দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ) প্রাতিনিধি
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বরইউড়ি দারুস সুন্নাত বহুমুখী আলিম মাদ্রাসায় নিজের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বিস্তার করেছিলেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সৈয়দ হোসেন কবির। প্রতিষ্ঠানের অর্থআত্মসাৎ, ভুয়া নিয়োগ এবং নিয়োগ বানিজ্যসহ একের পর এক বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন তিনি। প্রশাসনের তদন্তে দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরেও সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বরইউড়ি দারুস সুন্নাত বহুমুখী আলিম মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ পদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন সৈয়দ হোসেন কবির ও তাঁর মাধ্যমে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। এব্যাপারে একাধিকবার অভিযোগ দেওয়া হলেও কেবলমাত্র তদন্ত করেই দায় এড়ানো হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত অধ্যক্ষ সৈয়দ হোসেন কবির ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, বরইউড়ি দারুস সুন্নাত বহুমুখী আলিম মাদ্রাসায় ২০১৫ সালে চারজন প্রভাষককে নিয়োগ দেখিয়ে ২০২৪ সালে এমপিও করা হয়। তাঁরা হলেন আরবি প্রভাষক মাহবুবুর রহমান, বাংলা প্রভাষক মাহমুদুল হাসান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভাষক মুজিবুর রহমান ও ইংরেজি প্রভাষক আব্দুছ ছালাম। অথচ ২০১৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানে কোনো নিয়োগই হয়নি। এমনকি ২০২৪ সালের আগে এই চারজন প্রভাষক একদিনও মাদ্রাসায় পাঠদান করেননি এবং তাদেরকে এলাকার কেউ আগে কখনো দেখেওনি। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে এই চার প্রভাষক নিয়োগ দিয়েছেন অধ্যক্ষ সৈয়দ হোসেন কবির। এই চারজনের নিয়োগকে বৈধতা দিতে গিয়ে তিনি পত্রিকায় কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতারনার আশ্রয় নিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, নিয়োগ কমিটির নামেও প্রতারণা করা হয়েছেন। শিক্ষক নিয়োগের ফলাফল সিটে নিয়োগ পরীক্ষার সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় দেখানো হয়েছে ২০১৫ সালের ১৭ মে। নিয়োগ কমিটির স্বাক্ষরে কলাউরা দারুসসুন্নাত কাশেমিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে রফিকুল ইসলামের সাক্ষর দেখানো হয়েছে। অথচ এর দুইবছর আগে ২০১৩ সালে রফিকুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেছেন এবং ২০১২ সালে অধ্যক্ষ পদ থেকে তিনি অবসরে গেছেন। প্রশ্ন উঠেছে তাহলে মারা যাওয়ার পর ২০১৫ সালে শিক্ষক নিয়োগের ফলাফল সিটে কলাউরা দারুসসুন্নাত কাশেমিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে রফিকুল ইসলামের সাক্ষর আসলো কিভাবে ? এছাড়াও বরইউড়ি দারুস সুন্নাত বহুমুখী আলিম মাদ্রাসায় ২০২০ সালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়াটিও ছিলো ক্রটিপূর্ণ। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একজন যোগ্য প্রার্থীর সর্বনিন্ম বয়স ১৮ হতে হয়। কিন্তু এরচেয়েও কম বয়সী একজন প্রার্থীকে ওইসময় নিয়োগ দেওয়া হয়। এভাবেই প্রতারনা ও জালিয়াতির মাধ্যমে চারজন শিক্ষকসহ একজন কর্মচারী নিয়োগ দেন সৈয়দ হোসেন কবির। ২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর অধ্যক্ষ সৈয়দ হোসেন কবিরের দূর্নীতির নিয়ে তদন্ত করে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দেয় দোয়ারাবাজার উপজেলা প্রশাসন। যার স্মারক নং-০৫.৪৬.৯০৩৩.০০০.০৪.০০৮.২০. ৯৭৩। দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নেহের নিগার তনুর স্বাক্ষরিত ও সুপারিশকৃত ওই তদন্ত প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়, অধ্যক্ষ সৈয়দ হোসেন কবির মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে চারজন শিক্ষকসহ একজন কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি সরকারি নীতিমালা অনুসরণে কোনো কাজ করেননি। বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠানের টাকা ব্যাংকে না রেখে নিজের কাছে রেখেছেন। বিগত বছরের কোনো ব্যয়ের হিসাব দিতে পারেননি তিনি। মাদ্রাসার শিক্ষক কর্মচারিদের কাছ থেকে এমপিও করে দেওয়ার নামেও কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রিন্সিপাল সৈয়দ হোসেন কবির।
মাদ্রাসার গভর্নিংবডির সদস্য ও সহকারি মৌলভী মো. অহিদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় ২২ বছর ধরে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাওলানা সৈয়দ হোসেন কবির। কিন্তু এই ২২ বছরের মধ্যে মাদ্রাসার যতো আর্থিক লেনদেন ও আয় ব্যয় হয়েছে তার কোনো হিসাব তিনি দিতে পারেননি। মাদ্রাসায় উনার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি স্থানীয় এমপি ও আওয়ামীলীগ নেতাদের দাপট দেখাতেন । শিক্ষার্থীদের ভর্তি, বেতন, প্রশংসা পত্র, ফরম ফিলাপ, রেজিস্ট্রেশন ফি এবং টিউশন ফির সব টাকা প্রিন্সিপাল এবং কেরানি মুজিবুর রহমান মিলে আত্মসাৎ করেছেন। চলতি বছরের শিক্ষার্থী ভর্তির কোনো হিসাবও তিনি দিচ্ছেন না। প্রতিষ্ঠানের টাকা ব্যাংকে না রেখে নিজের কাছে রাখেন। নিজের ইচ্ছেমতো বিল ভাউচার বানাতেন। আমরা প্রতিবাদ করলে আমাদেরকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হতো।’ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল আজিজ বলেন, ‘প্রিন্সিপাল সৈয়দ হোসেন কবিরের বিভিন্ন অনিয়ম ও দূর্নীতির বিষয়ে পরপর তিনবার তদন্ত হয়েছে। তদন্তে তাঁর দূর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পর তাকে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকাবাসী। ছাত্রজনতার তোপের মুখে তিনি এখন আর প্রতিষ্ঠানে আসেন না। কলেজের গভর্নিংবডি ও ইউএনও মহোদয় আমাকে বিধি মোতাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়েছেন।’ মাদ্রাসার গভর্নিংবডির সাবেক সভাপতি হাসমত উল্লাহ বলেন, ‘আমি সভাপতি থাকাকালীন হঠ্যাৎ চারজন শিক্ষক তাদের বিল সই করানোর জন্য আমার কাছে আসে। আমি উনাদের কাউকেই চিনতাম না এবং এর আগে কখনো মাদ্রাসায় দেখিনি।