
বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলার ১৬তম দিনে পাঠক ও দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। এদিন সববয়সী মানুষ, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনায় এসেছে ‘বইমেলায় স্যানিটারি ন্যাপকিনেও আপত্তি’। রীতিমতো বইমেলায় কেন ‘গোপন পণ্য’ বিক্রি করা হচ্ছে, সে নিয়ে আপত্তির ভিত্তিতে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান প্রদর্শনী ও বিক্রি বন্ধ করে অন্য কোনো পণ্য সেখানে উপস্থিত করতে প্রাণ-আরএফএলকে চিঠি দিয়েছে মেলা আয়োজক কর্তৃপক্ষ। তবে এ বিষয়টি নিয়ে এরইমধ্যে হুলুস্থুল শুরু হয়েছে।
গতকাল রোববার বইমেলার ১৬তম দিনে নতুন বই এসেছে নতুন বই এসেছে ১০৪টি। বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানা যায়, অমর একুশে বইমেলার ১৬তম দিনে নতুন গল্প এসেছে-১৪টি, উপন্যাস-৬টি, প্রবন্ধ-৫টি, কবিতা-৩৫টি, গবেষণা-৪টি, ছড়া-৩টি, শিশুসাহিত্য-৩টি, জীবনী-৪টি, ইতিহাস-৫টি এবং অন্যান্য-২৫টি।
বইমেলার একাধিক স্টল ঘুরে জানা যায়, গতকাল রোববার ফাল্গুন মাসের তৃতীয় দিনে বই বিক্রি কম হয়েছে। বিক্রেতাদের দাবি শুক্রবার ক্রেতাদের থেকে দর্শকের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। শুক্র ও শনিবারের তুলনায় রোববার বিক্রি কম হয়েছে বলে জানান বিক্রেতারা।
বিক্রেতাদের মতে, বইমেলায় দিন যত পার হচ্ছে ক্রেতাদের আনাগোনা তত বাড়ছে। প্রথম দিকের বইমেলায় ক্রেতার থেকে দর্শনার্থীদের সংখ্যাই বেশি থাকে। যার ফলে ভিড় বেশি হয় কিন্তু বই কম বিক্রি হয়। তবে শেষের দিকে মূল ক্রেতারা আসেন এজন্য শেষ দিকে বিক্রিও ভালো হয়।
আকাশ প্রকাশনীর জিয়াউল হাসান বলেন, বই বিক্রি বেড়েছে। কালও আশানুরূপ বিক্রিই হয়েছে। গতবারের মত এবারও আমাদের গোয়েন্দা সিরিজের বইগুলো বেশি চলছে। এবার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে ইফতেখার আমিনের অনুবাদ করা বই মোসাদ।
কথাপ্রকাশ প্রকাশনীর বর্ষন বলেন, এবার আশানুরূপ বিক্রি হয়নি। ধীরে বই বিক্রি বাড়ছে। এ বছর আমাদের মাহরীন ফেরদৌসের লেখা জলজ লকার ও সৈয়দ জাকির হোসেনের লেখা বোধগম্যতার গহীনে বইটি ভালো বিক্রি হচ্ছে।
আলোচনা অনুষ্ঠান: রোববার বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় “জহির রায়হানের সাহিত্যকর্মে ঐতিহাসিক ঘটনার বিচার” শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সহুল আহমদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মশিউল আলম এবং আহমাদ মোস্তফা কামাল। সভাপতিত্ব করেন মাহবুব হাসান।
প্রাবন্ধিক বলেন, জহির রায়হান একাত্তরের বৈপ্লবিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই উত্তাল সময়ে তিনি বহুমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। একদিকে তিনি ঘটনার জন্ম দিচ্ছিলেন, অন্যদিকে ঘটনার বিবরণ বা বয়ান তৈরির কাজে লিপ্ত ছিলেন। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বাসিন্দাদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে জেনোসাইড শুরু করেছিল, তার প্রতিবাদেই তিনি নির্মাণ করেছিলেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ নামে প্রামাণ্যচিত্র। জহির রায়হান একাত্তরের ঘটনাপ্রবাহকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছিলেন। তিনি বিবেচনা করেছিলেন, তামাম দুনিয়াতে যে ধরনের আন্দোলন চলছে একাত্তর তারই অংশ।
আলোচকদ্বয় বলেন, জহির রায়হান ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্য নির্মাতা, ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং প্রবন্ধকার। বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র জগতে তিনি তার অমিত প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তার সৃষ্টিকর্মে রাজনৈতিক আন্দোলন ও শোষণের কথা যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে বাংলার মধ্যবিত্ত জীবন ও দৈনন্দিন বাস্তবতার কথা। তিনি শোষণ-বঞ্চনাহীন একটি স্বদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন এবং সে লক্ষ্যেই আজীবন কাজ করে গেছেন।
সভাপতির বক্তব্যে মাহবুব হাসান বলেন, বিপুল সম্ভাবনা ও বিপুল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন জহির রায়হান। তার সকল কাজের মধ্য দিয়ে জনগণের আকাক্সক্ষাই প্রতিফলিত হয়েছে। তার সৃজনকর্ম গভীরভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা নানাভাবে লাভবান হতে পারি।
এদিন লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেনÑ কবি ও গবেষক সুমন সাজ্জাদ এবং শিশুসাহিত্যিক শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী আজহারুল ইসলাম রনি এবং ডা. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। আজ ছিল মো. আবুজার গিফারী’র পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শিল্পতরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং মোবাস শিরীন মোস্তফার পরিচালনায় ‘বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী দেবিকা রানী পাল, জাহিন খান নেজাম, আনিলা আমীর লামী, সুমন চন্দ্র দাস, মো. টিপু চৌধুরী, মিতালী সরকার এবং ডালিয়া সুলতানা। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন স্বপন কুমার দাস (তবলা), আনোয়ার সাহদাত রবিন (কী-বোর্ড), মো. শহিদুল ইসলাম (বাঁশি) এবং সুমন কুমার সাহা (অক্টোপ্যাড)।
আজকের অনুষ্ঠান: আজ সোমবার অমর একুশে বইমেলার ১৭তম দিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩ টায় এবং চলবে রাত ৯ টায় পর্যন্ত। এদিন বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘জীবন ও কর্ম : আল মাহমুদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মজিদ মাহমুদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন মুসা আল হাফিজ এবং কাজী নাসির মামুন। এতে সভাপতিত্ব করবেন মাহবুব সাদিক।
বইমেলায় স্যানিটারি ন্যাপকিনেও আপত্তি: নারীদের প্রয়োজন ও সচেতনতা বৃদ্ধির কথা ভেবে একটি কর্নারে প্রাণ- আরএফএল গ্রুপের স্বাস্থ্য সুরক্ষা পণ্য ব্র্যান্ড ‘স্টে-সেফ’ স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রদর্শন করা হয়। বইমেলায় কেন ‘গোপন পণ্য’ বিক্রি করা হচ্ছে, সে নিয়ে আপত্তির ভিত্তিতে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান প্রদর্শনী ও বিক্রি বন্ধ করে অন্য কোনও পণ্য সেখানে উপস্থিত করতে প্রাণ-আরএফএলকে চিঠি দেয়। এর ভিত্তিতে গতকাল রোববার প্রতিষ্ঠানটি মেলা থেকে তাদের পণ্যটি তুলে নেয়। বাংলা একাডেমি বলছে, ‘বই ছাড়া অন্যকিছু বিক্রির সুযোগ বইমেলায় নেই বিধায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে’, তবে চিঠির বিষয়ে তারা কিছু জানে না। আর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে-বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই তারা চিঠি দিয়েছে। আর ‘স্টে-সেফ’ নামে পণ্যের বিষয়ে এর উৎপাদক প্রতিষ্ঠান থেকে জানানো হয়-‘মেলায় এটি বিক্রি করা হচ্ছিল, এমন নয়। এটি ফ্রি দেয়া হচ্ছিল।
গতকাল রোববার ফেসবুকে চিঠিটি ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার ঝড় ওঠে। চিঠিতে লেখা আছে, প্রাণ- আরএফএল গ্রুপের নারী ও শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষা পণ্য ব্র্যান্ড ‘স্টে-সেইফ’ বইমেলা প্রাঙ্গণে দুটি স্টল পরিচালনা করছে। ১১ ফেব্রুয়ারির পর কয়েক দফায় ন্যাপকিনকে গোপন পণ্য বলে আখ্যা দিয়ে এর প্রকাশ্য প্রদর্শনী বা বিক্রি বন্ধে দাবি ওঠে। পরপর কয়েকদিন অনেক মানুষ দলগতভাবে এসে এই দাবি জানিয়ে যায়। বাংলা একাডেমি, পুলিশ, আনসারসহ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ভলান্টিয়ারদের সহযোগিতায় পরিস্থিতি ঠান্ডা করা হয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি স্টল দুটি খুলে দিলে কিছু গ্রুপ সরাসরি বাংলা একাডেমিতে অভিযোগ করে। এসব কারণে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে চিঠিটি দেয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এবং প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ব্যবসায়িক স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে ‘স্টল দুটি অন্য পণ্য (যেমন শিশু শিক্ষা সরঞ্জাম) দিয়ে প্রতিস্থাপনের অনুমতি দেয়া যেতে পারে’ বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
প্রাণ-আরএফএল প্রতিষ্ঠানটির অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার তৌহিদুজ্জমান বলেন, আমরা চিঠিটি পেয়েছি। এটাকে কেন্দ্র করে কোনও ইস্যু হোক, তা আমরা চাই না। যেহেতু আপত্তি উঠেছে, সেহেতু আজকের মধ্যে আমরা ‘স্টে সেফ’ কর্নার সরিয়ে ফেলছি। তবে এই পণ্য আমরা সেখানে বিক্রি করতাম না, ফ্রি স্যাম্পলিং করতাম। অনেক নারী মেলায় আসে, তাদের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে এটা করা হয়েছিল, এখন আমরা কুইট করছি। কিছু মানুষের দাবির ভিত্তিতে ন্যাপকিনের স্টল বন্ধের বিষয়ে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব সরকার আমিনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বইমেলায় ডাইপার বা অন্যান্য পণ্য বিক্রি করা যাবে। এটাতো আর বাণিজ্য মেলা না। এটা নিয়ে আমরা স্পন্সরকে বলেছি, আপনারা স্পন্সর করেছেন, ভালো। কিন্তু এসব পণ্য বিক্রি করা যাবে না। বই ছাড়া অন্যান্য পণ্য বিক্রির নীতিমালা নেই। চিঠির ব্যাপারে কিছু জানি না। পণ্য সরিয়ে ফেলতে বলে প্রাণ-আরএফএলকে লেখা ভাইরাল হওয়া চিঠিটিতে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের স্বাক্ষরকারী পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী রাকিব হাসান রাজ বলেন, কী থাকবে বা কী থাকবে না সেটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আমরা কেউ না। আমরা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আছি। একাডেমি কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে চিঠি ইস্যু করতে বলেছে, আমরা করেছি। নারী অধিকারকর্মী মারজিয়া প্রভা বলেন, মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ ১০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু বলতে পারি-মাসিক সংক্রান্ত নানাবিধ ট্যাবু এখানে ভেঙেছে। মেয়েরা সচেতন হয়েছে এবং সুস্থভাবে মাসিক ব্যবস্থাপনা শিখেছে। সরকারি এবং বেসরকারি/এনজিও স্বাস্থ্যকর্মীরা কমিউনিটিতে প্রতিনিয়ত এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রচারণা করছে বলেই মাসিক সুরক্ষা নিয়ে মেয়েরা সচেতন। মেয়েরা আগে ফার্মেসি থেকে প্যাড কিনতে লজ্জা পেতো। এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্যাড বিক্রি বেড়েছে। স্কুলে প্যাডের ব্যবস্থা থাকছে। তাই কমিউনিটিতে স্যানিটারি প্যাড নিয়ে যে ট্যাবু কাজ করতো, তা এখন সেই অর্থে নেই। নিজেদের প্রয়োজনেই এই ট্যাবু ভেঙেছে। তাহলে কাদের কাছে এই জিনিস নিষিদ্ধ লাগে? এই প্রশ্নটা আমার সবার প্রথমে মাথায় এসেছে। বাংলা একাডেমি আজকে তার এই অনুমতিপত্রের মাধ্যমে স্যানিটারি প্যাড নিষিদ্ধতার মতো সমাজে অস্বাভাবিক বিষয়টি বৈধতা দান করেছে। তারা নিজেরাও এটাকে নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত করে মাসিক বিষয়টিকে আবার ট্যাবুর জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, তাদের এই নতজানু নীতি একটি সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে এরকম নানাবিধ স্বাভাবিক বিষয়কে ‘নিষিদ্ধ’ করার পক্ষে সমর্থনের ভূমিকা পালন করছে।
গতকাল রোববার বইমেলার ১৬তম দিনে নতুন বই এসেছে নতুন বই এসেছে ১০৪টি। বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানা যায়, অমর একুশে বইমেলার ১৬তম দিনে নতুন গল্প এসেছে-১৪টি, উপন্যাস-৬টি, প্রবন্ধ-৫টি, কবিতা-৩৫টি, গবেষণা-৪টি, ছড়া-৩টি, শিশুসাহিত্য-৩টি, জীবনী-৪টি, ইতিহাস-৫টি এবং অন্যান্য-২৫টি।
বইমেলার একাধিক স্টল ঘুরে জানা যায়, গতকাল রোববার ফাল্গুন মাসের তৃতীয় দিনে বই বিক্রি কম হয়েছে। বিক্রেতাদের দাবি শুক্রবার ক্রেতাদের থেকে দর্শকের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। শুক্র ও শনিবারের তুলনায় রোববার বিক্রি কম হয়েছে বলে জানান বিক্রেতারা।
বিক্রেতাদের মতে, বইমেলায় দিন যত পার হচ্ছে ক্রেতাদের আনাগোনা তত বাড়ছে। প্রথম দিকের বইমেলায় ক্রেতার থেকে দর্শনার্থীদের সংখ্যাই বেশি থাকে। যার ফলে ভিড় বেশি হয় কিন্তু বই কম বিক্রি হয়। তবে শেষের দিকে মূল ক্রেতারা আসেন এজন্য শেষ দিকে বিক্রিও ভালো হয়।
আকাশ প্রকাশনীর জিয়াউল হাসান বলেন, বই বিক্রি বেড়েছে। কালও আশানুরূপ বিক্রিই হয়েছে। গতবারের মত এবারও আমাদের গোয়েন্দা সিরিজের বইগুলো বেশি চলছে। এবার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে ইফতেখার আমিনের অনুবাদ করা বই মোসাদ।
কথাপ্রকাশ প্রকাশনীর বর্ষন বলেন, এবার আশানুরূপ বিক্রি হয়নি। ধীরে বই বিক্রি বাড়ছে। এ বছর আমাদের মাহরীন ফেরদৌসের লেখা জলজ লকার ও সৈয়দ জাকির হোসেনের লেখা বোধগম্যতার গহীনে বইটি ভালো বিক্রি হচ্ছে।
আলোচনা অনুষ্ঠান: রোববার বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় “জহির রায়হানের সাহিত্যকর্মে ঐতিহাসিক ঘটনার বিচার” শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সহুল আহমদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মশিউল আলম এবং আহমাদ মোস্তফা কামাল। সভাপতিত্ব করেন মাহবুব হাসান।
প্রাবন্ধিক বলেন, জহির রায়হান একাত্তরের বৈপ্লবিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই উত্তাল সময়ে তিনি বহুমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। একদিকে তিনি ঘটনার জন্ম দিচ্ছিলেন, অন্যদিকে ঘটনার বিবরণ বা বয়ান তৈরির কাজে লিপ্ত ছিলেন। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বাসিন্দাদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে জেনোসাইড শুরু করেছিল, তার প্রতিবাদেই তিনি নির্মাণ করেছিলেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ নামে প্রামাণ্যচিত্র। জহির রায়হান একাত্তরের ঘটনাপ্রবাহকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছিলেন। তিনি বিবেচনা করেছিলেন, তামাম দুনিয়াতে যে ধরনের আন্দোলন চলছে একাত্তর তারই অংশ।
আলোচকদ্বয় বলেন, জহির রায়হান ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্য নির্মাতা, ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং প্রবন্ধকার। বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র জগতে তিনি তার অমিত প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তার সৃষ্টিকর্মে রাজনৈতিক আন্দোলন ও শোষণের কথা যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে বাংলার মধ্যবিত্ত জীবন ও দৈনন্দিন বাস্তবতার কথা। তিনি শোষণ-বঞ্চনাহীন একটি স্বদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন এবং সে লক্ষ্যেই আজীবন কাজ করে গেছেন।
সভাপতির বক্তব্যে মাহবুব হাসান বলেন, বিপুল সম্ভাবনা ও বিপুল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন জহির রায়হান। তার সকল কাজের মধ্য দিয়ে জনগণের আকাক্সক্ষাই প্রতিফলিত হয়েছে। তার সৃজনকর্ম গভীরভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা নানাভাবে লাভবান হতে পারি।
এদিন লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেনÑ কবি ও গবেষক সুমন সাজ্জাদ এবং শিশুসাহিত্যিক শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী আজহারুল ইসলাম রনি এবং ডা. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। আজ ছিল মো. আবুজার গিফারী’র পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শিল্পতরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং মোবাস শিরীন মোস্তফার পরিচালনায় ‘বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী দেবিকা রানী পাল, জাহিন খান নেজাম, আনিলা আমীর লামী, সুমন চন্দ্র দাস, মো. টিপু চৌধুরী, মিতালী সরকার এবং ডালিয়া সুলতানা। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন স্বপন কুমার দাস (তবলা), আনোয়ার সাহদাত রবিন (কী-বোর্ড), মো. শহিদুল ইসলাম (বাঁশি) এবং সুমন কুমার সাহা (অক্টোপ্যাড)।
আজকের অনুষ্ঠান: আজ সোমবার অমর একুশে বইমেলার ১৭তম দিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩ টায় এবং চলবে রাত ৯ টায় পর্যন্ত। এদিন বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘জীবন ও কর্ম : আল মাহমুদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মজিদ মাহমুদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন মুসা আল হাফিজ এবং কাজী নাসির মামুন। এতে সভাপতিত্ব করবেন মাহবুব সাদিক।
বইমেলায় স্যানিটারি ন্যাপকিনেও আপত্তি: নারীদের প্রয়োজন ও সচেতনতা বৃদ্ধির কথা ভেবে একটি কর্নারে প্রাণ- আরএফএল গ্রুপের স্বাস্থ্য সুরক্ষা পণ্য ব্র্যান্ড ‘স্টে-সেফ’ স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রদর্শন করা হয়। বইমেলায় কেন ‘গোপন পণ্য’ বিক্রি করা হচ্ছে, সে নিয়ে আপত্তির ভিত্তিতে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান প্রদর্শনী ও বিক্রি বন্ধ করে অন্য কোনও পণ্য সেখানে উপস্থিত করতে প্রাণ-আরএফএলকে চিঠি দেয়। এর ভিত্তিতে গতকাল রোববার প্রতিষ্ঠানটি মেলা থেকে তাদের পণ্যটি তুলে নেয়। বাংলা একাডেমি বলছে, ‘বই ছাড়া অন্যকিছু বিক্রির সুযোগ বইমেলায় নেই বিধায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে’, তবে চিঠির বিষয়ে তারা কিছু জানে না। আর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে-বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই তারা চিঠি দিয়েছে। আর ‘স্টে-সেফ’ নামে পণ্যের বিষয়ে এর উৎপাদক প্রতিষ্ঠান থেকে জানানো হয়-‘মেলায় এটি বিক্রি করা হচ্ছিল, এমন নয়। এটি ফ্রি দেয়া হচ্ছিল।
গতকাল রোববার ফেসবুকে চিঠিটি ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার ঝড় ওঠে। চিঠিতে লেখা আছে, প্রাণ- আরএফএল গ্রুপের নারী ও শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষা পণ্য ব্র্যান্ড ‘স্টে-সেইফ’ বইমেলা প্রাঙ্গণে দুটি স্টল পরিচালনা করছে। ১১ ফেব্রুয়ারির পর কয়েক দফায় ন্যাপকিনকে গোপন পণ্য বলে আখ্যা দিয়ে এর প্রকাশ্য প্রদর্শনী বা বিক্রি বন্ধে দাবি ওঠে। পরপর কয়েকদিন অনেক মানুষ দলগতভাবে এসে এই দাবি জানিয়ে যায়। বাংলা একাডেমি, পুলিশ, আনসারসহ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ভলান্টিয়ারদের সহযোগিতায় পরিস্থিতি ঠান্ডা করা হয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি স্টল দুটি খুলে দিলে কিছু গ্রুপ সরাসরি বাংলা একাডেমিতে অভিযোগ করে। এসব কারণে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে চিঠিটি দেয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এবং প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ব্যবসায়িক স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে ‘স্টল দুটি অন্য পণ্য (যেমন শিশু শিক্ষা সরঞ্জাম) দিয়ে প্রতিস্থাপনের অনুমতি দেয়া যেতে পারে’ বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
প্রাণ-আরএফএল প্রতিষ্ঠানটির অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার তৌহিদুজ্জমান বলেন, আমরা চিঠিটি পেয়েছি। এটাকে কেন্দ্র করে কোনও ইস্যু হোক, তা আমরা চাই না। যেহেতু আপত্তি উঠেছে, সেহেতু আজকের মধ্যে আমরা ‘স্টে সেফ’ কর্নার সরিয়ে ফেলছি। তবে এই পণ্য আমরা সেখানে বিক্রি করতাম না, ফ্রি স্যাম্পলিং করতাম। অনেক নারী মেলায় আসে, তাদের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে এটা করা হয়েছিল, এখন আমরা কুইট করছি। কিছু মানুষের দাবির ভিত্তিতে ন্যাপকিনের স্টল বন্ধের বিষয়ে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব সরকার আমিনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বইমেলায় ডাইপার বা অন্যান্য পণ্য বিক্রি করা যাবে। এটাতো আর বাণিজ্য মেলা না। এটা নিয়ে আমরা স্পন্সরকে বলেছি, আপনারা স্পন্সর করেছেন, ভালো। কিন্তু এসব পণ্য বিক্রি করা যাবে না। বই ছাড়া অন্যান্য পণ্য বিক্রির নীতিমালা নেই। চিঠির ব্যাপারে কিছু জানি না। পণ্য সরিয়ে ফেলতে বলে প্রাণ-আরএফএলকে লেখা ভাইরাল হওয়া চিঠিটিতে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের স্বাক্ষরকারী পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী রাকিব হাসান রাজ বলেন, কী থাকবে বা কী থাকবে না সেটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আমরা কেউ না। আমরা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আছি। একাডেমি কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে চিঠি ইস্যু করতে বলেছে, আমরা করেছি। নারী অধিকারকর্মী মারজিয়া প্রভা বলেন, মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ ১০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু বলতে পারি-মাসিক সংক্রান্ত নানাবিধ ট্যাবু এখানে ভেঙেছে। মেয়েরা সচেতন হয়েছে এবং সুস্থভাবে মাসিক ব্যবস্থাপনা শিখেছে। সরকারি এবং বেসরকারি/এনজিও স্বাস্থ্যকর্মীরা কমিউনিটিতে প্রতিনিয়ত এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রচারণা করছে বলেই মাসিক সুরক্ষা নিয়ে মেয়েরা সচেতন। মেয়েরা আগে ফার্মেসি থেকে প্যাড কিনতে লজ্জা পেতো। এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্যাড বিক্রি বেড়েছে। স্কুলে প্যাডের ব্যবস্থা থাকছে। তাই কমিউনিটিতে স্যানিটারি প্যাড নিয়ে যে ট্যাবু কাজ করতো, তা এখন সেই অর্থে নেই। নিজেদের প্রয়োজনেই এই ট্যাবু ভেঙেছে। তাহলে কাদের কাছে এই জিনিস নিষিদ্ধ লাগে? এই প্রশ্নটা আমার সবার প্রথমে মাথায় এসেছে। বাংলা একাডেমি আজকে তার এই অনুমতিপত্রের মাধ্যমে স্যানিটারি প্যাড নিষিদ্ধতার মতো সমাজে অস্বাভাবিক বিষয়টি বৈধতা দান করেছে। তারা নিজেরাও এটাকে নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত করে মাসিক বিষয়টিকে আবার ট্যাবুর জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, তাদের এই নতজানু নীতি একটি সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে এরকম নানাবিধ স্বাভাবিক বিষয়কে ‘নিষিদ্ধ’ করার পক্ষে সমর্থনের ভূমিকা পালন করছে।