
দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘরে হামলা-মামলা, লুপাট ও অগ্নিসংযোগ, ধানমন্ডি-৩২ এ ভাঙচুর, শেখ হাসিনাসহ নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে হরতালের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। তবে রাজধানীতে দু-একটি জায়গা ছাড়া কোথাও হরতালের সমর্থনে মিছিল-অবরোধ দেখা যায়নি। আগের নিয়মেই যথারীতি রাজধানীর রাজপথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাস-অটোরিকসা ও সিএনজিসহ সকল প্রকার যানবাহন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে অনেকেই বলছেন, আগে হরতালের ডাক দিয়ে মাঠে ছিল না জামায়াত-শিবির। তাদের মতো এখন হরতাল আহ্বান করে মাঠে নামতে পারেনি আওয়ামী লীগ। হারুনর রশীদ নামে একজন শিক্ষক বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা সময়ে জামায়াত-শিবির বিভিন্ন ইস্যুতে কর্মসূচি দিলে লুকোচুরির মাধ্যমে পালন করেছে। ঠিক একইভাবে আজকে আওয়ামী লীগকে কর্মসূচি পালন করতে হচ্ছে। একইকথা বলেছেন সিরাজুল ইসলাম নামে একজন ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ী। তিনি বলেন, রাজনীতি তো রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। তিনি আরও বলেন, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
লিটন আখতার নামে একজন চাকরিজীবী বলেন, আমাদের দেশে কেউ একবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে আর ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। এই মন মানুষিকতা থেকে যতদিন পর্যন্ত বেরিয়ে আসতে না পারবে, ততদিন ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর বাড়িঘরে হামলা-অগ্নিসংযোগ ঘটবে এবং ক্ষমতা হারালে কেউ শান্তিতে থাকতে পারবে না। তাই উদারতার রাজনীতি সবাইকে করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
কথা হয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নারায়নগঞ্জ জেলার আওয়ামী লীগের একজন স্থানীয় পর্যায়ের নেতার সঙ্গে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যারা দলকে অন্যায়-অপকর্ম করে ডুবিয়েছেন তারা তো দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তারা বিদেশে বসে বসে এখন হরতালের মতো কর্মসূচি দিচ্ছেন। এতে আমাদের ওপর ধরপাকড় আরও বেড়ে গেছে। আমরা এই কর্মসূচির কারণে নতুন করে বিপদে পড়েছি। তার মতে, আওয়ামী লীগের এখনই রাজপথের কর্মসূচি ঘোষণা সময় আসেনি। এর জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
এদিকে, রাজধানীতে হরতালের মতো কোনো লক্ষণ দেখা না গেলেও রাজধানীর বাইরে বেশ কয়েকটি জেলায় মশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়ে। একইসঙ্গে হরতাল ও মশাল মিছিলের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে স্থানীয় বিএনপি। শুধু তাই নয়, কারো কারো বাড়িঘরে আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দেয়া এবং ভাঙ্চুরের অভিযোগ উঠেছে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের মশাল মিছিল : সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘরে হামলা-মামলা, লুপাট ও অগ্নিসংযোগ, ধানমন্ডি-৩২ এ ভাঙচুর, শেখ হাসিনাসহ নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ডাকা হরতাল সফল করার লক্ষে রাজধানীতে মশাল মিছিল করেছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ। সোমরাব রাত সাড়ে ১১টায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাইনুদ্দিন রানা ও সাধারণ সম্পাদক এইচ এম রেজাউল করিম রেজার নির্দেশে বেশ কয়েকটি পয়েন্টে এ মশাল মিছিল করেছে ওয়ার্ড ও নগর যুবলীগ নেতারা। এদিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর ডেমরা স্টাফ কোয়াটার, নলছিটি-ডেমরাব্রীজ ও বড়ভাঙ্গা এলাকায় মিছিল করে ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগ। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শাসনামলকে ‘অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল’ অভিহিত করে ইউনূস সরকারের পদত্যাগের দাবি জানান যুবলীগ নেতারা।
ঢাকা মহানগর যুবলীগ নেতা সাজ্জাদ হোসেন সজীব বলেন, সুপরিকল্পিত চক্রান্তের মাধ্যমে ইউনূস গং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটায়। তারা বাঙালি জাতির স্বাধীনতার অন্যতম ধারক ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটিও গুড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ এর বিচার করবে একদিন। আমরা অনতিবিলম্বে অবৈধ দখলদার ইউনূস সরকারের পদত্যাগ দাবি করছি।
গোপালগঞ্জ : আওয়ামী লীগের কেন্দ্র ঘোষিত হরতাল ও মশাল মিছিলের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছে উপজেলা বিএনপি। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচীতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে টুঙ্গিপাড়া উপজেলা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জেলা জুড়ে নেয়া হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় করা মশাল মিছিলের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ডুমুরিয়ার ও গোপালপুরে মশাল মিছিল বের করে। মিছিলটিকে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করতেও দেখা যায়। এ সময় নেতাকর্মীরা মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বঙ্গবন্ধু ভবন ধানমন্ডি-৩২ ভাঙচুর, দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘরে হামলা, লুপাট ও অগ্নিসংযোগ, শেখ হাসিনাসহ নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও হরতালের সমর্থনে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন শ্লোগান দেয়।
একইরাতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র ঘোষিত হরতাল ও মশাল মিছিলের প্রতিবাদে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে উপজেলা বিএনপি। রাতে টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতীর টুঙ্গিপাড়া মাল্টিপারপাস পৌর সুপার মার্কেট চত্ত্বর থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মিছিলটি উপজেলা শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে একই স্থানে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তারা আওয়ামী লীগের ডাকা হরতাল প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্র ঘোষিত মশাল মিছিলকে প্রতিহত করা হবে। সেই সঙ্গে গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির সমাবেশ সফলভাবে শেষ করা হবে। তবে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে টুঙ্গিপাড়া উপজেলা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জেলা জুড়ে নেয়া হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মোড়ে মোড়ে টহল দিচ্ছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে টুঙ্গিপাড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জানান, আওয়ামী লীগ মশাল মিছিল করেছে বিষয়টি আমরা শুনেছি। তারা উপজেলার সীমান্ত এলাকায় মিছিল করেছে বলে জেনেছি। সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়েছে।
বগুড়ায় মশাল মিছিলের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে হামলা : বগুড়ার ধুনট উপজেলায় মঙ্গলবারের হরতালের সমর্থনে মশাল মিছিল করেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। মিছিলের পরপরই আওয়ামী লীগের তিনজনের বাড়ি ও দোকানে হামলা হয়। সোমবার রাত ৯টার দিকে ধুনট উপজেলা সদরের বাজার এলাকা প্রদক্ষিণ করে মিছিল শেষ হতে না হতেই আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে আওয়ামী নেতাকর্মীদের ধাওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীরা পিছু হটে তিন জায়গায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, হরতালের সমর্থনে মশাল মিছিল করে আসার পর বিএনপির নেতাকর্মীরা তাদের তিন নেতার বাড়িঘর ও দোকানে হামলা চালায়। পরে আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রতিরোধে তারা পিছু হটে। তবে হামলা-ভাঙচুরের কথা অস্বীকার করেছেন ধুনট পৌর বিএনপির সভাপতি আলীমুদ্দীন হারুন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ মশাল মিছিল করার সময় জনতা তাদের প্রতিহত করে। কারও বাড়িতে কোনো হামলা হয়নি।
ধুনট থানার ওসি মো. সাইদুল আলম বলেন, হরতালের সমর্থনে আওয়ামী লীগের লোকজন মশাল মিছিল করার চেষ্টা করেছিল। পরে পুলিশের ধাওয়ায় তারা পালিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলার কোনো খবর আমার কাছে নেই। এখন পরিস্থিতি শান্ত।
উল্লেখ্য, গত ২৮ জানুয়ারি রাতে আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পদত্যাগ ও “অপশাসন-নির্যাতনের” প্রতিবাদে ১৬ ফেব্রুয়ারি ও ১৮ ফেব্রুয়ারি হরতালের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ।
ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, গত ১ ফেব্রুয়ারি শনিবার থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দাবির লিফলেট বা প্রচারপত্র বিলি করেছে আওয়ামী লীগ। ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। ১০ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি অবরোধ, মঙ্গলবার ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল কর্মসূচি পালন করছে দলটি।