
বইমেলায় গিয়ে বড়রা ঘুরেফিরে ছবি তুলে বাড়ি ফিরলেও ছোটরা বই না কিনে বাড়ি ফেরে না। শিশু-কিশোরদের বইয়ের আবদার ফেলতে পারেন না অভিভাবকরাও। ফলে বইমেলায় ক্রেতা হিসেবে খুদে পাঠকদের কদর অনেক। প্রকাশকরা বলছেন, এবারের মেলায় বিক্রি নিম্নগামী।
এর মধ্যেও শিশুদের বই মোটামুটি ভালো বিক্রি হচ্ছে। শিশুদের বইমুখী করতে ভূমিকা রাখছে বড় প্রকাশনীগুলো। স্বনামে খ্যাত প্রকাশনীগুলো শিশু-কিশোরদের উপযোগী বই নিয়ে মেলায় হাজির হয়েছে ভিন্ন নামে। তাদের প্রকাশিত বইগুলোই বেশি আকর্ষণ করছে খুদে পাঠকদের।
জানা গেছে, বইয়ের প্রতি শিশুদের আগ্রহী করে তুলতে প্রতিবছর মেলায় আলাদা করে থাকে শিশু চত্বর। এবারও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার দক্ষিণ অংশে শিশু চত্বর রয়েছে। মন্দিরের ফটক দিয়ে উদ্যানে প্রবেশ করলে হাতের ডানে চোখে পড়ে সুরম্য একটি তোরণ। ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা যায়, সাজসজ্জায় শিশুদের উপযোগী করে তোলা হয়েছে জায়গাটি।
চত্বরের মাঝ বরাবর রঙিন পেনসিলের ছবি আর নকশা দিয়ে বৃত্তাকার একটি জায়গা করা হয়েছে। রয়েছে বসার ব্যবস্থাও। রঙিন বাতি আর জনপ্রিয় গল্পের চরিত্রের ছবি দিয়ে প্রাঙ্গণটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেন এক রঙিন ভুবন। প্রতিবছর শিশু চত্বরের যে জায়গাটিতে সিসিমপুর থাকে, এবার সেখানে রয়েছে খেলাধুলার আয়োজন। চারপাশে শিশু-কিশোরদের বইয়ের প্রকাশকদের স্টল।
স্টলগুলোতেও বর্ণাঢ্য সাজ-নকশা। শিশু চত্বরে এবার ৭৪টি প্রতিষ্ঠানকে ১২০ ইউনিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
বইয়ের প্রতি শিশুদের আগ্রহী করে তুলতে প্রধান ভূমিকাটি বইয়েরই। গতকাল বুধবার মেলা ঘুরে দেখা গেছে, চিত্তাকর্ষক আঁকা-লেখায় সমৃদ্ধ বইগুলো শিশুরা লুফে নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে কিন্ডারবুকস, ময়ূরপঙ্খী, শৈশব প্রকাশ, কাকাতুয়া, প্রকৃতি-পরিচয়ের মতো প্রকাশনী। এই প্রকাশনীগুলো যথাক্রমে বেঙ্গলবুকস, আগামী, কথাপ্রকাশ, ঐতিহ্য ও ইউপিএলের শাখা প্রকাশনী। এর বাইরে শিশু একাডেমি এবং শিশুদের জন্য বাংলা একাডেমির আলাদা স্টল রয়েছে মেলায়। এ দুটি প্রকাশনীও অভিভাবকদের বিশেষভাবে কমবেশি টানতে পেরেছে বলে জানা গেছে।
মেলায় কাজী এনায়েত উল্লাহর উপন্যাস মধ্যরাতে পায়ের আওয়াজ : অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে ফ্রান্সপ্রবাসী লেখক কাজী এনায়েত উল্লাহর উপন্যাস ‘মধ্যরাতে পায়ের আওয়াজ’। লেখক কাজী এনায়েত উল্লাহর বয়ঃসন্ধিকালে বাংলাদেশে সংঘটিত হয় মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ। জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ ওই সময়ে স্বচক্ষে দেখা যুদ্ধের ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন এই উপন্যাসটি।
মধ্যরাতে পায়ের আওয়াজ নিছক একটি উপন্যাস নয়, এটি একটি দেশের ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের চিত্র উঠে এসেছে। পাশাপাশি শাসিত ও শোষিত জনগোষ্ঠীর মুক্তিলাভের উপাখ্যানও তিনি তুলে এনেছেন এই উপন্যাসে। লেখক কাজী এনায়েত উল্লাহর প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে বিশ্ব প্রবাস, ভালোবাসার রূপান্তর, সময়ের প্রেক্ষিতে, নিরুদ্দেশ, লিভিং ওয়ার্ল্ড, প্রত্যাশা প্রভৃতি। এবার বইমেলায় মধ্যরাতে পায়ের আওয়াজ বইটি প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ।
অঞ্জন আচার্যের ইতিহাসধর্মী গল্পগ্রন্থ ‘সাদা রাত’ : অমর একুশে বইমেলা ২০২৫-এ প্রকাশ হয়েছে কবি ও গল্পকার অঞ্জন আচার্যের ইতিহাসধর্মী গল্পগ্রন্থ ‘সাদা রাত’। বইটিতে খন্দকার মোশতাক, সিরাজ সিকদার, সর্বহারা পার্টি, রক্ষীবাহিনী, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, বাকশাল, তাজউদ্দীন আহমদ, খালেদ মোশাররফ, কর্নেল তাহের, জেলহত্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন বহুল আলোচিত ১০ ব্যক্তি বা ঘটনা অবলম্বনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১০টি গল্প।
বইটি সম্পর্কে লেখক অঞ্জন আচার্য বলেন, এই সময়কে ধরে এর আগে কোনো সিরিজ গল্প লেখা হয়েছে বলে জানা নেই। কারো প্রতি পক্ষপাতী হয়ে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে-মিশিয়ে লেখা নয়, কিংবা সত্যকে আড়াল করে কেবল চাটুকারিতা নয়। অন্যদিকে প্রতিপক্ষের ভূমিকায় নেমে একপেশে নিন্দামন্দ নয়, বরং সত্যকে সৎসাহসের সঙ্গে বলার লক্ষ্যে দেশের ইতিহাস ও সাধারণ মানুষের প্রতি দায় থেকেই এই বই লেখা। এটি নিছক কোনো গল্পের বই নয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের এমন এক আবছায়া-অন্ধকারময় সময়ে আলো ফেলা হয়েছে, সেই আলোয় অনেকের চোখেই অনেক কিছু ধরা পড়বে, পড়বেই।
গতকাল বুধবার অমর একুশে বইমেলার ২৬-তম দিনে নতুন বই এসেছে ১৬৬টি। এদিন বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জুলাই প্রজন্ম ও প্রযুক্তি : নতুন সামাজিক বন্দোবস্তের খোঁজে’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সামিনা লুৎফা নিত্রা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কল্লোল মোস্তফা এবং এহ্সান মাহমুদ। সভাপতিত্ব করেন ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলাদেশের তরুণেরা চব্বিশের জুলাই থেকে তাদের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, সংগ্রাম এবং রাজপথে রক্ত ঢেলে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তারা অসাধারণ চিন্তাশীল, প্রতিশ্রুতিশীল এবং উপলব্ধিশীল প্রজন্ম যারা তাদের আশেপাশের বিশ্ব সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন। এই প্রজন্ম যে ঝুঁকিপূর্ণ ভবিষ্যতের মুখোমুখি হচ্ছে, সেই ভবিষ্যতের সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য তারা প্রস্তুত। এই প্রজন্মের তরুণেরা জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। ফলে প্রযুক্তির সঙ্গে এদের সম্পর্ক অনেক গভীর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শহুরে মধ্যবিত্ত তরুণদের সঙ্গে সব অঞ্চলের শিক্ষিত বা নিরক্ষর তরুণদের এক অভূতপূর্ব যোগাযোগের সেতু নির্মিত হয় যা জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে।
আলোচকদ্বয় বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সবচেয়ে অগ্রগামী সৈনিক ছিলেন নতুন প্রজন্মের তরুণেরা। ফ্যাসিবাদী শক্তির পতনের পর দেশের বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে দেশ গঠনের কাজে এগিয়ে এসেছেন তারা। ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই প্রযুক্তিনির্ভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার দারুণ সম্ভাবনা ও সুযোগ করে দিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার ওপর ভিত্তি করে নতুন সামাজিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রযুক্তিকে যথাযথাভাবে ব্যবহার করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম আমাদেরকে যে নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনা উপহার দিয়েছেন তা জনপরিসরে সংহত করতে হবে। এই সংহতি তখনই টেকসই হবে যখন আমরা একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক বন্দোবস্ত হাজির করতে পারব। এদিন লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেনÑশিশুসাহিত্যিক ফরিদ সাঈদ এবং কবি এবিএম সোহেল রশীদ।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান : কবিতা আবৃত্তি করেন কবি শ্যামল জাকারিয়া, মানব সুরত, এ বি এম সোহেল রশীদ, ইউসুফ রেজা, রোকন জহুর, জামিল জাহাঙ্গীর, ক্যামেলিয়া আহমেদ, আশিক আকবর, নুরতার পারভীন, জেসমিন বন্যা, সোহেল আমিন বাবু, রুহুল মাহবুব, মঈন মুরসালীন এবং শাহ সিদ্দিক। আজ ছিল মৌসুমী আক্তার সুমি’র পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘নৃত্যশৈলী’ এবং মো. জাকির চিশতি’র পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শান্তিধাম ভাবদর্শন চর্যা চর্চা কেন্দ্র’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী ইয়াসমিন মুশতারী, পুতুল দাস, এলবার্ট অনিমেষ দাস, শুক্লা ঘোষ, রুমী আজনবী, বিপুল কুমার, মৌমিতা হক সেঁজুতি, তমালিকা হালদার মলি, জান্নাত-ই-ফেরদৌসী এবং দিপু সমদ্দার। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন কাজী মো. ইমতিয়াজ সুলতান (তবলা), গাজী আবদুল হাকিম (বাঁশি), রবিনস্ চৌধুরী (কী-বোর্ড), ফিরোজ খান (সেতার), বিশ্বজিৎ সেন (মন্দিরা)।
আজকের অনুষ্ঠান : আজ বৃহস্পতিবার অমর একুশে বইমেলা ২৭ তম দিন। এদিন মেলা শুরু হবে বিকেল ৩ টায় এবং চলবে রাত ৯ টা পর্যন্ত। এদিন বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘বাংলাদেশ বিনির্মাণ : রাষ্ট্র কাঠামো’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন রেজাউল করিম রনি। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন সৈয়দ নিজার। এতে সভাপতিত্ব করবেন কাজী মারুফ।