
* মোবাইল ফোনে চাঁদা দেয়ার তাগিদ দিচ্ছে সন্ত্রাসীরা
* সন্ত্রাসীদের প্রাণনাশের হুমকিতে আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা
রাজধানীর মিরপুর এলাকায় একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গত এক মাসে সন্ত্রাসীদের পৃথক ছয়টি গ্রুপ চাঁদা দাবি করে আসছেন। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ও মিরপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী মফিজুর রহমান মামুনের পরিচয় দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে ২০ লাখ টাকা করে চাঁদা দাবি করা হয়। তাদের নির্ধারিত টাকা দেয়া না হলে ওই প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। এতে করে তারা আতঙ্কিত। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরির্তনের পর স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের আমলে মিথ্যা মামলায় জেলে থাকা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও ছাড়া পান। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তারা ফের আন্ডারওয়ার্ল্ডে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। একইসঙ্গে পালিয়ে বিদেশ থাকা সন্ত্রাসীরাও সক্রিয় নড়েচড়ে বসেছেন। বিদেশ থেকে প্রতিনিয়ত ফোনে ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা চেয়ে হুমকি দিচ্ছেন।
তাদের মধ্যে পল্লবী থানা বিএনপির ৯১ নম্বর ওয়ার্ড (সাংগঠনিক ওয়ার্ড) কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পদে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন এখন মিরপুর এলাকার আতঙ্ক। এই বিএনপির নেতা পরিচয়ে মিরপুর এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। বিদেশি একটি নম্বর থেকে ব্যবসায়ীদের নিজে ফোন করে চাঁদা দাবি করছেন। আবার কারও কারও কাছে সহযোগীদের পাঠিয়ে চাঁদা দেয়ার তাগিদ দেয়া হচ্ছে।
এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে মামুনের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে এলাকায় গোপনে সক্রিয় মাসুদ। মূলত ইয়াবা ব্যবসার দেখভাল করছে মাসুদ। ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে তার অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করে কিবরিয়া, মাইজ্যা দুলাল, মিরপুর-১২ নম্বরের বালুর মাঠ এলাকার তানিম মোরল, বাঘা মনির ও সাগর। লরেন ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। মিরপুর এলাকায় তার অন্তত কয়েক ডজন সহযোগী সন্ত্রাসী রয়েছে। চাঁদার টাকা তুলে তারাই মামুনের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ২০২০ সালে পল্লবী এলাকার দুই রাজনৈতিক নেতাকে হত্যার জন্য ভাড়ায় খাটছিলেন গ্রেফতার রফিকুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম ও মোশাররফ হোসেন। তাদের প্রত্যেকেই মামুন-জামিলের অন্যতম ক্যাডার। রিমান্ডে তারা জানিয়েছিলেন, প্রাণ বাঁচাতে ব্যবসায়ী, বাড়ির মালিক, কাউন্সিলর, এমনকি মাদককারবারিরও তার লোকদের হাতে চাঁদা তুলে দিতেন। অন্যথায় টার্গেট ব্যক্তিকে খুন করিয়ে ফেলতেন মামুন।
সূত্র আরও জানায়, এক সময়ের ফেনসিডিলের স্বর্গ হিসেবে চিহ্নিত ছিল পল্লবীর ধ-ব্লক ও সাংবাদিক কলোনি এলাকার মাদক সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য মামুন। মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহিম, সাহাদাত, তাজগীরের রামরাজত্বের মধ্যেই নাটকীয় উত্থান ঘটে মামুনের। ১৯৯৫ সালেও ছিঁচকে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত মামুনের শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার নাটকীয় ঘটনাটি ঘটে ২০০২ সালে। সে সময় পুলিশের হাতে আটক এক মাদককারবারিকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টায় পল্লবী থানায় সশস্ত্র হামলা চালান মামুন ও তার বাহিনী। প্রায় দুই ঘণ্টা বন্দুকযুদ্ধের পর অস্ত্রসহ ধরা পড়েন মামুন। দুই পক্ষের গোলাগুলিতে আহত হন তার এক সহযোগী। বছরখানেক কারাভোগের পর বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতার যোগসাজশে এক দিনে সাতটি মামলায় জামিন নিয়ে ২০০৪ সালে তিনি পাড়ি জমান ভারতে। চাঁদা না পেয়ে ২০০৮ সালে পল্লবীতে নজরুল ইসলাম চৌধুরী মন্টু নামে এক ঝুট ব্যবসায়ীকে খুন করার মামলায় অন্যতম আসামি মামুন। ২০১২ সালে তার বাহিনীর হাতে খুন হন গার্মেন্ট কাপড় ব্যবসায়ী রমজান। এ হত্যা মামলায় মামুনকে প্রধান আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। শুধু তা-ই নয়, ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মামুনের বিরুদ্ধে পল্লবী ও মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা হয়। সন্ত্রাসী মামুন ও তার বাহিনী সর্বশেষ আলোচনায় আসেন ২০২০ সালের ডিসেম্বরে পল্লবী-১২ নম্বর সেকশনের বি-ব্লকে ৯/২ নম্বর সড়কের ১৫২/১৬ নম্বর বাড়িটি দখলের মধ্য দিয়ে।
পুলিশ জানায়, ২০০১ সালে কিছুদিন কারাভোগের পর ২০০৪ সালে ভারতে পালিয়ে যান। মামুনের আপন বড় ভাই মজিবর রহমান জামিল পলাতক আরেক হেভিওয়েট সন্ত্রাসী। ছোট ভাই মশিউর রহমান মশু গাজীপুরের সাবেক সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। তিন ভাই মিলে দীর্ঘদিন ধরে ভারতে অবস্থান করে মিরপুরের আন্ডারওয়ার্ল্ডের বড় একটা অংশ নিয়ন্ত্রণের ছক করেন। ভারতে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে ত্রিপুরায় তখনকার ক্ষমতাসীন দলের এক এমএলএ’র ভাইয়ের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে গোপনে তার বোনকে বিয়ে করেন। ভারতীয় পরিচয় নিয়ে একটি পাসপোর্ট তৈরি করে নিয়মিত ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও নেপাল ভ্রমণ করেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ওই এমএলএ মামুনকে অবৈধ অনুপ্রবেশসহ আরেকটি অপরাধের সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন। ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের জেল থেকে মুক্ত হয়ে পালিয়ে যান নেপাল। সেখানে আশ্রয় নেন ধানমন্ডি-হাজারীবাগ এলাকার পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী লেদার লিটনের কাছে। ওই শীর্ষ সন্ত্রাসীর পরামর্শেই মামুন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় আসে এক রাজনৈতিক নেতাকে কিলিংয়ের মিশন নিয়ে। কেউ কেউ বলছেন, ওই সন্ত্রাসীর ফাঁদে পা দেয়াই কাল হয় মামুনের।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সকাল পৌনে ৭টায় রাজধানীর পল্লবীর বাইতুন নুর জামে মসজিদ এলাকা থেকে মামুনকে গ্রেফতার করে। রাষ্ট্রবিরোধী একটি সন্ত্রাসী চক্র টার্গেট কিলিং ও ব্যাপক সহিংসতা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশে চোরাবাজার থেকে অবৈধভাবে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছে-এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযানে গিয়ে পল্লবীর বাইতুন নুর জামে মসজিদের পাশের রাস্তা থেকে সন্দেহজনক হিসেবে মফিজুর রহমান মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে পুলিশ। তাকে গ্রেফতারের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, আটক ব্যক্তি শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন মর্মে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, খুন, মাদক, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও ডাকাতির অভিযোগে পল্লবী থানায় ২৭টি মামলা, ১৫টি গ্রেফতারি পরোয়ানা ও দুটি সাজা পরোয়ানার তথ্য পাওয়া যায় ।
পল্লবী থানায় কাগজপত্র পর্যালোচনা করে জানা যায়, ২০০৫ সালে ৫ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় দায়েরকৃত মামলায় তার ৫ বছরের জেল, ২০০৭ সালের ১০ অক্টোবর পল্লবী থানার দায়েরকৃত মামলায় যাবজ্জীবন এবং পল্লবী থানায় দায়েরকৃত ১৯৯৬ সালের ৬ এপ্রিল দায়েরকৃত মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি মামুন। ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতারের মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় জামিনে মুক্ত হয়ে পালিয়ে ভারতে পাড়ি জমান মামুন। ঢাকায় পরিবহন ব্যবসা, স্ত্রী-সন্তান অস্ট্রেলিয়ায় পলাতক থেকেও ঢাকায় পরিবহন ব্যবসা চালিয়ে আসছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন। রবরব পরিবহনে তার ১০টির মতো বাস চলছে। রয়েছে একাধিক বাড়িও। ব্যবসা ও চাঁদাবাজি থেকে মামুনের মাসে অর্ধকোটি টাকা আয় ছিল বলে সিটিটিসির জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিলেন। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন চাঁদাবাজির টাকায় দুই সন্তানকে অস্ট্রেলিয়ায় পড়িয়েছেন। তার মেয়ে তাসনিম রহমান ও ছেলে রেদোয়ান আহমেদ দুজনই অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। স্ত্রী রীনাও মাঝে মধ্যেই ঢাকা-অস্ট্রেলিয়া যাতায়াত করেন। তবে রীনা বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন।
ঢাকার আন্ডারওয়াল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী মফিজুর রহমান মামুনের বিএনপিতে পদ পাওয়া নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়। একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে বিএনপির মতো দল কিভাবে রাজধানীর একটি ওয়ার্ডে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব দেয়-এ প্রশ্ন ছিল স্থানীয়দের। ঢাকা মহানগর উত্তরের ৯১ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড বিএনপির (পল্লবী থানা) এক নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় মফিজুর রহমান মামুনকে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিএনপিতে বড় পদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ে পল্লবীর ধ-ব্লকের সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী মামুনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেন আহসান উল্লাহ হাসান। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নির্বাচনের পরই মিরপুর ৯১-নং ওয়ার্ডের বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পল্লবী থানা বিএনপির সাবেক এক নেতা জানান, মামুন এক সময় যুবদলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেখানে পদ-পদবী না পাওয়ায় বিএনপির ওয়ার্ড কমিটিতে ঠাঁই নেন। এমন একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে দলে রেখে কী লাভ? তিনি তো ভারতে পালিয়ে থাকেন। ফেরারি আসামি। তার নামে কোনো রাজনৈতিক মামলা নেই। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে দলের নাম ভাঙিয়ে আবারো সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। বিএনপি ক্ষমতায় এলে অপকর্ম করার জন্য তিনি এই পদ বাগিয়েছেন।
পল্লবী থানা বিএনপির সদ্য সাবেক সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ওয়ার্ড কমিটিগুলো মহানগর থেকে দেয়া হয়েছে। মামুন কে, তার বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। কাদেরকে কমিটিতে আনা হয়েছে-সেটা মহানগরই ভালো জানে। তারা কমিটি দিয়েছে, তারাই বলুক মামুন কে?
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পল্লবী এলাকার সহকারী কমিশনার শাহিদুল ইসলাম বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে মাঝেমধ্যেই বেনামি নম্বর থেকে বিভিন্ন জনের ফোনকল আসে। চাঁদার জন্য কোথাও কোথাও হামলা হয়। তবে হামলাকারীদের গ্রেফতারের পর দেখা যায়, তারা খুবই সাধারণ মানুষ। টাকার বিনিময়ে তাদের ভাড়া করা হয়েছে।