
দেশজুড়ে চলমান অপারেশন ডেভিল হান্টে গতকাল রোববার ১৩০৮ জন গ্রেফতার হয়েছেন। গত শনিবার থেকে শুরু হয়েছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। এখন পর্যন্ত সারাদেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’সহ পুলিশের বিভিন্ন অভিযানে গতকাল রোববার দুপুর পর্যন্ত মোট এক হাজার ৩০৮ জনকে গ্রেফতার হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদরদফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর। এর মধ্যে গাজীপুর জেলায় ১২৫ জন, নোয়াখালীতে সাতজন, খাগড়াছড়িতে চার জন ও গোপালগঞ্জে চার জন, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে এক, শ্রীপুরে ১০ জন রংপুর বিভাগে ১৯ জনসহ মোট ১৩০৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থক। দেশজুড়ে চলমান অপারেশন ডেভিল হান্ট এর অংশ হিসেবে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
জানা গেছে, গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। গতকাল রোববার দুপুরে গাজীপুর সদর থানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গাজীপুর জেলা শাখার আহ্বায়ক আব্দুল্লাহ মোহিত বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় ২৩৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় প্রধান আসামি আমজাদ মোল্লা; এলাকায় তিনি আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে পরিচিত। ওই ঘটনার পর গাজীপুর নগরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩৪ জনকে আটক করে পুলিশ। পরে ওই মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। গাজীপুর সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সিদ্দিক হোসেন গতকাল রোববার বিকেল পৌনে চারটায় এসব তথ্য জানিয়েছেন।
মামলার এজাহার ও থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত শুক্রবার রাতে গাজীপুর নগরের ধীরাশ্রম দক্ষিণখান এলাকায় সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ওই খবর শুনে গাজীপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলেনের নেতারা হামলা প্রতিহত করতে যান। এ সময় স্থানীয় মসজিদের মাইকে ‘মন্ত্রীর বাড়িতে ডাকাত পড়েছে’ ঘোষণা দিয়ে লোকজনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। এরপর একদল লোক এসে বাড়িটি ঘিরে ফেলেন এবং শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে মারধর শুরু করেন। এতে অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ-উত্তর) রিয়াজ উদ্দিন বলেন, গাজীপুর মহানগরের ৮টি থানা এলাকায় গতকাল রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১২৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৩৪ জনকে মহানগরীর ধীরাশ্রম এলাকায় সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হকের পৈতৃক বাড়িতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়। তিনি বলেন, অপারেশন ডেভিল হান্ট চলমান রয়েছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও র্যাবসহ যৌথ বাহিনীর সদস্যরা অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনা করেছে।
গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার ড. চৌধুরী মো. যাবের সাদেক জানান, গাজীপুরে অপারেশন ডেভিল হান্ট এর আওতায় অভিযান চলমান রয়েছে। গত শনিবার থেকে শুরু হওয়া অপারেশন ডেভিল হান্টে গতকাল রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১২৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদেরকে কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া, জয়দেবপুর, শ্রীপুর ও কালিয়াকৈর থানা এলাকায় যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা বিভিন্নভাবে ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজন। এ অভিযান জেলার সর্বত্র চলমান রয়েছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান বলেন, যারা জনগণকে ঘুমাতে দিবেনা, দেশকে শান্তিতে থাকতে দিবে না বলে হুমকি দেয়-আমরা তাদেরকে চিহ্নিত করছি, অবশ্যই তাদেরকে আইনের আওতায় আনবো। গাজীপুরে ছাত্রদের উপর হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত সদর থানায় দুইটি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে একটি হয়েছে ধীরাশ্রম এলাকায় ছাত্রদের উপর হামলার ঘটনায় এবং অপরটি হয়েছে শহরের রাজবাড়ি সড়কে ছাত্রদেরকে গুলি করার ঘটনায়। আমরা আশা করছি যারা জনগণকে অশান্ত করবে, যারা জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, যারা জনগণকে ঘুমাতে দিবেনা বলে ঘোষণা দিয়েছে, তাদের প্রত্যেককে আমরা আইনের আওতায় আনবো।
অপরদিকে, রংপুর মহানগরীতে পাঁচ এবং বিভাগে ১৪ জনকে গ্রেফতার করেছে যৌথ বাহিনী। গত শনিবার দিবাগত মধ্যরাত থেকে গতকাল রোববার ভোর ছয়টা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মজিদ আলী জানান, গতরাত ১২টা থেকে শুরু হওয়া অপারেশন ডেভিল হান্টে মহানগরীর তাজহাটে দুই এবং কোতোয়ালি, হারাগাছ ও মাহিগঞ্জ থানা এলাকা থেকে একজন করে গ্রেফতার করা হয়েছে।
রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি আমিনুল ইসলাম জানান, রেঞ্জের আওতাধীন আট জেলার মধ্যে কুড়িগ্রামে ছয়, দিনাজপুরে তিন, ঠাকুরগাঁও দুই এবং গাইবান্ধা, পঞ্চগড় ও লালমনিরহাট থেকে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত রাতে রংপুর এবং নীলফামারী জেলা থেকে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। বিভাগের রেঞ্জ ডিআইজি জানান, গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা, হত্যা, হত্যাচেষ্টাসহ নাশকতা, পরিকল্পনা এবং অর্থযোগান দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এরা সবাই আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। তাদের নামে মামলা রয়েছে। গত শনিবার মধ্যরাত ১২টা থেকে একযোগে রংপুর মহানগরসহ রেঞ্জের আট জেলায় অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু করে যৌথ বাহিনী।
অপরদিকে ‘ডেভিল হান্ট’ অভিযানে খাগড়াছড়ির গুইমারায় নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের চার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে গুইমারার বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে গুইমারা থানা পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন-গুইমারার বড়পিলাক গ্রামের বাবুল মিজির ছেলে সোহাগ মিয়া, অহিদ মিয়ার ছেলে মো. সেলিম, মোফাজ্জল হোসেনের ছেলে আব্দুর রহিম ও আব্বাস আলীর ছেলে মো. আজিজুল। গ্রেফতারদের মধ্যে সোহাগ মিয়া গুইমারার হাফছড়ি ইউনিয়নের ছয় নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি এবং অন্যরা নিষিদ্ধ সক্রিয় কর্মী। তাদের বিরুদ্ধে গুইমারা থানায় মামলা রয়েছে।
এদিকে অপারেশন ডেভিল হান্টের প্রথম দিনে নোয়াখালী হাতিয়ায় যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ সাতজনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, হাতিয়া উপজেলার চরঈশ্বর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আজাদ (৬৪), হাতিয়া পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের বেলাল উদ্দিনের ছেলে সাদ্দাম হোসেন (২৬), ৩নং ওয়ার্ডের মৃত আব্দুস শহিদের ছেলে আবুল কালাম বিটু (৪৪), নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের আদর্শগ্রামের আলাউদ্দিনের ছেলে আজিম উদ্দিন (৩১), তমরুদ্দি ইউনিয়নের মহিন উদ্দিনের ছেলে সিরাজুল ইসলাম প্রকাশ রাকছান (২৪), হাজী আব্দুল কাইয়ুমের ছেলে আবদুল মাজেদ পলাশ (৪৩) ও আব্দুল জাহের (৩৯)।
হাতিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম আজমল হুদা বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ ঘোষণার পর হাতিয়া থানায় এটি প্রথম অভিযান ছিল। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। একইসঙ্গে নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, নৌ পুলিশ ও পুলিশের যৌথ অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
অপারেশন ডেভিল হান্টের অংশ হিসেবে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা কাজী ওবায়দুল কাদের হেলালকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত শনিবার মধ্যরাতে উপজেলার কুর্শি ইউনিয়নের কল্যাণপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত কাজী ওবায়দুল কাদের হেলাল নবীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
গোপালগঞ্জে যৌথ বাহিনীর ডেভিল হান্ট অপারেশনে পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
স্বরাষ্ট্রসচিব নাসিমুল গনি বলেছেন, যারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে, অপারেশন ‘ডেভিল হান্ট এর মাধ্যমে তাদের গ্রেফতার করা হবে। এই অভিযানে চাঁদাবাজ, মাদক কারবারী নয়, যারা অস্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত, তাদের ধরা হবে। পরিস্থিতি যতক্ষণ পর্যন্ত না স্বাভাবিক হবে, তত দিন এই অভিযান পরিচালিত হবে।
উল্লেখ্য, ইংরেজি শব্দ ডেভিল অর্থ শয়তান আর হান্ট অর্থ শিকার। ফলে ডেভিল হান্ট-এর অর্থ দাঁড়ায় শয়তান শিকার করা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত ডেভিল হান্ট বলতে দেশবিরোধী চক্র, সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের বোঝানো হয়েছে।