মিলন খন্দকার, গাইবান্ধা
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সাবেক উপসহকারী প্রকৌশলী মতিয়ার রহমানের উপাস্থাপন করা ভুয়া কাগজপত্রে সরকারি অর্পিত সম্পত্তি (ভিপি) তার নামে লিজ প্রদানের ব্যবস্থা করার দায়ে অভিযুক্ত ভুমি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দীর্ঘ চার মাসেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেননি জেলা প্রশাসক চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ। ভূমি আপিল বোর্ডের নির্দেশ বাস্তবায়ন না করে উল্টো সেই ভূমি কর্মকর্তাকে রেখেছেন বহালতবিয়তে। শুধু তাই নয়, মতিয়ার রহমানের নামে লিজ বাতিল করে ইমরান হোসেন মীমকে নালিশী জমি বুঝিয়ে দেয়ারও আদেশ দেয় ভূমি আপিল বোর্ড। কিন্তু এখনও জমি বুঝিয়ে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ও তার স্বজনরা।
ভূমি আপিল বোর্ডে দায়ের করা মামলার নথিপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, গাইবান্ধা সদর উপজেলার গোবিন্দপুর মৌজার এসএ ৮৩৪ নম্বর খতিয়ানের ২০৭ নম্বর দাগে ৩৪ শতক জমির মধ্য ১২ শতক জমি গত ২০০১ সালের ২৯ এপ্রিল ০১/২০০০-০১ নম্বর ভিপি কেসমুলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) গাইবান্ধা কর্তৃক নালিশী সম্পত্তি তফের উদ্দিনের নামে লিজ প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ৫ এপ্রিল তফের উদ্দিন মারা গেলে তার স্ত্রী আমেনা খাতুন নিজ নামে লিজের নাম পরিবর্তনের জন্য আবেদন দাখিল করেন। পরে ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর বাংলা ১৪১১ সন হতে ১৪১৪ সনের লিজমানি পরিশোধের জন্য আবেদন করেন।
কিন্তু কোনো প্রকার নাম পরিবর্তন বা লিজ নবায়নের আদেশ না পাওয়ায় লিজ মানি পরিশোধ করতে পারেননি আমেনা খাতুন। এরই ফাঁকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) রংপুরের সাবেক উপসহকারী প্রকৌশলী প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক মতিয়ার রহমান নিজেকে ভূমিহীন বানিয়ে ওয়ারিশ নন এমন ব্যক্তিবর্গের নাম ও স্বাক্ষর করে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানের সহযোগিতায় অবৈধভাবে একটি দখল হস্তান্তরপত্র প্রস্তুতপূর্বক মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সুকৌশলে তার নিজ নামে তফের উদ্দিনের নামে থাকা লিজের নাম পরিবর্তন করেন। এর আগে গত ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট দফতরে অবৈধভাবে নাম পরিবর্তনের আবেদন করেন এবং ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর অবৈধ দখল হস্তান্তর পত্রটি ১৫০ টাকার স্ট্যাম্পে প্রস্তুুত করেন মতিয়ার রহমান। পরে মতিয়ার রহমান তফের উদ্দিনের ওয়ারিশ নয় এমন ব্যক্তিবর্গের স্বাক্ষর নিয়ে হস্তান্তরপত্র তৈরি করে মূল লিজ গ্রহীতা তফের উদ্দিনের নামে কোনো প্রকার লিজ বাতিলের নোটিশ জারি না করেই বিনা নোটিশে গত ২০১৫ সালের ১৭ নভেম্বর ২১৮ নম্বর স্মারকে বাংলা ১৪১৪ হতে ১৪২২ সন পর্যন্ত লিজমানি আদায় সাপেক্ষে জেএল নং ৯৯ ও ৮৩৪ নম্বর খতিয়ানের ২০৭ নম্বর দাগের ৯ শতক জমি অবৈধভাবে মতিয়ার রহমানের নামে লিজ প্রদান করা হয়। এই ঘটনায় মৃত তফের উদ্দিনের ওয়ারিশগন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ করে পাননি প্রতিকার। এভাবেই কেটে যায় ৭ বছর। পরে গত ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। সেই প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, তফের উদ্দিনের ওয়ারিশগণের স্বাক্ষর জ্বাল ও ভুয়া কাগজপত্র উপাস্থাপন করে নালিশী ৯ শতক জমি মতিয়ার রহমান তার নিজ নামে নাম পরিবর্তনসহ নবায়ন করেন, যা আইনত অপরাধ। তাই প্রতিপক্ষ মতিয়ার রহমানের নামীয় লিজ বাতিল করে মূল লিজ গ্রহীতা তফের উদ্দিনের ওয়ারিশগণের নামে নাম পরিবর্তনসহ নবায়ন করা যায় বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। পরবর্তীতে তফের উদ্দিনের ওয়ারিশগণের নামে লিজ প্রদানের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় বাধ্য হয়ে তারা মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন দায়ের করেন। যার নম্বর ৫৮৬৯/২০২২। উক্ত রিট মামলায় রুল জারি করা হয়। পরে গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)-এর আদালতে ১৩/২০২১-২০২২ নম্বর মিস মামলার সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে রাজস্ব আদালতের বিচারক রবিউল হাসান মনগড়াভাবে মৃত তফের উদ্দিনের ওয়ারিশগণের বিপক্ষে আদেশ প্রদান করেন। তখন তফের উদ্দিনের ওয়ারিশগণ রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব)-এর আদালতে আপিল করেন। সেখানেও মামলার গভীরে প্রবেশ না করেই একই বিবেচনায় পূর্বের আদেশ বহাল রাখা হলে পরবর্তীতে তফের উদ্দিনের ওয়ারিশগণ ঢাকার ভূমি আপিল বোর্ডে আপিল করেন। যার নম্বর ২-৯৪/২০২৩ (ভিপি) আপিল গাইবান্ধা।
দীর্ঘ শুনানির পর উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে গত বছরের ১৪ আগস্ট ভূমি আপিল বোর্ডের ক অঞ্চলের সদস্য মো. সাইফুল্লাহ পান্না চূড়ান্ত আদেশ প্রদান করেন। সেই আদেশে ২ নং ক্রমিকে বলা হয়, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) রংপুর কর্তৃক ৩৮/২৩ নম্বর আপিল মামলায় গত ২০২৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখের প্রদত্ত আদেশ এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) গাইবান্ধা কর্তৃক প্রতিপক্ষের অনুকূলে প্রদত্ত লিজাদেশ বাতিল করা হলো। ৩ নং ক্রমিকে, গাইবান্ধার সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. রবিউল হাসানকে কারণ ব্যাখ্যার জন্য বিভাগীয় কমিশনার রংপুর ও জেলা প্রশাসক গাইবান্ধাকে বলা হলো। এছাড়া আদেশের ৪ নং ক্রমিকে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভাগীয় কমিশনার রংপুর ও জেলা প্রশাসক গাইবান্ধাকে নির্দেশ প্রদান করা হলো, সেই সাথে তফের উদ্দিনের নাতি ইমরান হোসেন মীমকে নালিশী জমির দখল বুঝিয়ে দিয়ে বকেয়া লিজমানি গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক গাইবান্ধাকে নির্দেশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখা হতে গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ৬২৭ নম্বর স্মারকে সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত একপত্রে বর্ণিত মামলার ৩ এবং ৪নং ক্রমিকের আদেশ বাস্তবায়নের জন্য গাইবান্ধার জেলা প্রশাসককে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়।
এদিকে প্রকৃত লিজি মৃত তফের উদ্দিনের নাতি ইমরান হোসেন মিম অভিযোগ করে বলেন, রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হলেও দীর্ঘ চার মাসেও দুর্নীতিবাজ ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, বরং তিনি বর্তমানে ফুলছড়ি উপজেলার বাগুড়িয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসে বহালতবিয়তে থেকে সরকারি বেতন-ভাতা উত্তোলন করাসহ আরো অনিয়ম- দুর্নীতির মহারাজ হয়ে উঠেছেন। এছাড়া এখন পর্যন্ত আমাকে নালিশী জমি দখল বুঝিয়ে দেয়া হয়নি, ফলে আমি পরিবার পরিজন নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছি। এ বিষয়ে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ কথা বলতে রাজি হননি।