* গ্রামের বাড়ীতে চলছে পরিবারে শোকের মাতম
* নিজাম উদ্দিনের মরদেহ দেশে আনা সম্ভব নয়
* ঋণ শোধ করে বাড়ি বানানোর নিজামের স্বপ্ন নিঃশেষ
হ* নিহত নিজামের মরদেহ দেশে আনার দাবি পরিবারের
লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় প্রবাসী বাংলাদেশি যুবক মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন (৩২) নিহত হয়েছেন। লেবাননের স্থানীয় সময় গত শনিবার রাতে বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাস এ তথ্য জানিয়েছে। বাংলাদেশি রেমিট্যান্স যোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিজাম উদ্দিনের মৃত্যুর খবরে তার গ্রামের বাড়ীতে পরিবারে চলছে শোকের মাতম। তারা নিজামের মরদেহ দেশে আনার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ফ্লাইট না থাকার কারণে লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় মারা যাওয়া প্রবাসী বাংলাদেশি মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিনের মরদেহ দেশে আনা সম্ভব হবে না। গতকাল রোববার এক ক্ষুদে বার্তায় এই তথ্য জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
লেবাননে বৈরুতে বাংলাদেশ দূতাবাস জানায়, অতীব দুঃখের সঙ্গে জানানো যাচ্ছে যে, লেবানন প্রবাসী বাংলাদেশি রেমিট্যান্স যোদ্ধা মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন, বয়স ৩১ বছর ১১ মাস গত শনিবার বিকেল ৩টা ২৩ মিনিটে বৈরুতের হাজমিয়ে এলাকায় কর্মস্থলে যাওয়ার পথে (একটি কফি শপে অবস্থানকালে) বিমান হামলায় ঘটনাস্থলে মারা যান। নিহত নিজাম উদ্দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কসবা উপজেলার খারেরা এলাকার বাসিন্দা। তার বাবা মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস এবং মা মোসা. আনোয়ারা বেগম। লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এয়ার ভাইস মার্শাল জাভেদ তানভীর খান মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। তিনি তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকাহত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
নিজামের মৃত্যুর খবরে তার পরিবারে চলছে শোকের মাতম। তারা নিজামের মরদেহ দেশে আনার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। নিহত নিজাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খাড়েরা ইউনিয়নের খাড়েরা গ্রামের মৃত মো. আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে। তারা দুই ভাই, দুই বোন। তাদের বাবা-মা বেঁচে নেই।
নিহত নিজামের বড় ভাই জালাল উদ্দিন জানান, তার ভাই ১২ বছর আগে জীবিকার তাগিদে লেবাননে যান। গত শনিবার রাতে তার মৃত্যুর খবর আসে। একমাত্র ভাইয়ের মরদেহ দেখতে চান তারা। সরকার যেন তার ভাইয়ের মরদেহটা দেশে আনার ব্যবস্থা করে দেয়। এটি ছাড়া তাদের আর কিছু চাওয়ার নেই।
নিজামের বৃদ্ধা চাচি খোদেজা বেগম বলেন, আমার ভাতিজা ১২ বছর আগে লেবাননে যাওয়ার পর আর দেশে আসেনি। সরকারের কাছে অনুরোধ, আমার ভাতিজার লাশটা যেন এনে দেয়। আমি আমার ভাতিজার মুখটা দেখতে চাই। নিজামের দুই বোন সায়েরা ও পারুল বেগমেরও একই দাবি। তারা তাদের ভাইয়ের মরদেহ দেখতে চান। এদিকে নিজামের বাড়িতে স্বজনদের আহাজারিতে এক হৃদয় বিদারক শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। সকাল থেকেই তাদের বাড়িতে গ্রামবাসী ভিড় করেন। কখন মরদেহ আসবে তা জানতে চান তারা।
খাড়েরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মনিরুজ্জামান জানান, তার ভাই জালালের মাধ্যমে তিনি নিজামের মৃত্যুর বিষয়টি জেনেছেন। তিনি নিজামের মরদেহ দেশে আনার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন।
কসবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহরিয়ার মোক্তার এ বিষয়ে জানান, নিহত নিজামের পরিবারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। তার মরদেহ দেশে আনার বিষয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।
গতকাল রোববার এক ক্ষুদে বার্তায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ফ্লাইট না থাকার কারণে লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় মারা যাওয়া প্রবাসী বাংলাদেশি মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিনের মরদেহ দেশে আনা সম্ভব হবে না বলে তাকে জানানো হয়েছে।
এদিকে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ইসরায়েলের বিমান হামলায় নিজাম উদ্দিন নিহত হওয়ায় পরিবারের সবার ছোট ভাইকে হারিয়ে দিশেহারা গোটা পরিবার। ১২ বছর আগে ভাগ্য ফেরাতে লেবাননে পাড়ি জমান তিনি। গত শনিবার রাতে নিহত নিজামের বাড়ির লোকজন তার মৃত্যুর বিষয়টি জানতে পারে। পাঁচ ভাই ও বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। তার মৃত্যুতে পুরো পরিবারেই নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ২০০৪ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর ভাই-বোনদের কাছেই বড় হন নিজাম। পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে ১২ বছর আগে ধার-দেনা করে প্রায় সাত লাখ টাকা ব্যয়ে তাকে লেবাননে পাঠানো হয়। তবে নিজামের ছিল না বৈধ কাগজপত্র। আর সে কারণেই তিনি সেখানে অবৈধভাবে থাকছিলেন। যখন যে কাজ পেতেন, তা-ই করতেন। কাগজ-পত্র না থাকায় ১২ বছরে একবারের জন্যও দেশে ফিরতে পারেননি তিনি।
এ সময়ের মধ্যেই তার মা ও এক বোনও মারা যান। তাদের মৃত্যুর খবর শুনে দূর থেকে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি নিজাম। পারেননি, মা কিংবা বোনের মুখ শেষবারের মতো দেখতে। গত শনিবার বিকেলে পরিবারের সদস্যরা খবর পান বৈরুতে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে একটি কফি শপে অবস্থানকালে ইসরায়েলের বিমান হামলার শিকার হয়ে ঘটনাস্থলেই নিজাম নিহত হন।
নিহত নিজামের বড় বোন সাহেরা বেগম বলেন, নিজাম তখন ছোট থাকার সময়ই বাবা মারা যান। তখন থেকে পরিবার অনেক আর্থিক কষ্টে দিন কাটায়। চাকরির জন্য সে ঢাকায় চলে যায়। যে টাকা বেতন পেত তা দিয়ে চলত না। তখন সে আমাকে বলে, আপা তুমি ঋণ করে হলেও আমারে বিদেশ পাঠাও। তিনি বলেন, পরে সাত লাখ টাকা ঋণ করে তাকে বিদেশ পাঠাই। বৃষ্টি হলে ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ত। মনে করেছিলাম ভাইকে বিদেশ পাঠিয়েছি। টাকা দিলে নতুন ঘর তুলে ফেলব। সে সুখ আর কপালে জুটল না। বৈধ কাগজ না থাকার কারণে যে কাজ পেত, তাই সে করত।
নিজাম প্রায়শই লেবানন থেকে কল করে বোনকে বলতেন, বুবু এত টাকা ঋণ করে গেলাম। ঋণের টাকাই শোধ করতে পারলাম না। এখন আর কয়টা দিন থাকি, ভালো কাজ পেলে ঋণের টাকা পরিশোধ করে বাড়িতে ঘর করব। আক্ষেপ করে নিজামের বোন বলছিলেন, এর মধ্যে যে বোমা পড়ে মরে যাবে, আমরা তো কল্পনা করিনি। এখন সরকারের কাছে দাবি, আমার ভাইয়ের মরা মুখটা যেন একবার দেখতে পারি। তার মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করে দিন। যদিও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ফ্লাইট না থাকার কারণে মরদেহ বাংলাদেশে আনা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে বৈরুতে বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষ।