![](https://dainikjanata.net/public/postimages/6755257699ead.jpeg)
* গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য পূরণ করতে হলে সব ধরনের চাপ উপেক্ষা করে সৎভাবে কাজ করতে হবে
* অযোগ্য-অদক্ষদের পুনর্বাসন করা হলে তা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না
* প্রশাসনের মধ্য থেকে যোগ্য ও সাহসী কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করতে হবে। অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ কর্মকর্তাকে প্রাধান্য দিতে হবে
বদলি-পদায়ন কিংবা ঠিকাদারির তদবিরের চাপে প্রশাসন। সরকারের মাঠ প্রশাসন থেকে কেন্দ্রীয় প্রশাসন পর্যন্ত চলছে ওই তদবির। বিগত সরকারের সময়ে এশমুখী তদবির হলেও এখন সরকার সমর্থক নানা গোষ্ঠী ও দেশের সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতার কাছ থেকে প্রশাসনে বহুমুখী তদবির হচ্ছে। তদবিরের চাপে হাঁপিয়ে উঠেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। চতুর্মুখী তদবিরের যন্ত্রণায় প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত সরকারের আমলে শুধু আওয়ামী লীগ, গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেই প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। সব ধরনের তদবির, আদেশ-নিষেধ একমুখী ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজপথে সক্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতারাই এখন তদবির করে বেড়াচ্ছে। বদলি, পদোন্নতি কিংবা ঠিকাদারির কাজ পাইয়ে দেয়ার মতো সচিবালয়কেন্দ্রিক ওসব তদবির অতীতের চেয়ে বেড়েছে। বড় দলগুলোর নেতাদের প্রায়ই সচিবালয়ে দেখা যায়। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সমমনা দলগুলোর নেতারা প্রশাসনে প্রভাব খাটিয়ে চলেছেন। তারা নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় পছন্দের ডিসি-এসপি নিয়োগ দিতে তদবির করে বেড়াচ্ছেন। তাছাড়া বদলি-পদায়ন কিংবা ঠিকাদারি কাজের পেছনে দৌড়াচ্ছে রাজনীতিকরা। বড় দলের নেতাদের পাশাপাশি ছোট নতুন-পুরোনো দলের শীর্ষ নেতাদেরও সচিবালয়ে দেখা যাচ্ছে। এমনকি ওই নেতারা আওয়ামী লীগের শাসনামলে সুবিধা নেয়া দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জন্যও তদবির করছেন। সূত্র জানায়, রাজনৈতক পটপরিবর্তনের পর দেশে বিএনপি-জামায়াতপন্থি হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তারা দাপটের সঙ্গেই চাকরি করছেন। এরই মধ্যে তাদের অনেকেই পছন্দের দপ্তরে পদায়ন নিয়েছেন। নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে পদোন্নতিও পেয়েছেন। প্রশাসনে এখন তারা প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। নিজেদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের পর তারা সহকর্মী-ব্যাচমেট কিংবা স্বজনদের জন্য দৌড়াদৌড়িতে ব্যস্ত। কে কোন দপ্তরে যাবেন তা তারা ঠিক করছেন। এমনকি বিগত সরকারের সময়ে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা কর্মকর্তাদের জন্যও অনেকে তদবির করছেন। ফলে পতিত সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে পরিচিত অনেক কর্মকর্তা এখনো বহাল তবিয়তে বড় বড় দপ্তরে বসে আছেন। ওসব কর্মকর্তার এমন নীতিবিরুদ্ধ দৌড়ঝাঁপ বর্তমান সরকারের প্রশাসনের স্বাধীনভাবে কাজ করা ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে সচিবালয়েই নয়, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তদবিরের চাপে অতিষ্ঠ। স্থানীয় রাজনীতিকদের পাশাপাশি গণমাধ্যম কর্মীরাও স্থানীয় প্রশাসনকে তদবিরের চাপ দিচ্ছে। ফলে কর্মকর্তাদের অনেক অযৌক্তিক তদবির রাখতে হচ্ছে। স্থানীয় সাংবাদিকরাও নানা আবদার নিয়ে যাচ্ছেন। আর সেগুলো রাখলেও বিপদ, না রাখলেও ভয়ে থাকতে হয়। কখন কে নেতিবাচক নিউজ করে দেয়! সব মিলিয়ে বিগত সরকারের আমলের চেয়ে বর্তমানে প্রশাসনে তদবিরের চাপ অনেক বেড়েছে। সূত্র আরো জানায়, সরকারের উপদেষ্টা ও সচিবরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও রাজনীতিবিদের লাগামহীন তদবিরে চরম বিরক্ত। তারা বলছেন, তদবিরের চাপ এতই বেশি যে, ঠিকমতো কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু সবাই যেভাবে তদবির ও নিজেদের সুবিধার জন্য আসেন, তা শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করার শামিল। গত ২৪ সেপ্টেম্বর যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ক্ষোভ জানিয়ে তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে লেখেন, ‘দায়িত্ব নেয়ার পরপরই বলেছিলাম, ব্যক্তিগত তদবির-আবদার নিয়ে কেউ আসবেন না। এখনো প্রতিদিন যদি ৫০ জন দেখা করতে আসেন, তার মধ্যে ৪৮ জনই আসেন নানারকম তদবির নিয়ে। আমাদেরও নতুন বাংলাদেশের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়তে হবে। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে দেশের স্বার্থে ত্যাগের মানসিকতা, কাজ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে শহীদদের স্পিরিটকে ধারণ করে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের কাছে প্রতিদিন নানা ধরনের তদবির আসছে। এতে খুব অসুবিধাও হচ্ছে। মূলত সরকারি খাতে পদোন্নতি, বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে অনেক সময়ে আর্থিক লেনদেনসহ তদবির বাংলাদেশে দীর্ঘ সময়ের প্রশাসনিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি চর্চার সুযোগটি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথমদিকে আগের সরকারের আমলাতন্ত্র পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় পরিপূর্ণভাবে যোগ্যতানির্ভর পদায়ন, পদোন্নতি বদলি হয়েছে তা বলা যাবে না। এখানে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড কতটুকু অনুসরণ করা হয়েছে তাও প্রশ্নবিদ্ধ। এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতি বিষয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, যে লক্ষ্য নিয়ে দেশে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, সে লক্ষ্য পূরণ করতে হলে সব ধরনের চাপ ও তদবির উপেক্ষা করে সৎভাবে কাজ করতে হবে। তদবিরের দোহাই দিয়ে অযোগ্য-অদক্ষদের পুনর্বাসন করা হলে তা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। তদবির নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সমগ্র প্রশাসনের মধ্য থেকে যোগ্য ও সাহসী কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করতে হবে। অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ কর্মকর্তাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তবে সরকারের দায়িত্বশীলদের মধ্যে যদি ব্যক্তিগত পছন্দ, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ কাজ করে, তাহলে ভালো প্রশাসন পাওয়া যাবে না। এমন অবস্থা চলতেই থাকবে।