মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বেশিরভাগ এলাকা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখলে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে নদীপথে সীমান্ত-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের প্রবাহ কমছে না। এরই মধ্যে সীমান্তে মাদক পাচার রোধে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে টহল জোরদার করেছে।
জানা যায়, কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের নাফনদের বিভিন্ন পয়েন্টে বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে বিশাল পরিমাণে ইয়াবা উদ্ধার করেছে বিজিবি। টেকনাফ বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আশিকুর রহমান জানিয়েছেন, মিয়ানমার জলসীমা থেকে কর্কশিট দিয়ে তৈরি ভেলায় মাদক নিয়ে নাফনদী সাঁতরে বাংলাদেশে মাদক পাচারকারীরা আসছে। মাদক পাচারকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা মাদকের পৃষ্ঠপোষকতায় মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির নাম বারবার উঠে আসে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ী, বিজিপির অধীনেই ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকের বেচা-বিক্রি হয়। রাখাইন অঞ্চলের বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকাগুলো এখন যুদ্ধকবলিত হয়ে পড়ার সুযোগে ইয়াবাসহ মাদক পাচার চলছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মির পৃষ্ঠপোষকতায়। মাদক পাচারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বর্তমানে আরাকান আর্মি রাখাইনের মংডু টাউনশিপ দখলে নিয়েছে, যার ফলে সীমান্ত-বাণিজ্য বন্ধ। তবে, অভিযোগ উঠেছে যে, আরাকান আর্মির সদস্যরাও এখন মাদক ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ইয়াবার সবচেয়ে বড় চালান আসে শান রাজ্য থেকে। ইয়াবার পাশাপাশি ওই রাজ্যে একরকম বিনা বাধায় উৎপাদিত হচ্ছে ভয়ঙ্কর মাদক ক্রিস্টাল মেথ (আইস) ও হেরোইন। এতদিন বাংলাদেশে আইসের মতো মাদকের বিস্তৃতি না থাকলেও সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে প্রায়ই জব্দ হচ্ছে সিনথেটিক এ মাদকের চালান। গত বছরের নভেম্বরে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে ৫ কোটি টাকা মূল্যের ১ কেজি আইস জব্দ করে কোস্টগার্ড। তার আগে আগস্টে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অভিযানে টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত থেকে ২১ কোটি টাকা মূল্যের আইস ও ইয়াবার বড় চালান জব্দ হয়। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক সংস্থা ইউএনওডিসির প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের পর ২০২৪ সালেও আফিম উৎপাদনে শীর্ষ দেশ হিসেবে মিয়ানমারের নাম দেখা যায়। শান রাজ্যের পাহাড়ি ঢালে চাষ হয় পপি, যার আঞ্চলিক নাম পিস ফ্লাওয়ার বা শান্তির ফুল। এই পপি ফুল থেকেই নানা প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত হয় হেরোইন। হেরোইনের পাশাপাশি এই রাজ্যে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক ইয়াবা ও আইস কারখানা। মিয়ানমারে ইয়াবা তৈরির ৩৭টি কারখানার খোঁজ পাওয়া গেলেও গৃহযুদ্ধের সুযোগ কাজে লাগিয়ে গত কয়েক বছরে এই সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়েছে। ভৌগোলিকভাবে শান রাজ্যের সীমান্তবর্তী দেশ চীন, থাইল্যান্ড ও লাওস। ইয়াবা তৈরির প্রধান কাঁচামাল মেথামফেটামিন ও ক্যাফেইনের বড় জোগান আসে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলে অবস্থিত থাইল্যান্ড ও লাওস থেকে। এ ছাড়া আইস তৈরির আরেক কাঁচামাল এফিড্রিনের বড় সরবরাহক চীনের মাদক কারবারিরা। অনেক সময় ভারত থেকেও আসে কাঁচামালের চালান। সব মিলিয়ে প্রস্তুতকারক হিসেবে শান রাজ্যের কারখানাগুলোতে চলে মাদকের রমরমা উৎপাদন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে শান রাজ্যকে যুদ্ধবাজ নেতা, চোরাকারবারি এবং মাদকব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাদকের কেন্দ্রভূমি এ রাজ্যটিতে এতদিন সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে এবং নানা সময়ে স্থানীয়, এমনকি দেশটির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাদের উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করতেন মাদক কারবারিরা। তবে বর্তমানে সরাসরি বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মির পৃষ্ঠপোষকতায় উৎপন্ন হচ্ছে ভয়ঙ্কর এসব নেশাদ্রব্য। বর্তমানে মিয়ানমারের সরকার ব্যবস্থা একরকম ভেঙে পড়েছে। শান রাজ্যে একাধিক বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠনের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পর্যাপ্ত অর্থের প্রয়োজন। সশস্ত্রগোষ্ঠীর অর্থের মূল জোগান আসছে মাদক থেকে। মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশের বাজারে আসা এসব ইয়াবার চালান নিয়ন্ত্রণে রীতিমতো বেগ পেতে হচ্ছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে ইয়াবার প্রায় পুরো চালান আসে মিয়ানমার থেকে। টেকনাফ হয়ে তা দেশের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ইয়াবার সঙ্গে সঙ্গে কারবারিরা আইস ও হেরোইনের চালানও পাঠাচ্ছে। প্রতিনিয়ত এরা মাদক পাচারে অভিনব সব পন্থা ব্যবহার করছে। প্রতি মাসেই পরিবর্তন হচ্ছে মাদক পাচারের রুট। মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ইয়াবা ও আইসের জন্য রাজধানীতে আলাদা আলাদা হটস্পট আছে। ঢাকার রেল স্টেশন, বাস টার্মিনাল ও লঞ্চঘাট এলাকা ইয়াবার একেকটি বড় জোন। এর বাইরে মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প, মিরপুর কালশী, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা, কামরাঙ্গীরচর ও কাওরানবাজার এলাকায় ডজনখানেক সক্রিয় চক্র ইয়াবা কারবারের সঙ্গে জড়িত। আইসের দাম বেশি হওয়ায় অভিজাত এলাকাগুলোতে এর বিস্তার বেড়েছে। গুলশান, বনানী ও উত্তরার মতো এলাকায় বর্তমানে কয়েকটি চক্র আইস বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এদের অনেকেই নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে অনলাইন ক্রয়-বিক্রয়কে বেছে নিয়েছে। ইয়াবা ও গাঁজার আধিক্যে দেশে হেরোইনের ব্যবহার কমে গেছে। তবে অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আবারও নতুন করে হেরোইনের বিস্তার শুরু হয়েছে। বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে প্রতিনিয়ত কমবেশি হেরোইনের চালান দেশে প্রবেশ করছে বলে জানিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কর্মকর্তা। ইউএনওডিসির গবেষণা অনুযায়ী, একটি দেশে যে পরিমাণ মাদক প্রবেশ করে তার ৯০ শতাংশ বাজারে ছড়িয়ে পড়ে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোচরে আসে মাত্র ১০ শতাংশ। সেই হিসাবে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার হয়ে আসা মাদকে দিনকে দিন নেশাদ্রব্যের বড় হটস্পটে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারে আফিম চাষ বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি বাংলাদেশে হেরোইন প্রবেশের পরিমাণ বেড়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, আরাকান আর্মির সিন্ডিকেট করে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে মাদক পাচার করছে। সীমান্তে মাদক পাচার প্রতিরোধে বিজিবি সীমান্তে রাত-দিন টহল অব্যাহত রেখেছে।