পার্টি ভেঙে দুই ভাগ হয়েছে
* ৩৫ বছর ধরে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও ব্যর্থ
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর থেকে জাতীয় পার্টি (জাপা) ঠিকমতো উঠে দাঁড়াতে পারেনি। গত ৩৫ বছর ধরে নিজেদের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। গত ১৫ বছর জাতীয় সংসদের বিরোধী দলে থেকেও জাতীয় পার্টি নিজেকে শক্তিশালী করতে পারেনি। বরং দল ভেঙ্গে দুই ভাগ হয়েছে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবদ্দশায় দলটি ভেঙ্গে তিন ভাগ হয়। এরশাদের মৃত্যুর পর দলটি ভেঙ্গে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। মূল দলের নেতৃত্বে রয়েছেন এরশাদের ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদের ওরফে সেলিম। আর অপর অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন এরশাদের স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদ।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেগম রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাপা চুপচাপ রয়েছে। আর জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি দলকে শক্তিশালী করতে সাংগঠনিক কর্মসূচি দিয়ে সামনে এগোতে চাইলেও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার রোষানলে পরে অনেকটা চুপসে গেছে। তবে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমান বৈরী পরিবেশ থেকে উত্তরণে কূটনৈতিক শক্তির ওপর ভর করেছে দলটি। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরই ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে অভিযুক্ত হওয়ার পর জাতীয় পার্টির (জাপা) রাজনীতি জুলাই বিপ্লবের পর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন দলীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর হয়েছে। দলটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে গত নভেম্বরে মিছিল সমাবেশ করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিলেও ছাত্র-জনতার কঠোর বাধার মুখে পড়ে তা পণ্ড হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয়, আঞ্চলিক ও জেলা উপজেলা পর্যায়ের অনেক নেতা ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দায়ের হওয়া মামলায় আসামি হয়েছেন। অনেকে আত্মগোপন করেছেন। কেউ কেউ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন।
রাজনীতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি ও জামায়াত ইসলামীসহ কয়েকটি দল আগামী নির্বাচন নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ করছে। জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে অংশ নিবে কি না বা বিগত সরকারের দোসর হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা থাকবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। দলীয় কর্মকাণ্ড ঝিমিয়ে পড়লে আবারও নানান কায়দায় দলকে চাঙ্গা করার উদ্যোগ নিয়েছে সংগঠনটি। এক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টিও আমলে নেয়া হচ্ছে। সরকার পতনের পর সারা দেশে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের নামে অর্ধশতাধিক মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। নতুন করে কর্মসূচির ঘোষণার পর যদি হয়রানি বেড়ে যায়, সে আশঙ্কাও রয়েছে দলের নীতিনির্ধারকদের। এজন্য, মাঝে মাঝে দলের কার্যালয়ে হচ্ছে জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক। ভাষা দিবসকে ঘিরে সারা দেশের নেতাকর্মীকে চাঙ্গা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তারা এও বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জাতীয় পার্টি সরকারের কাছ থেকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। একতরফা নির্বাচনে তারা অংশ নিয়ে বিনা ভোটের নির্বাচনগুলোয় বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছে। ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে কাজ করেছে। তারা মন্ত্রিত্ব নিয়েছে। অতএব তারা সহজেই রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারবে না। তাদের রাজনীতির ভবিষ্যৎ অনেকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া দিনে দিনে দলটির জনপ্রিয়তাও তলানিতে ঠেকেছে। কমেছে জনসমর্থন। পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য দলটির নেতাকর্মীরা জনসাধারণের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত, কিন্তু তা না করে তারা যদি ফের আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়ে কথা বলে, সেটা তাদের জন্যই বুমেরাং হবে।
সূত্র জানায়, ঢাকাস্থ পাকিস্তানী কূটনৈতিক মিশন ছাড়া সকল দেশের কূটনৈতিকদের সঙ্গে দেশের সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের। এছাড়া জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে সার্বিক বিষয় নিয়ে একটি লিখিত ফিরিস্তি দিয়েছে। কথা হয় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মাশরুর মাওলা এর সঙ্গে। তিনি জানান, জাতীয় পার্টি দেশের সার্বিক বিষয় নিয়ে ঢাকাস্থ বিদেশী মিশনগুলোর কর্ণধারদের সঙ্গে বৈঠক অব্যাহত রেখেছে। নির্বাচনের বিষয়সহ জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কাজে বাধাসহ নানা বিষয় নিয়ে জাতিসংঘের কাছে একটি ফিরিস্থি দেয়া হয়েছে। শিগগিরই মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। দলটির অন্য একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, গত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন জাতীয় সংসদের সাবেক বিরোধীদল জাতীয় পার্টি নিজ দলকে শক্তিশালী করতে পারেনি। ওই সময় আওয়ামী সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে স্বাধীনভাবে রাজনীতিও করতে পারেনি। দলটির কয়েকজন নেতার দালালীর কারণে জাপা’র দলীয় সিদ্ধান্তসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতো আওয়ামী লীগ। এমন কী জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যও সংসদ নেতাকে দেখিয়ে তারপর উপস্থাপন করা হতো। জাপা যাদের-ই ক্রীড়ানক হিসেবে কাজে লেগেছে, তারাই দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে রেখেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা দলীয় কর্মসূচি নিয়ে সামনে এগোতে পারছে না।
এদিকে, জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে জাতীয় পার্টি পূর্ণ সমর্থন দেয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাপাও অন্তর্বর্তী সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় পরামর্শের জন্য সেনাবাহিনীর ডাক পায়। কিন্তু গত ১৫ বছর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্রীড়ানক হিসেবে কাজ করা জাপা ধীরে ধীরে সেই জায়গা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে তাদের ডাকা হয় না। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে তাদের রাজনীতিও নিষিদ্ধ চায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন। এতে জাপার সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সেই দূরত্ব এখনো ঘোচেনি। এরই মধ্যে তারা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দল গোছাতে মাঠে নেমেছে।
সূত্র বলছে, গত প্রেসিডিয়াম বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলের অতিরিক্ত মহাসচিবরা বিভাগীয় শহর সফর করবেন। এ সময় তারা জাতীয় পার্টিকে সুসংগঠিত করতে বর্ধিত সভাসহ নির্বাচনকে ঘিরে সম্ভাব্য প্রার্থীও খুঁজবেন। এ সময় তারা প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইবেন। কিন্তু দলের এ সিন্ধান্তও ভেস্তে গেছে।
দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য এডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, জাতীয় পার্টির নীতি নির্ধারকদের লক্ষ্য হচ্ছে-আগামী নির্বাচনে এককভাবে নির্বাচন করা। দলের শীর্ষ নেতাদের দাবি, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করা হলে জাপা একক শক্তিতে ভোটের মাঠে সাড়া জাগাবে। তাদের প্রার্থীর প্রস্তুত রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৮৯ আসনে প্রার্থী দিলে জয় পায় মাত্র ১১টিতে। ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা আসন পেয়েছিল ২৩টি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পায় ৩৪টি আসন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আসন পেয়েছে ২৭টি। জাতীয় পার্টি দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের গঠনের পর কয়েকটি মন্ত্রিত্ব পেয়েছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠার পর প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের জীবদ্দশা ও মৃত্যুর পর সব মিলিয়ে ছয়বার ভাঙনের শিকার হয়েছে দলটি। মূল দল থেকে বের হয়ে দল গঠন করে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টি (জেপি), নাজিউর রহমান মঞ্জুর জাতীয় পার্টি (বিজেপি), এম এ মতিনের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। এরশাদের সহচর কাজী জাফরের জাতীয় পার্টি, প্রথম স্ত্রী রওশন এরশাদ ও সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিকের জাতীয় পার্টির নিবন্ধন নেই। সর্বশেষ ভাঙনের মুখে দল থেকে চলে যাওয়া অনেক নেতাকেই দলে ফেরানোর গুঞ্জন উঠলেও সে বিষয়ে এখনো কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।