
আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি
ইতিহাস ও ঐতিহ্য বলতে গেলে আমতলীর হলদিয়ার টেপুরা গ্রামের অবস্থিত সেই আলোচিত গাজি কালুর আসনকেও বলা যেতে পারে। আমতলী উপজেলায় হলদিয়ার টেপুরায় গাজি কালু নামে সুরক্ষিত অবস্থায় থাকায় যেন মাজারের দৃশ্যপটে প্রাচীন ঐতিহ্যের সাথে গেথে যাচ্ছে এর রূপরেখা। এ মাজারটি আস্তে আস্তে করে প্রাচীন রূপরেখায় পরিণত হচ্ছে। এতে প্রতি বছর ২৯ মাঘ ও ২৯ ফাল্গুন ওরশ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার ২ দিনব্যাপী আমতলীর হলদিয়ার টেপুরায় লাখ লাখ মানুষরা সমবেত হয়ে এতে গাজি কালুর আসনের ভক্তরা যে যার মতো করে চালিয়ে যাচ্ছে এ শোকমেলা। এ শোকের মাতম উল্লাস করে বিভিন্ন জায়গায় মিলাদ দোয়া, হামদ, নাথ পালন করে যাচ্ছে গাজি কালুর ভক্তবৃন্দরা।
শত বছর আগে আজিজ ফকির ও মালেক ফকির নামে গাজী কালুর দুজন ভক্ত জনমানবহীন স্থানে এই দরবার শরীফ স্থাপন করেন। আর তখন থেকেই এখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের আনাগোনা হতে থাকে। তখন এই জায়গার নাম ছিল সুন্দরবন, পরে কালক্রমে এখানে মানুষের বসতি গড়ে ওঠে। এখানে রয়েছে গাজী ও কালুর পৃথক দুটি আসন, মনসার ঘর, হযরত খিজির (আ.)-এর পানির কূপ এবং বারো আউলিয়ার আসন।
এ বিষয় ভক্ত ও এলাকা সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় বাসিন্দা মো. মকবুল ও জলিল নামে আজিজ ফকির এবং মালেক ফকিরের দুজন উত্তরসূরি বলেন, শত বছর আগে বরিশালের মালেক ফকির ও বরগুনার পাথরঘাটার আজিজ ফকিরকে স্বপ্নে দেখা দেন গাজী কালু। পরে আমাদের দুই ফকির এখানে এসে দরবার স্থাপন করেন। এরপর থেকেই গাজী কালুর ভক্ত আশেকানরা এখানে আসতে থাকেন। প্রাচীন লোকগাঁথা থেকে জানা যায়, বৈরাট নগরের বাদশাহ সিকান্দারের পুত্রের নাম ছিল গাজী। কালু ছিল বাদশাহর পালকপুত্রের নাম। গাজীর ক্ষমতা ও সিংহাসনের প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিল না। তাই সব কিছু ত্যাগ করে কালুকে সঙ্গে নিয়ে ফকির বেশে সুন্দরবনে চলে যান। সেখানে আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় বনের পশুকে বশ করেন। পরে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে ব্রাহ্মণনগরে উপস্থিত হলে রাজকন্যা চম্পাবতীকে দেখে মুগ্ধ হন। কালুর মাধ্যমে রাজার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে রাজা কালুকে বন্দি করেন। ফলে গাজীর সঙ্গে রাজার যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে গাজীর পক্ষে অসংখ্য বাঘ ও পরী এবং রাজার পক্ষে কুমির, হাতি অংশগ্রহণ করে। এ যুদ্ধে রাজা পরাজিত হন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। পরে চম্পাবতীর সঙ্গে গাজীর বিয়ে হয়। এসবের পাশাপাশি কিছু উপকাহিনীও রয়েছে এতে। ভক্ত আশেকানদের বিশ্বাস গাজী কালুর অলৌকিক সব ক্ষমতা ছিল। তাই তারা এই দুই পীরের সান্নিধ্যে আসতে প্রার্থনা ও মনবাসনা পূরণে তাদের দরবারে মানত করে থাকেন। এতে দোকান নিয়ে আসা মো. আলাল উদ্দীন বলেন, প্রতি বছরই দোকানদারি করি। দরবারে আসা মানুষজনই আমাদের ক্রেতা। সরকার যদি এই দরবারটির আরও অবকাঠামো উন্নত করতো তাহলে এখানে আরও মানুষ আসতো। বেচাকেনাও ভালো হতো।
গাজী কালুর মাজারে আসা ডিএম আলমাস ও মোজাম্মেল হক বলেন, আমরা বহু বছর ধরে এখানে আসি। প্রতিবছর এখানে গান বাজনাসহ নানান দোকানপাট আসে এগুলো আমাদের মনের খোরাক মেটায়। মাজারের খাদেম আবদুল গনী খান বলেন, এখানে গাজীর আসন, কালুর আসন, মা মনসার ঘর, হযরত খিজির (আ.)-এর কূপ ও মসজিদ মাদ্রাসা আছে। মানতের টাকা দিয়েই এসব পরিচালিত হয়। প্রতিবছর দুইবার এখানে বড় ওরস হয়। এছাড়াও প্রতি বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান হয়। এসব আয়োজন মানতের টাকা ও মালামাল দিয়েই চলে। সরকারি সহায়তা পেলে দরবারটি ভালোভাবে চালানো যেত।
আমতলী উপজেলার বিএনপির নেতা মশিউর রহমান আকন (মিলন) বলেন, আমতলী উপজেলা নয় বরগুনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের এক ঐতিহাসিক মাজার গাজি কালুর। সব ধর্মের কাছেই গাজী কালুর কাহিনী আলোচনায় থাকে। হলদিয়া ইউনিয়নের টেপুরা গ্রামে গাজী কালুর দরবার আছে। প্রতিদিন এখানে বহু লোকজন আসে। এটি শুধু আমতলীর নয়, গোটা জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান।