
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
* এককভাবে দুই শতাধিক আসনে ধানের শীষ প্রতীক পাবে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা
* বাকি আসনগুলো বরাদ্দ রাখা হবে জোটে থাকা মিত্রদের জন্য
* মনোনয়নের ক্ষেত্রে ২০ ভাগ নতুন মুখ ও ৮০ ভাগ পুরানো মুখ পাবে সবুজ সংকেত
* ৫ ভাগ আমলা, ৩০ ভাগ ব্যবসায়ী ও বাকি ৬৫ ভাগ থাকবে রাজনীতিবিদ
নির্বাচনমুখী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। দলটির সব মনোযোগ এখন নির্বাচন ঘিরে। নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী আলোচনার মধ্যে অর্ধযুগেরও বেশি সময় পর আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল প্রাঙ্গণে বর্ধিত সভা করবে বিএনপি। বর্ধিত সভা থেকে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২২০ থেকে ২২৫টি আসনে ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সবুজ সংকেত দেয়া হতে পারে। বাকি আসনগুলো বরাদ্দ রাখা হতে পারে জোটে বা যুগপৎ আন্দোলনে থাকা মিত্র দলগুলোর জন্য। সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে ২০ ভাগ নতুন মুখ এবং ৮০ ভাগ পুরানো মুখ সবুজ সংকেত পেতে পারেন। এক্ষেত্রে ৫ ভাগ আমলা, ৩০ ভাগ ব্যবসায়ী এবং বাকি ৬৫ ভাগ থাকতে পারেন রাজনীতিবিদ। তবে দলটি মনে করছে, অতি প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সংস্কার শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপেও রাখতে চায় তারা।
দলের পক্ষ থেকে এটিকে ‘বিশেষ বর্ধিত সভা’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। তবে সভার সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা কী হতে পারে, সে সম্পর্কে খোদ দলের নেতাকর্মীরাই এখনো অন্ধকারে। গুঞ্জন রয়েছে, বর্ধিত সভা থেকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সাংগঠনিক এবং আগামী নির্বাচনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এ সভার মধ্য দিয়ে বিএনপি নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু করবে বলে জানিয়েছে নেতাকর্মীরা।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, দলের নেতাকর্মীদের বিশেষ বর্ধিত সভার সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। তবে নেতাকর্মীদের অনুমান, চলমান পরিস্থিতিতে বিএনপির সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল হয়তো না-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে দলের মহাসচিব, সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদলের সিদ্ধান্ত আসতে পারে বিশেষ বর্ধিত সভা থেকে।
সবশেষ ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর লা মেরিডিয়ান হোটেলে নির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভা করেছিল বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন। তবে ১৯৯৭ সালের পর আজ বৃহস্পতিবারই হতে যাচ্ছে বৃহৎ পরিসরে বর্ধিত সভা। জাতীয় সংসদ ভবনের পার্লামেন্ট মেম্বার্স ক্লাবের এলডি হল ও মাঠে এ সভা হবে। এতে প্রায় পাঁচ হাজার নেতা অংশ নেবেন। ভার্চুয়ালি যোগ দেবেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বর্ধিত সভা ঘিরে এরই মধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করেছে দলটি।
জানা গেছে, আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় শুরু হয়ে বর্ধিত সভা চলবে রাত পর্যন্ত। সভায় অংশ নেয়া নেতাদের জন্য সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার ও সন্ধ্যায় নাস্তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দিনব্যাপী সভায় জাতীয় স্থায়ী কমিটি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটির সব নেতা ও সদস্য উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া সব জেলা ও মহানগরীর সভাপতি/আহ্বায়ক, সাধারণ সম্পাদক/সদস্য সচিব, মহানগর ও জেলাধীন সব থানা, উপজেলা ও পৌর কমিটির সভাপতি/আহ্বায়ক, সাধারণ সম্পাদক/সদস্য সচিব এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল থেকে চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছিলেন ও মনোনয়নের জন্য প্রাথমিক চিঠি পেয়েছিলেন তারাও এ সভায় অংশ নেবেন। বর্ধিত সভায় অংশ নিতে আমন্ত্রিত নেতারা নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে নির্ধারিত কার্ড সংগ্রহ করেছেন।
দলটির একাধিক সূত্র বলছে, সম্প্রতি বিভিন্ন মহল থেকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের যে দাবি উঠেছে, সেটিকে তেমন গুরুত্ব দেবে না বিএনপি। বরং জাতীয় নির্বাচনকে মুখ্য করেই পরবর্তী সাংগঠনিক কর্মসূচি ঠিক করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। বর্ধিত সভা সফল করতে দলের পক্ষ থেকে একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। সভা বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক রুহুল কবির রিজভী, সদস্য খায়রুল কবির খোকন, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, আব্দুস সালাম আজাদ, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, এম রশিদুজ্জামান মিল্লাত, ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল, কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল, মাহবুবের রহমান শামীম, সৈয়দ শাহীন শওকত, আসাদুল হাবিব দুলু, আলহাজ্ব জি কে গউছ, অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া, শরিফুল আলম, শামা ওবায়েদ, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম, আজিজুল বারী হেলাল, এবিএম মোশাররফ হোসেন, রকিবুল ইসলাম বকুল, মীর সরফত আলী সপু, প্রফেসর মোর্শেদ হাসান খান, রফিকুল ইসলাম, রফিকুল আলম মজনু ও আমিনুল হক।
ব্যবস্থাপনা কমিটির আহ্বায়ক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, অভ্যর্থনা কমিটির আহ্বায়ক হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ও সদস্য আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী, আপ্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক এম রশিদুজ্জামান মিল্লাত, শৃঙ্খলা কমিটির আহ্বায়ক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, মিডিয়া কমিটির আহ্বায়ক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল ও চিকিৎসাসেবা কমিটির আহ্বায়ক ডা. রফিকুল ইসলাম।
বিশেষ এ বর্ধিত সভার সংবাদ পরিবেশনে গণমাধ্যমের জন্য বিশেষ রীতি চালু করেছে বিএনপি। সভার আগের দিন বিকেলে সভাস্থল থেকে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের অফিসিয়াল চিঠির মাধ্যমে ‘মিডিয়া কার্ড’ সংগ্রহের জন্য দলটির মিডিয়া সেল সাংবাদিকদের বিশেষ অনুরোধ করেছে। এক্ষেত্রে প্রিন্ট পত্রিকার দু’জন রিপোর্টার ও একজন ফটো সাংবাদিক, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দু’জন রিপোর্টার ও দু’জন ভিডিও জার্নালিস্ট এবং অনলাইন পত্রিকার ক্ষেত্রে একজন রিপোর্টার এবং একজন ফটো সাংবাদিকদের জন্য ‘মিডিয়া কার্ড’ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে মাল্টিমিডিয়ার সংবাদকর্মীদের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, ফ্যাসিবাদের দুঃশাসনের কারণে গত ১৫-১৬ বছর সাংগঠনিক তৎপরতা ও দল গোছানোর কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়নি। সরকার পতনের পর তৃণমূলে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেছি। যে কারণে বর্ধিত সভাটি আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্ধিত সভা থেকে দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেবেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। যা নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্য তৈরি করবে। এ মুহূর্তে যা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলেন তিনি।
বিএনপি দলীয় সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু বলেন, ‘এ বিষয়ে (বর্ধিত সভা) আমরা এখনো জানি না। বিশেষ বর্ধিত সভার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান (তারেক রহমান) বক্তব্য দেবেন। আমরা তার বক্তব্য থেকে মেসেজ (বার্তা) পাবো।’
বিএনপি’র সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জয়ন্ত কুমার কুন্ডু বলেন, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশেষ বর্ধিত সভার রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। রাজনৈতিক সভায় রাজনৈতিক বিষয়গুলোই গুরুত্ব পায়। তবে সভার সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা সম্পর্কে আমার জানা নেই। আজ বৃহস্পতিবার দলের যে বর্ধিত সভা ডাকা হয়েছে, মূলত সেই সভা থেকেই নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু করবে বিএনপি। তবে দলের দায়িত্বশীল কোনো নেতা এখনো এ বিষয়ে কিছু স্পষ্ট করেননি।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব ও দলপির অন্যতম মুখপাত্র অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি ও নির্বাচন নিয়ে তৃণমূলের নেতারা কী ভাবছেন, বর্ধিত সভা থেকে তার একটি ধারণা পাওয়া যাবে। তার নিরিখে তৃণমূলকে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক নির্দেশনা দেয়া হবে। এই বর্ধিত সভাকে ‘খুবই সময়োপযোগী’ বলে মনে করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। রমজান ও ঈদুল ফিতরের পরপরই নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মসূচি ও তৎপরতা শুরু করবে বিএনপি।