
বৈরিতা থাকলেও ভারতের ওপর আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে ভারত থেকে আমদানি ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়েছে। যদিও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশে ভারত থেকে পণ্য আমদানি নিম্নমুখী হয়েছিল। টানা তিনদিন বেনাপোল বন্দর দিয়ে বন্ধ ছিলো ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য। গত আগস্টে ভারত থেকে ১৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ আমদানি কমেছিল। কিন্তু ওই সময়ে পেঁয়াজ, ডিম ও কাঁচামরিচের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজারদরে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। দামের ঊর্ধ্বগতি সামাল দিতে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বিপুল পরিমাণে ওসব পণ্য আমদানি করা হয়। তার পর থেকেই পণ্য আমদানিতে আরো বেড়েছে ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ভারতীয় অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে ওই দেশটি থেকে বাংলাদেশে ৯৩৯ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার অর্থমূল্যের পণ্য আমদানি করা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এপ্রিল থেকে জানুয়ারি সময়ে আমদানি হয়েছে ৮৮০ কোটি ৯৯ লাখ ডলারের পণ্য। আর শুধু গত জানুয়ারিতেই ভারত থেকে বাংলাদেশ ১০৭ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। যদিও ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ৯১ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের আমদানি হয়েছিলো।
সূত্র জানায়, ভারত থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি তুলা আমদানি হয়। দ্বিতীয় অবস্থানে খাদ্যশস্য রয়েছে। তাছাড়া খনিজ ও জ্বালানি পণ্য, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য পণ্য ও সেবা আমদানি করা হয়। আর তৈরি পোশাক হলো বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানি হওয়া প্রধান পণ্য। সামপ্রতিক বছরগুলোয় ক্রমেই বাড়তে দেখা যাচ্ছে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা। যদিও শুল্ক বাড়িয়ে দেয়ায় কয়েক বছর আগে ভারত থেকে দীর্ঘদিন চাল আমদানি ব্যাহত হয়েছে। তবে চাল রফতানি শুল্ক কমিয়ে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত নভেম্বরে দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ব্যক্তি খাতের আমদানীকৃত ভারতীয় চাল প্রবেশ করতে থাকে। তারপর গত বছরের ডিসেম্বরে দুই দফায় সরকারিভাবে মোট ১ লাখ টন নন-বাসমতী সিদ্ধ চাল আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। এর ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর জি-টু-জির ভিত্তিতে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আনা চাল বাংলাদেশে প্রবেশ করা ডিসেম্বরে শুরু হয়। জানুয়ারির মাঝামাঝি দেশটি থেকে আরো ৫০ হাজার টন চাল সরকারিভাবে আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে দেশটি থেকে আরো ৫০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দেয় সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি। একই সঙ্গে বেসরকারিভাবে চাল আমদানিও অব্যাহত রয়েছে। এজন্য অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাল আমদানি ও বাজারজাত করার সময়সীমা কয়েক দফা বাড়িয়ে আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, ভারত থেকে এখন বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেলও আমদানি করা হচ্ছে। গতবছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের মধ্যেই ভারত থেকে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। ওই আমদানির ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। গত জানুয়ারির মাঝামাঝিও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টন ডিজেল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। তাতে ১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে এ ডিজেল আমদানি করার কথা। তাছাড়া বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুতের অবদান। তার মধ্যে আদানির কাছ থেকে নেয়া বিদ্যুতের খরচ তুলনামূলক বেশি পড়ছে। যদিও ডলার সংকটের কারণে বকেয়া বিল জমে যাওয়ায় গত বছরের অক্টোবরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ করে দেয় আদানি। তাতে বাংলাদেশে গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সরবরাহ অর্ধেকে নেমে আসে। তাছাড়া শীতে চাহিদা কম থাকায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও একটি ইউনিট থেকেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে বলা হয়েছিল। তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। তবে আসন্ন গ্রীষ্মকালের চাহিদা পূরণের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আবারো পুরো সক্ষমতা (১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট) অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আদানিকে অনুরোধ করা হয়েছে।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনৈতিক প্রয়োজনেই এখন বাংলাদেশে ভারত থেকে পণ্য আমদানি বাড়ছে। বাংলাদেশের রফতানি খাত মূলত আমদানিনির্ভর। যদিও দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নানা সংকট দেখা দিয়েছিল। আর সংকট মোকাবেলায় ভারত ছাড়া কোনো বিকল্প উৎস ছিলো না। তবে এখন বাজার অন্যান্য জায়গায় যাচ্ছে। অন্যান্য উৎস থেকেও পণ্য আসতে শুরু করেছে। তবে এদেশের বিভিন্ন মহলে যতোই ভারতবিরোধী মনোভাব দেখা যাক, বাণিজ্যে তার প্রতিফলন দেখা যায় না।
অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের মতে, ভিসা জটিলতার কারণে ভারতীয়দের সঙ্গে ব্যবসা করা এখন কঠিন হয়ে পড়ছে। সারা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী বন্দরগুলোকে ঘিরে যে আমদানিকারকরা ব্যবসা-বাণিজ্য করছে, পণ্য কেনাবেচা করছে, তাদের অধিকাংশই ভিসা পাচ্ছে না। ফলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে। যদিও ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে জড়াতে রাজি নাকিন্তু ভিসার জন্য ব্যবসার কাজগুলো ভালোভাবে সম্পন্ন করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, বাণিজ্যে বিশেষ করে পণ্য আমদানির উৎসে বৈচিত্র্য আনতে সরকারের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে এখনো তা পুরোপুরি না হলেও সেসব কার্যক্রমের প্রতিফলন কিছুটা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।