
দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। বাংলাদেশ থেকে বিশে^র বিভিন্ন দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু রপ্তানির বিপরীতে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশে আসছে না। ওই অর্থ দেশে এলে কিছুটা হলেও সহনীয় হতো ডলার সংকট। অথচ পোশাক রপ্তানি করে অর্থ না পাওয়ায় এখন অনেক পোশাক রপ্তারিকারক লোকসানে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। যদিও রপ্তানি চালানের টাকা ফেরত না এলে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিদেশি বায়ারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বিদেশে দূতাবাসগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে মামলা করলেও অসাধু বায়ার কিংবা রপ্তানিকারক শিপিং লাইন ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্সের অবৈধ কাজ বন্ধ করা সম্ভব। তৈরি পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশ থেকে তৈরি রপ্তানির প্রক্রিয়ায় শিপিং এজেন্ট ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররাসহ নানা প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকে। অনেক সময় রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ক্রেতাদের সরাসরি যোগাযোগ হয় না। মাঝখানে বায়িং এজেন্ট মধ্যস্থতা করে। রপ্তানি পণ্য বুঝে নিয়ে জাহাজ কোম্পানিগুলো গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়। আর ডেলিভারি এজেন্ট হিসেবে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার আমদানিকারকের হাতে সে পণ্য তুলে দেয়। সেক্ষেত্রে আমদানিকারককে পণ্য ডেলিভারি নেওয়ার আগে ব্যাংকে রপ্তানি পণ্যের মূল্য পরিশোধসহ সব প্রক্রিয়া শেষ করে শিপিং এজেন্টকে মূল বিল অব এক্সপোর্ট (রপ্তানি বিল) কপি জমা দিতে হয়। আইন অনুযায়ী সব কাগজ বুঝে নিয়ে শিপিং এজেন্ট ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারের পণ্য ডেলিভারি দেয়ার দায়িত্ব। অনেক সময় মূল রপ্তানি বিল ও ব্যাংকের কাগজপত্র ছাড়াই কপি দিয়ে পণ্য ডেলিভারি নিয়ে নিচ্ছে। অথচ ওই ক্রেতা ব্যাংকে টাকা পরিশোধ করেনি। সেজন্য ক্রেতা, শিপিং কোম্পানি ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের যোগসাজশকে দায়ী।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে চার লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেও মূল্য পায়নি চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান মেলো ফ্যাশন। আমেরিকার বায়ার ব্যাংক ডকুমেন্ট দাঁড় না করালেও শিপিং কোম্পানি ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স কর্তৃক ব্যাংক ডকুমেন্ট ছাড়াই বায়ারকে পণ্য সরবরাহ করা হয়। সেজন্য টাকা না পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম আদালতে শিপিং কোম্পানি ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্সের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করলে আদালত পুলিশ বুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দেয়। তদন্ত শেষে শিপিং কোম্পানি ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্সকে দায়ী করে যোগসাজশে পণ্য খালাস নেয় বলে পিবিআই আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। তাছঅঢ়অ অনেক বছর ধরে এমন জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও ২০২১ সালে বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। ওই বছরের ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, তৈরি পোশাক খাতের ৩০ হাজার চালানের বিপরীতে কোনো অর্থই দেশে আসেনি। বিষয়টি তদন্ত করতে কাস্টমকে চিঠি দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কাস্টম হাউসগুলো তদন্ত শুরু করলেও একসময় বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। চার বছর পর ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বিষয়টি নিয়ে আবারো তাগাদা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপর একের পর এক উঠে আসে জালিয়াতির বিষয়।
সূত্র আরো জানায়, জালিয়াতির কারণে ২০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ পোশাক রপ্তানি মূল্য দেশে আসেনি। ওই অর্থ উদ্ধারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল মামলার সাধারণ অনুমতি চেয়ে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট এবং শিপিং কোম্পানী কর্তৃক বিদেশে ব্যাংক ডকুমেন্ট ছাড়া রপ্তানি চালান ডেলিভারির কারণে দেশের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ফেরত আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করা হয়। গত ১৯৭৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার রপ্তানি চালানের বিপরীতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা দেশে আসেনি। যদিও সরকারের রপ্তানি গাইডলাইন অনুযায়ী পণ্য রপ্তানির ছয় মাসের মধ্যে রপ্তানিমূল্য দেশে ফেরত আসার কথা। ওই সময়ের মধ্যে পণ্যমূল্য ফেরত না এলে এবং কম এলে ব্যাংকে ওভার ডিউজ হিসেবে পরিগণিত হবে। আবার অনেক সময় রপ্তানিমূল্যের ডিসকাউন্ট করা হলে কম মূল্য ফেরত আসে। সে ক্ষেত্রে বায়ারকে দেয়া ডিসকাউন্ট বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কমিটিকে অবহিত করে অনুমোদন নিতে হয়। সামপ্রতিক বছরগুলোতে শিপিং লাইনস ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স কর্তৃক আমেরিকা কিংবা সংশ্লিষ্ট দেশের ব্যাংকের ডকুমেন্ট ছাড়াই বায়ারকে পণ্য ডেলিভারি দিয়ে দেয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বায়ার বাংলাদেশের রপ্তানিকারক কর্তৃক তার ব্যাংকে পাঠানো ডকুমেন্ট ছাড় না করে স্থানীয় ফরোয়ার্ডার্স ও শিপিং লাইনের সঙ্গে যোগসাজশ করে পণ্য ডেলিভারি নিয়ে নেয়। কারণ ব্যাংক থেকে ডকুমেন্ট ছাড় করতে পণ্যের সব মূল্য পরিশোধ করতে হয়। তাতে বিদেশি ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকে পণ্যের মূল্য আসে না। বিদেশি ব্যাংক নির্দিষ্ট সময়ে বায়ার ডকুমেন্ট ক্লিয়ার না করলে তা ফেরত পাঠিয়ে দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা হচ্ছে না। ফলে রপ্তানিকারকরা বারবার হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হচ্ছে।
এদিকে শিপিং কম্পানিগুলো এমন ঘটনার দায় নিতে নারাজ । তাদের দাবি, ক্যারিয়ার হিসেবে তারা শুধু পণ্যটি বায়ারদের কাছে পৌঁছে দেয়। এ ঘটনায় উল্টো রপ্তানিকারক, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার ও বায়িং এজেন্টের বিরুদ্ধে মামলা করেছে শিপিং কম্পানি।
অন্যদিকে প্রতারিত হওয়া প্রতিষ্ঠান মেলো ফ্যাশনের পরিচালক সাইফুল্লাহ মনসুর জানান, বিষয়টি নিয়ে গত বছরের জুন মাসে ত্রিপক্ষীয় সালিস করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। স্থগিত হয় অভিযুক্ত ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার রেজর ফ্রেইট সার্ভিসের লাইসেন্স। ওই সময় তিন মাসের মধ্যে রপ্তানির টাকা ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় রেজর ফ্রেইট। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুসারে অর্থ না পাওয়ায় আদালতে মামলা করলে আদালত পিবিআইকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেন। পিবিআই গত ১ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। তারা আইনের বাইরে গিয়ে কাগজপত্র ছাড়া পণ্য বায়ারকে হ্যান্ডওভার করেছে। এখন তারা তাদের দোষ স্বীকার না করে উল্টো প্রতারণার মামলা করছে। বিষয়টি নিয়ে বিজিএমআই ও মেট্রোপলিটন চেম্বারের সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে। দেশের টাকা এভাবে বিদেশি প্রতারকরা লুটে নিয়ে বিপুলসংখ্যক গার্মেন্ট মালিককে পথে বসিয়ে দিয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, বিজিএমইএ, কাস্টম, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ জরুরি।