* ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে
* মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে
* বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) নেমে এসেছে
* মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমিয়েছেন উদ্যোক্তারা
* শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে
* শিল্প স্থাপনের নতুন উদ্যোগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ স্থবির হয়ে আছে
চলতি বছরে ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। পাঁচটি ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির বিষয়টি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এছাড়া আরও চার ঝুঁকির বিষয়গুলো হলো-চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, পরিবেশ দূষণ, বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতা।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় হিসেবে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, বিশেষ করে বন্যা ও উচ্চ তাপমাত্রা এবং দূষণকে দায়ী করা হয়েছে। বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ ১০টি দেশের মধ্যে একটি, যেখানে দূষণকে শীর্ষ তিন ঝুঁকির একটি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারত ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। দেশ দু’টিতে দূষণ নিয়ন্ত্রণ অনেক ক্ষেত্রেই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সবুজ অর্থনীতি রূপান্তরের ক্ষেত্রে দূষণ সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ডব্লিউইএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আরও দু’টি বিষয় খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এর একটি হচ্ছে বেকারত্ব, অন্যটি হচ্ছে অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতা। এ দু’টি বিষয়ের কারণে বাংলাদেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ঘাটতি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ধীর প্রবৃদ্ধি মোকাবিলা করছে। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে ২০২৪ সালে মূল্যস্ফীতির গড়পড়তা হার ছিল ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে তা ছিল ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবমতে, ২০২২ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল সাত দশমিক সাত শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ুগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিকসহ সাম্প্রতিক বছরগুলোর অন্যান্য উদ্বেগকে ছাপিয়ে বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে রাষ্ট্রভিত্তিক সশস্ত্র সংঘাত।
দেশভিত্তিক প্রধান ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করতে নির্বাহী মতামত জরিপ (ইওএস) চালায় ডব্লিউইএফ। এটি মূলত ধারণাভিত্তিক জরিপ। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের জিজ্ঞেস করা হয়, আগামী দুই বছরে আপনার দেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোনগুলো। অংশগ্রহণকারীদের ৩৪টি ঝুঁকির তালিকা দেয়া হয়। সেখান থেকে তারা পাঁচটি প্রধান ঝুঁকি চিহ্নিত করেন।
অপর একটি সূত্র জানায়, বিদ্যমান পরিস্থিতি উন্মোচনে দেখা যাচ্ছে সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়া, জ্বালানি স্বল্পতা, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, মূল্যস্ফীতি, সম্পদ ও আয়বৈষম্য এবং বেকারত্বের মতো বড় বড় ঝুঁকি রয়েছে, যা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশের জিডিপি ২০০৯-১০ অর্থবছরে মাত্র ৭৯ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৫৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার দাবি ছিল বিগত সরকারের; সেই কৃতিত্ব নিচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। তবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, রফতানি আয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকও যে বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছিল, তা বিগত সরকারের আমলেই স্বীকার করে নেয়া হয়। আর আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনকালে ব্যাপক দুর্নীতি, বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে গেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার বিদায় তার সরকারের দুর্বল নীতিই প্রকাশ্যে এনেছে। এত দিনের নাজুক অর্থনীতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের চাপ সামলাতে পারেনি। সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি আর শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব; যার পরিণতিতে তাকে বিদায় নিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারত চলে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর দেশ হয়ে পড়ে সরকারবিহীন। তিন দিন পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তবে অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রার পর থেকে এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বেশ কিছুদিন অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ থাকার পরও এসব শিল্প ঘিরে এখনও থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
এদিকে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গিয়ে নীতি সুদহার বাড়ানোয় ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে। দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) নেমে এসেছে। নতুন বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান নির্দেশক মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। ফলে শিল্প স্থাপনের নতুন উদ্যোগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ স্থবির হয়ে আছে।
দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ থাকার পরও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে অর্থাৎ এপ্রিল-জুন সময়ে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধিতে ধস নেমেছিল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরু থেকেই, অর্থাৎ এক জুলাই শুরু হয় আন্দোলন। এরপর চার মাস (জুলাই-অক্টোবর) গেলেও এখনও দেশের আইন-শৃংখলা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসেনি। আর এ সময়ে দাতাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ-সহায়তার আশ্বাস পাওয়া গেলেও এখন অবধি এক ডলারও দেশে আসেনি। ফলে সংকটে নিমজ্জিত অর্থনীতি সচল হওয়ার যে আশা তৈরি হয়েছিল, তার দেখা মেলেনি। সাম্প্রতিক বন্যার কারণে কৃষিসহ অনেক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিল্প-কারখানায় স্বাভাবিক উৎপাদন পুরোদমে শুরু হয়নি। এ পরিস্থিতিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপি প্রবৃদ্ধি কতটা হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে। কারণ, স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যেই গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) অর্থনীতিতে তিন দশমিক ৯১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। নানা ঝুঁকিতে সঙিন অর্থনীতিতে একটার পর একটা ধাক্কা লেগেই আছে। সাড়ে চার বছর আগে ২০২০ সালের মার্চে কোভিড-১৯ মহামারীর ধকল কাটতে না কাটতে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও সেই ধাক্কা লাগে। এরপর এসেছে মধ্যপাচ্যের যুদ্ধের ধাক্কাও। তবে অভ্যন্তরীণ দুর্বল নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণেও সংকটে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। আগে থেকেই সংকটে থাকা রফতানি আয়, রেমিটেন্স, রিজার্ভ, ব্যাংক খাত, পুঁজিবাজার ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে এখনও স্বস্তি ফেরেনি। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে আছে। পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার বিষয়টি বক্তৃতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। এ অবস্থায় দিন যতো যাচ্ছে, অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা ততোই বাড়ছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) শিল্প, সেবা ও কৃষি সব খাতের প্রবৃদ্ধিই কমেছে। এই প্রান্তিকে সবচেয়ে বেশি পাঁচ দশমিক ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে কৃষি খাতে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে তিন দশমিক ৯৮ শতাংশ। আর সেবা খাতে তিন দশমিক ৬৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ছয় দশমিক ৫৫ শতাংশ। শিল্প খাতে হয়েছিল ১০ দশমিক ১৬ শতাংশ। পাঁচ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সেবা খাতে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ অনুযায়ী বিবিএস গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) থেকে প্রথমবারের মতো ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব করা শুরু করেছে। আইএমএফের ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের তিন কিস্তি ২৩১ কোটি (২.৩১ বিলিয়ন) ডলার পেয়েছে সরকার। এই ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল তিন মাস পরপর জিডিপির হালনাগাদ হিসাব প্রকাশ করতে হবে। সেই শর্ত পূরণের অংশ হিসেবেই বিবিএস প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপির হিসাব প্রকাশ করছে। এতদিন পুরো এক বছরের হিসাব দিয়ে দুই বার জিডিপির তথ্য প্রকাশ করত বিবিএস। সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের প্রথম ছয়-সাত মাসের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রথমে জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধিসহ সাময়িক হিসাব দেয়া হতো। পরে পুরো বছরের তথ্য নিয়ে প্রকাশ করা হত জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব। সে হিসাবেই গত ২১ মে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জিডিপির সাময়িক হিসাব প্রকাশ করে পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাতে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলা হয়। অর্থবছরের সাত মাস (গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি) পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকের তথ্য প্রকাশ করেছিল বিবিএস। অর্থবছর শেষ হয়েছে চার মাস আগে; কিন্তু এখনও জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করেনি পরিসংখ্যান ব্যুরো। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ছিল। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। কয়েকদিন আগে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি চার শতাংশে নেমে আসবে। আইএমএফ বলেছে, চার দশমিক পাঁচ শতাংশ হবে। এডিবি বলেছে, পাঁচ দশমিক এক শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ছয় দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরেছিল অন্তর্বর্তীবিদায়ী শেখ হাসিনা সরকার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রথম প্রান্তিকে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অর্থ ব্যয় হয়েছে মোট বরাদ্দের মাত্র চার দশমিক ৭৫ শতাংশ; আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যা ছিল সাত দশমিক ৫০ শতাংশ। গত ২৮ অক্টোবর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এডিপি বাস্তবায়নের এই তথ্য প্রকাশ করেছে। জুলাই ঘিরে আন্দোলন, আগস্টের তিন দিন সরকারবিহীন সময়ের নৈরাজ্য এবং এরপর ক্ষমতার পালাবদলের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে থমকে যাওয়া উন্নয়ন কাজের প্রভাবে এডিপি বাস্তবায়নের হার ১৫ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিন্মে নেমেছে। আইএমইডির ওয়েবসাইটে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে তথ্য পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, ওই অর্থবছর থেকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এর থেকে কম এডিবি বাস্তবায়ন হয়নি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার চলতি অর্থবছরে এডিপিতে দুই লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখে বাজেট পাস করেছিল। তবে তাদের কাজেও ছিল না গতি। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার শুধু অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর দেয়।
বিদেশি বিনিয়োগও কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২৯ অক্টোবর বিদেশি বিনিয়োগের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১৬১ কোটি (১.৬১ বিলিয়ন) নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে দেশে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ কম। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই তিন মাসে ১৪৭ কোটি (১.৪৭ বিলিয়ন) ডলারের নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল।
অন্যদিকে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ চেম্বারের সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেছেন, অর্থনীতির বারোটা বেজে যাচ্ছে। বিনিয়োগ নেই; কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সর্বত্র অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা; কোথাও স্বস্তি নেই।। দিন যতো যাচ্ছে পরিস্থিতি ততোই খারাপের দিকে যাচ্ছে। করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের দর বৃদ্ধি, মধ্যপাচ্যের যুদ্ধ-একের পর এক ধাক্কায় বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের অর্থনীতি চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর লেগেছে আরেক ধাক্কা। পোশাক শিল্পের অস্থিরতা আমাদের আরেক চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।
* মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে
* বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) নেমে এসেছে
* মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমিয়েছেন উদ্যোক্তারা
* শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে
* শিল্প স্থাপনের নতুন উদ্যোগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ স্থবির হয়ে আছে
চলতি বছরে ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। পাঁচটি ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির বিষয়টি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এছাড়া আরও চার ঝুঁকির বিষয়গুলো হলো-চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, পরিবেশ দূষণ, বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতা।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় হিসেবে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, বিশেষ করে বন্যা ও উচ্চ তাপমাত্রা এবং দূষণকে দায়ী করা হয়েছে। বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ ১০টি দেশের মধ্যে একটি, যেখানে দূষণকে শীর্ষ তিন ঝুঁকির একটি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারত ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। দেশ দু’টিতে দূষণ নিয়ন্ত্রণ অনেক ক্ষেত্রেই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সবুজ অর্থনীতি রূপান্তরের ক্ষেত্রে দূষণ সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ডব্লিউইএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আরও দু’টি বিষয় খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এর একটি হচ্ছে বেকারত্ব, অন্যটি হচ্ছে অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতা। এ দু’টি বিষয়ের কারণে বাংলাদেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ঘাটতি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ধীর প্রবৃদ্ধি মোকাবিলা করছে। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে ২০২৪ সালে মূল্যস্ফীতির গড়পড়তা হার ছিল ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে তা ছিল ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবমতে, ২০২২ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল সাত দশমিক সাত শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ুগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিকসহ সাম্প্রতিক বছরগুলোর অন্যান্য উদ্বেগকে ছাপিয়ে বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে রাষ্ট্রভিত্তিক সশস্ত্র সংঘাত।
দেশভিত্তিক প্রধান ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করতে নির্বাহী মতামত জরিপ (ইওএস) চালায় ডব্লিউইএফ। এটি মূলত ধারণাভিত্তিক জরিপ। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের জিজ্ঞেস করা হয়, আগামী দুই বছরে আপনার দেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোনগুলো। অংশগ্রহণকারীদের ৩৪টি ঝুঁকির তালিকা দেয়া হয়। সেখান থেকে তারা পাঁচটি প্রধান ঝুঁকি চিহ্নিত করেন।
অপর একটি সূত্র জানায়, বিদ্যমান পরিস্থিতি উন্মোচনে দেখা যাচ্ছে সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়া, জ্বালানি স্বল্পতা, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, মূল্যস্ফীতি, সম্পদ ও আয়বৈষম্য এবং বেকারত্বের মতো বড় বড় ঝুঁকি রয়েছে, যা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশের জিডিপি ২০০৯-১০ অর্থবছরে মাত্র ৭৯ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৫৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার দাবি ছিল বিগত সরকারের; সেই কৃতিত্ব নিচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। তবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, রফতানি আয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকও যে বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছিল, তা বিগত সরকারের আমলেই স্বীকার করে নেয়া হয়। আর আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনকালে ব্যাপক দুর্নীতি, বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে গেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার বিদায় তার সরকারের দুর্বল নীতিই প্রকাশ্যে এনেছে। এত দিনের নাজুক অর্থনীতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের চাপ সামলাতে পারেনি। সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি আর শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব; যার পরিণতিতে তাকে বিদায় নিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারত চলে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর দেশ হয়ে পড়ে সরকারবিহীন। তিন দিন পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তবে অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রার পর থেকে এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বেশ কিছুদিন অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ থাকার পরও এসব শিল্প ঘিরে এখনও থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
এদিকে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গিয়ে নীতি সুদহার বাড়ানোয় ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে। দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) নেমে এসেছে। নতুন বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান নির্দেশক মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। ফলে শিল্প স্থাপনের নতুন উদ্যোগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ স্থবির হয়ে আছে।
দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ থাকার পরও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে অর্থাৎ এপ্রিল-জুন সময়ে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধিতে ধস নেমেছিল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরু থেকেই, অর্থাৎ এক জুলাই শুরু হয় আন্দোলন। এরপর চার মাস (জুলাই-অক্টোবর) গেলেও এখনও দেশের আইন-শৃংখলা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসেনি। আর এ সময়ে দাতাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ-সহায়তার আশ্বাস পাওয়া গেলেও এখন অবধি এক ডলারও দেশে আসেনি। ফলে সংকটে নিমজ্জিত অর্থনীতি সচল হওয়ার যে আশা তৈরি হয়েছিল, তার দেখা মেলেনি। সাম্প্রতিক বন্যার কারণে কৃষিসহ অনেক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিল্প-কারখানায় স্বাভাবিক উৎপাদন পুরোদমে শুরু হয়নি। এ পরিস্থিতিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপি প্রবৃদ্ধি কতটা হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে। কারণ, স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যেই গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) অর্থনীতিতে তিন দশমিক ৯১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। নানা ঝুঁকিতে সঙিন অর্থনীতিতে একটার পর একটা ধাক্কা লেগেই আছে। সাড়ে চার বছর আগে ২০২০ সালের মার্চে কোভিড-১৯ মহামারীর ধকল কাটতে না কাটতে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও সেই ধাক্কা লাগে। এরপর এসেছে মধ্যপাচ্যের যুদ্ধের ধাক্কাও। তবে অভ্যন্তরীণ দুর্বল নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণেও সংকটে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। আগে থেকেই সংকটে থাকা রফতানি আয়, রেমিটেন্স, রিজার্ভ, ব্যাংক খাত, পুঁজিবাজার ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে এখনও স্বস্তি ফেরেনি। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে আছে। পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার বিষয়টি বক্তৃতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। এ অবস্থায় দিন যতো যাচ্ছে, অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা ততোই বাড়ছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) শিল্প, সেবা ও কৃষি সব খাতের প্রবৃদ্ধিই কমেছে। এই প্রান্তিকে সবচেয়ে বেশি পাঁচ দশমিক ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে কৃষি খাতে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে তিন দশমিক ৯৮ শতাংশ। আর সেবা খাতে তিন দশমিক ৬৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ছয় দশমিক ৫৫ শতাংশ। শিল্প খাতে হয়েছিল ১০ দশমিক ১৬ শতাংশ। পাঁচ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সেবা খাতে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ অনুযায়ী বিবিএস গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) থেকে প্রথমবারের মতো ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব করা শুরু করেছে। আইএমএফের ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের তিন কিস্তি ২৩১ কোটি (২.৩১ বিলিয়ন) ডলার পেয়েছে সরকার। এই ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল তিন মাস পরপর জিডিপির হালনাগাদ হিসাব প্রকাশ করতে হবে। সেই শর্ত পূরণের অংশ হিসেবেই বিবিএস প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপির হিসাব প্রকাশ করছে। এতদিন পুরো এক বছরের হিসাব দিয়ে দুই বার জিডিপির তথ্য প্রকাশ করত বিবিএস। সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের প্রথম ছয়-সাত মাসের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রথমে জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধিসহ সাময়িক হিসাব দেয়া হতো। পরে পুরো বছরের তথ্য নিয়ে প্রকাশ করা হত জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব। সে হিসাবেই গত ২১ মে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জিডিপির সাময়িক হিসাব প্রকাশ করে পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাতে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলা হয়। অর্থবছরের সাত মাস (গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি) পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকের তথ্য প্রকাশ করেছিল বিবিএস। অর্থবছর শেষ হয়েছে চার মাস আগে; কিন্তু এখনও জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করেনি পরিসংখ্যান ব্যুরো। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ছিল। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। কয়েকদিন আগে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি চার শতাংশে নেমে আসবে। আইএমএফ বলেছে, চার দশমিক পাঁচ শতাংশ হবে। এডিবি বলেছে, পাঁচ দশমিক এক শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ছয় দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরেছিল অন্তর্বর্তীবিদায়ী শেখ হাসিনা সরকার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রথম প্রান্তিকে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অর্থ ব্যয় হয়েছে মোট বরাদ্দের মাত্র চার দশমিক ৭৫ শতাংশ; আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যা ছিল সাত দশমিক ৫০ শতাংশ। গত ২৮ অক্টোবর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এডিপি বাস্তবায়নের এই তথ্য প্রকাশ করেছে। জুলাই ঘিরে আন্দোলন, আগস্টের তিন দিন সরকারবিহীন সময়ের নৈরাজ্য এবং এরপর ক্ষমতার পালাবদলের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে থমকে যাওয়া উন্নয়ন কাজের প্রভাবে এডিপি বাস্তবায়নের হার ১৫ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিন্মে নেমেছে। আইএমইডির ওয়েবসাইটে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে তথ্য পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, ওই অর্থবছর থেকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এর থেকে কম এডিবি বাস্তবায়ন হয়নি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার চলতি অর্থবছরে এডিপিতে দুই লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখে বাজেট পাস করেছিল। তবে তাদের কাজেও ছিল না গতি। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার শুধু অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর দেয়।
বিদেশি বিনিয়োগও কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২৯ অক্টোবর বিদেশি বিনিয়োগের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১৬১ কোটি (১.৬১ বিলিয়ন) নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে দেশে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ কম। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই তিন মাসে ১৪৭ কোটি (১.৪৭ বিলিয়ন) ডলারের নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল।
অন্যদিকে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ চেম্বারের সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেছেন, অর্থনীতির বারোটা বেজে যাচ্ছে। বিনিয়োগ নেই; কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সর্বত্র অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা; কোথাও স্বস্তি নেই।। দিন যতো যাচ্ছে পরিস্থিতি ততোই খারাপের দিকে যাচ্ছে। করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের দর বৃদ্ধি, মধ্যপাচ্যের যুদ্ধ-একের পর এক ধাক্কায় বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের অর্থনীতি চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর লেগেছে আরেক ধাক্কা। পোশাক শিল্পের অস্থিরতা আমাদের আরেক চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।