
সারা দেশে আয়নাঘরের সংখ্যা ৭০০ থেকে ৮০০ হতে পারে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, গত সরকার (আওয়ামী লীগ সরকার) সবক্ষেত্রে আইয়ামে জাহেলিয়া প্রতিষ্ঠা করে গেছে। আয়নাঘর তার একটা নমুনা। তিনি বলেন, যে খুপরির মধ্যে তাদের (বন্দিদের) রাখা হয়েছে, গ্রামের মুরগির খাঁচাও এর চেয়ে বড় হয়। তাদের মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে। মানুষ হিসেবে সামান্য মানবিক অধিকার থেকেও তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। গতকাল বুধবার আয়নাঘর (আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিরোধী মতের বহু মানুষকে তুলে নিয়ে বিচারবহির্ভূতভাবে যেখানে আটক রাখা হতো) পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
এর আগে এদিন সকাল সাড়ে ১০টায় দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকর্মী এবং ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আয়নাঘর পরিদর্শনে যান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি আগারগাঁও, কচুক্ষেত ও উত্তরার তিনটি আয়নাঘর পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে দুপুরে রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বিস্তারিত তুলে ধরেন। আয়নাঘর পরিদর্শনকালে প্রধান উপদেষ্টা যা বলেন তা পড়ে শোনান প্রেস সচিব।
আয়নাঘর পরিদর্শনকালে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটা আমাদের সবার অপরাধ যে এটা (আয়নাঘর) আমরা হতে দিয়েছি। যারা করেছে তারা আমাদেরই সন্তান, ভাই, আত্মীয়। সমাজকে নিপীড়নের এই চূড়ান্ত রূপ থেকে বের করে না আনতে পারলে এই সমাজ টিকে থাকবে না। তিনি বলেন, যা দেখেছি তা বর্ণনা করার মতো নয়। এটা অবর্ণনীয়। বর্ণনা যদি করতে হয় তাহলে বলতে হয় এটা বীভৎস দৃশ্য। মানুষের মনুষত্ববোধ বলে কোনো কিছু আছে এ দৃশ্য সে বোধ থেকে বহু দূরে। যা-ই হয়েছে এখানে, যে কয়জন গুমের বর্ণনা দিয়েছেন সেগুলো অবিশ্বাস্য, নৃশংস অত্যাচার। যতটাই শুনি অবিশ্বাস্য লাগে। বিনা দোষে তাদের তুলে এনে যে অত্যাচার করা হয়েছে এটাই কি আমাদের সমাজ? এই সমাজ আমরা গড়লাম!
শফিকুল আলম বলেছেন, গুম কমিশনের প্রতিবেদন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর তদন্তের ওপর ভিত্তিতে ধারণা করা যায়, সারা দেশে ৭০০-৮০০ আয়নাঘর আছে এবং এটা আরও বের হচ্ছে। তাতে বোঝা যাচ্ছে যে এটি শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না, প্রত্যন্ত অঞ্চলে এরকম আয়নাঘর ছিল। হিউম্যান রাইট ওয়াচের প্রতিবেদনে স্পষ্ট লেখা আছে- গুম ও খুনের সঙ্গে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা জড়িত ছিল, তার নির্দেশেই এগুলো হয়েছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, কিছুদিন আগে রিপোর্ট হয়েছিল যে, আয়নাঘর পরিদর্শন হচ্ছে না। কিন্তু আপনারা দেখেছেন যে, ঢাকার কয়েকটি আয়নাঘর ভিজিট হয়েছে। বাংলাদেশে যত আয়নাঘর আছে, প্রত্যেকটা খুঁজে বের করা হবে।
তিনটি লোকেশনের ‘আয়নাঘর’ পরিদর্শন করা হয়েছে জানিয়ে প্রেস সচিব বলেন, তার মধ্যে দু’টো র্যাবের আর একটি ডিজিএফআইয়ের। সেখানে কীভাবে রাখা হতো, নির্যাতন করা হতো, কীভাবে সিন কাটিয়েছেন, কেউ কেউ সেখানে ৭-৮ বছর কাটিয়েছেন, তার বর্ণনা আসলে প্রকাশ করার মতো না। এই পরিদর্শনে এগুলো প্রকাশ পায়। প্রধান উপদেষ্টা প্রতিটা স্পটে গিয়েছেন। সেখানে যারা বন্দি ছিলেন, তারা তাদের সঙ্গে হওয়া ঘটনাগুলো প্রধান উপদেষ্টাকে বর্ণনা করেন। আমরা সেখানে সবাইকে নিতে পারিনি, এজন্য আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। আমরা বিটিভির মাধ্যমে সবগুলো ভিডিও করেছি। আমাদের সঙ্গে শুধু দু’টি মিডিয়া আউটলেট ছিল। এক প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, আমরা যে জায়গাগুলো গেলাম, সেই জায়গাগুলো খুবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রুম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে ইট ভেঙে প্যাসেজ তৈরি করা হয়েছে। পুরো বিষয়টা আসলে লজিস্টিক্যাল সাপোর্টের। আমাদের আইডিয়া ছিল, আমরা বিটিভি থেকে দু’জন ক্যামেরাম্যান নিয়েছি, পিআইডি থেকে একজন ফটোগ্রাফার নিয়েছি। আমাদের নিজস্ব প্রেস উইংয়ের একজন ফটোগ্রাফার ছিলেন। এছাড়া আমরা বিদেশি গণমাধ্যম থেকে নিয়েছি আলজাজিরা ও নেত্র নিউজকে। আয়নাঘরের বিষয়ে নেত্র নিউজের যথেষ্ট অবদান আছে। তারা এটা নিয়ে প্রতিবেদন করেছিল, তাই তাদের নিয়েছি। একজন সাংবাদিকও ছিলেন। এর বাইরে আমরা নিতে পারিনি। আসলে লজিস্টিক্যালি খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। প্রেস সচিব বলেন, যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারের ওয়ারেন্ট আছে, সে বিষয়ে গুম কমিশন কাজ করছে। আপনারা যত সময় এগুলোর রেজাল্ট পাবেন।
আয়নাঘরের আলামত নষ্ট করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আলামত নষ্ট করা হয়েছে কি হয়েছে না সেটা গুম কমিশন দেখছে। যে কেসগুলো হচ্ছে সেগুলো ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটিউররাও সেগুলো দেখছেন। প্রত্যেকটা ‘আয়নাঘর’ এভিডেন্স হিসেবে সিলগালা করা থাকবে। কারণ, আমাদের লিগ্যাল প্রসেসে এগুলো লাগবে। গুম কমিশন বলবেন, আদৌ নষ্ট হয়েছে কি হয়নি। কিছু কিছু জায়গা দেখেছি যে, প্লাস্টার করা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় রুম ছোট ছিল দেওয়াল ভেঙে বড় দেখানো হয়েছে। এটা ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত, সেটা গুম কমিশন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তারা বিচার করবেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের যারা গুম-খুন-হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, সবার বিচার হবে। এটাই স্পষ্ট।
উল্লেখ্য, ১৯ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে একটি বৈঠক করেছে। সে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে গুমের ঘটনায় তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানানো হয়। গুম করে বন্দিদের যেখানে রাখা হতো তা জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল বা আয়নাঘর নামে পরিচিত। কমিশনের সদস্যদের আহ্বানেই সেসব স্থাপনা পরিদর্শনে গেছেন অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান।
অভিযোগ রয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকালে ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০৫ জনকে গোপনে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। অন্য আরেকটি তথ্যে বলা হয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৪৪ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় ৪০ জনকে। আর ৬৬ জনকে সরকারি হেফাজতে গ্রেফতার অবস্থায় পাওয়া গেছে।