টিআইবি রিপোর্টে সওজ’র দুর্নীতির ভয়াবহতা
দুর্নীতির পরিমাণ : গত ১৫ বছরে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রকল্পগুলিতে ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে
দুর্নীতির হার : প্রকল্পগুলোতে মোট বরাদ্দের ২৩% থেকে ৪০% পর্যন্ত অর্থ দুর্নীতি হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে
গবেষণার তথ্য : ৭৩ জনের সাক্ষাৎকার এবং ৪৮টি উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এই গবেষণা পরিচালিত হয়েছে
দুর্নীতির উদাহরণ : প্রকল্পে ৭৪ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও একটি গাছও লাগানো হয়নি
রাজনীতির প্রভাব : প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক আনুকূল্যের কারণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি
দূরীকরণের সুপারিশ : দুর্নীতি রোধে রাজনীতিবিদ, আমলা ও ঠিকাদারদের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সিন্ডিকেট ভাঙার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতির ফলে গত ১৫ বছরে দেশের ক্ষতির পরিমাণ ২৯ হাজার ২৩০ কোটি থেকে ৫০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, এসব উন্নয়ন প্রকল্পের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ লোপাট হয়েছে। এই লোপাটের পেছনে রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এবং ঠিকাদারদের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় যোগসাজশ অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার টিআইবির ধানমন্ডি কার্যালয়ে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। গবেষণায় উঠে আসে, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রকল্পগুলোর উন্নয়ন কাজের বড় অংশই দুর্নীতির শিকার হয়েছে। টিআইবি বলেছে, এসব উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেটের বড় অংশই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
গবেষণা অনুযায়ী, এই দুর্নীতির ফলে সরকারের বরাদ্দ করা অর্থের বিশাল একটি অংশ অপচয় হয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এসব দুর্নীতির পেছনে রাজনীতিবিদ, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় যোগসাজশ রয়েছে। এই ত্রিপক্ষীয় যোগসাজশ ভাঙতে হবে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়েছে, যার পরিমাণ ২৯ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫১ হাজার কোটি টাকা।
টিআইবি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে এই দুর্নীতি হয়েছে, যেখানে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী রাজনীতিক; আমলা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং ঠিকাদার এই চক্রের অন্তর্ভুক্ত।
‘সড়ক মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়। টিআইবির গবেষণায় ঠিকাদার, সড়ক বিভাগের আমলা ও প্রকৌশলীসহ ৭৩ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় এবং ৪৮টি উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণ করা হয়। এর ভিত্তিতে টিআইবি একটি প্রকল্পে মোট বরাদ্দের কত শতাংশ ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ব্যয় হয়, তা হিসাব করেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যে সমাপ্ত প্রকল্পগুলো গবেষণাটির আওতায় আনা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, সড়ক নির্মাণ বা উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজে সার্বিকভাবে দুর্নীতির হার ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ। ২৩ শতাংশ হলে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে সড়ক ও মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণ বা উন্নয়নকাজে প্রাক্কলিত দুর্নীতির পরিমাণ ২৯ হাজার ২৩০ কোটি টাকা, আর ৪০ শতাংশ হলে দুর্নীতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা।
গবেষণায় আরও জানানো হয়েছে, ২০০৯-১০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনে বাস্তবায়িত উন্নয়ন প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে নির্মাণকাজের কার্যাদেশ প্রাপ্তি ও ঠিকাদারের বিল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঘুষ, দুর্নীতির হার ১১-১৪ শতাংশ এবং নির্মাণকাজে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে দুর্নীতির হার ১০-২০ শতাংশ।
গবেষণায় বরাদ্দের কত শতাংশ দুর্নীতি হয়েছে তা জানাতে গিয়ে টিআইবি জানায়, সড়কের প্রকল্পে স্তরভেদে দুর্নীতির হার ভিন্ন। প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদারদের লাইসেন্স ভাড়া নেওয়া, কোনো ঠিকাদারের প্রাপ্ত কার্যাদেশ কিনে নেওয়া, নিয়মের বাইরে উপঠিকাদার নিয়োগ (সাবকন্ট্রাক্ট), প্রতিযোগী ঠিকাদারের সঙ্গে সমঝোতা, স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক চাঁদাবাজি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কার্যাদেশের মোট অর্থমূল্যের ২ থেকে ৬ শতাংশ দুর্নীতি হয়; নির্মাণকাজের কার্যাদেশ পাওয়া ও ঠিকাদারকে বিল পেতে ঘুষের পরিমাণ বরাদ্দের ১১ থেকে ১৪ শতাংশ; নির্মাণকাজে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে দুর্নীতির হার ১০ থেকে ২০ শতাংশ।
টিআইবি বলেছে, ঠিকাদার, সংশ্লিষ্ট বিভাগের তৎকালীন মন্ত্রী, কয়েকজন তৎকালীন সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদ এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতির টাকা ভাগাভাগি হয়েছে। এর ফলে ঠিকাদারেরা নির্মাণকাজে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করেছেন এবং উপকরণ যতটুকু দরকার, তার চেয়ে কম ব্যবহার করেছেন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক ও প্রকৌশলীরা এই অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জনস্বার্থে নেওয়া প্রকল্পগুলোতে রাজনীতিবিদ, আমলা ও ঠিকাদারদের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাত রয়েছে। একেবারে নিম্নপর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত এসব দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। এই চক্র ভাঙতে না পারলে দুর্নীতিবিরোধী কোনো কার্যক্রম সফল হবে না।
গবেষণায় টিআইবি দুর্নীতির কিছু উদাহরণ তুলে ধরেছে। যেমন একটি প্রকল্পে বৃক্ষরোপণে ৭৪ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল, কিন্তু একটি গাছও লাগানো হয়নি। এ ছাড়া, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে স্থানীয় পর্যায়ে কাজের মান হ্রাস পেয়েছে। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপস্থিতি ও তাঁদের আনুকূল্য থাকায় ঠিকাদারদের মধ্যে দায়িত্বহীনতা দেখা দিয়েছে।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্প নেওয়ার সময় অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়। কখনো কখনো মোট প্রাক্কলিত বাজেটের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ দাঁড়ায়। পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প অনুমোদন সভায় দ্রুততার সঙ্গে প্রস্তাব উত্থাপন এবং গোপনে প্রকল্প প্রস্তাব মূল্যায়ন-সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করতে সওজের কিছু কর্মকর্তা পরিকল্পনা কমিশনের কর্মচারীদের ২ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিয়েছেন।
টিআইবি আরও বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও তা কার্যকর করার জন্য একটি টেকসই ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন। সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের প্রকল্পের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে টিআইবির কর্মকর্তারা অনেক তথ্য পাননি, যা দুর্নীতির ব্যাপারে আরও তদন্তের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পরিচালক (আউটরিচ ও কমিউনিকেশন) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। সরকারের উচিত সকল প্রকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
তিনি জানান, তবে বাস্তব কথা হলো, প্রতিষ্ঠানে কিছু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে, তবে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার তো পরিবর্তন হয়নি। তাই রাতারাতি পরিবর্তন আশা করছি না।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, দুর্নীতির বিষয়টি খুবই গুরুতর। আমাদের প্রত্যাশা, যেসব তথ্য প্রকাশযোগ্য, সেগুলো যেন প্রকাশ করা হয়। বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পগুলোতেও কমবেশি দুর্নীতি হয়েছে। দেশীয় আমলাতন্ত্রের সঙ্গে বিদেশি আমলাতন্ত্রের যোগসাজশ হয়েছে।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনটি শুধু দেশীয় অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। যা দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়।
এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন টিআইবির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মো. জুলকারনাইন এবং গবেষণা সহযোগী মো. মোস্তফা কামাল। টিআইবি আশা করছে যে, তাদের এই প্রতিবেদন সরকারের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সহায়ক হবে।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির পরিচালক (আউটরিচ ও কমিউনিকেশন) তৌহিদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) সুমাইয়া খায়ের।
দুর্নীতির পরিমাণ : গত ১৫ বছরে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রকল্পগুলিতে ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে
দুর্নীতির হার : প্রকল্পগুলোতে মোট বরাদ্দের ২৩% থেকে ৪০% পর্যন্ত অর্থ দুর্নীতি হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে
গবেষণার তথ্য : ৭৩ জনের সাক্ষাৎকার এবং ৪৮টি উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এই গবেষণা পরিচালিত হয়েছে
দুর্নীতির উদাহরণ : প্রকল্পে ৭৪ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও একটি গাছও লাগানো হয়নি
রাজনীতির প্রভাব : প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক আনুকূল্যের কারণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি
দূরীকরণের সুপারিশ : দুর্নীতি রোধে রাজনীতিবিদ, আমলা ও ঠিকাদারদের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সিন্ডিকেট ভাঙার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতির ফলে গত ১৫ বছরে দেশের ক্ষতির পরিমাণ ২৯ হাজার ২৩০ কোটি থেকে ৫০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, এসব উন্নয়ন প্রকল্পের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ লোপাট হয়েছে। এই লোপাটের পেছনে রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এবং ঠিকাদারদের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় যোগসাজশ অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার টিআইবির ধানমন্ডি কার্যালয়ে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। গবেষণায় উঠে আসে, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রকল্পগুলোর উন্নয়ন কাজের বড় অংশই দুর্নীতির শিকার হয়েছে। টিআইবি বলেছে, এসব উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেটের বড় অংশই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
গবেষণা অনুযায়ী, এই দুর্নীতির ফলে সরকারের বরাদ্দ করা অর্থের বিশাল একটি অংশ অপচয় হয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এসব দুর্নীতির পেছনে রাজনীতিবিদ, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় যোগসাজশ রয়েছে। এই ত্রিপক্ষীয় যোগসাজশ ভাঙতে হবে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়েছে, যার পরিমাণ ২৯ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫১ হাজার কোটি টাকা।
টিআইবি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে এই দুর্নীতি হয়েছে, যেখানে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী রাজনীতিক; আমলা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং ঠিকাদার এই চক্রের অন্তর্ভুক্ত।
‘সড়ক মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়। টিআইবির গবেষণায় ঠিকাদার, সড়ক বিভাগের আমলা ও প্রকৌশলীসহ ৭৩ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় এবং ৪৮টি উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণ করা হয়। এর ভিত্তিতে টিআইবি একটি প্রকল্পে মোট বরাদ্দের কত শতাংশ ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ব্যয় হয়, তা হিসাব করেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যে সমাপ্ত প্রকল্পগুলো গবেষণাটির আওতায় আনা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, সড়ক নির্মাণ বা উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজে সার্বিকভাবে দুর্নীতির হার ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ। ২৩ শতাংশ হলে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে সড়ক ও মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণ বা উন্নয়নকাজে প্রাক্কলিত দুর্নীতির পরিমাণ ২৯ হাজার ২৩০ কোটি টাকা, আর ৪০ শতাংশ হলে দুর্নীতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা।
গবেষণায় আরও জানানো হয়েছে, ২০০৯-১০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনে বাস্তবায়িত উন্নয়ন প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে নির্মাণকাজের কার্যাদেশ প্রাপ্তি ও ঠিকাদারের বিল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঘুষ, দুর্নীতির হার ১১-১৪ শতাংশ এবং নির্মাণকাজে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে দুর্নীতির হার ১০-২০ শতাংশ।
গবেষণায় বরাদ্দের কত শতাংশ দুর্নীতি হয়েছে তা জানাতে গিয়ে টিআইবি জানায়, সড়কের প্রকল্পে স্তরভেদে দুর্নীতির হার ভিন্ন। প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদারদের লাইসেন্স ভাড়া নেওয়া, কোনো ঠিকাদারের প্রাপ্ত কার্যাদেশ কিনে নেওয়া, নিয়মের বাইরে উপঠিকাদার নিয়োগ (সাবকন্ট্রাক্ট), প্রতিযোগী ঠিকাদারের সঙ্গে সমঝোতা, স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক চাঁদাবাজি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কার্যাদেশের মোট অর্থমূল্যের ২ থেকে ৬ শতাংশ দুর্নীতি হয়; নির্মাণকাজের কার্যাদেশ পাওয়া ও ঠিকাদারকে বিল পেতে ঘুষের পরিমাণ বরাদ্দের ১১ থেকে ১৪ শতাংশ; নির্মাণকাজে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে দুর্নীতির হার ১০ থেকে ২০ শতাংশ।
টিআইবি বলেছে, ঠিকাদার, সংশ্লিষ্ট বিভাগের তৎকালীন মন্ত্রী, কয়েকজন তৎকালীন সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদ এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতির টাকা ভাগাভাগি হয়েছে। এর ফলে ঠিকাদারেরা নির্মাণকাজে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করেছেন এবং উপকরণ যতটুকু দরকার, তার চেয়ে কম ব্যবহার করেছেন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক ও প্রকৌশলীরা এই অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জনস্বার্থে নেওয়া প্রকল্পগুলোতে রাজনীতিবিদ, আমলা ও ঠিকাদারদের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাত রয়েছে। একেবারে নিম্নপর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত এসব দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। এই চক্র ভাঙতে না পারলে দুর্নীতিবিরোধী কোনো কার্যক্রম সফল হবে না।
গবেষণায় টিআইবি দুর্নীতির কিছু উদাহরণ তুলে ধরেছে। যেমন একটি প্রকল্পে বৃক্ষরোপণে ৭৪ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল, কিন্তু একটি গাছও লাগানো হয়নি। এ ছাড়া, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে স্থানীয় পর্যায়ে কাজের মান হ্রাস পেয়েছে। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপস্থিতি ও তাঁদের আনুকূল্য থাকায় ঠিকাদারদের মধ্যে দায়িত্বহীনতা দেখা দিয়েছে।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্প নেওয়ার সময় অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়। কখনো কখনো মোট প্রাক্কলিত বাজেটের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ দাঁড়ায়। পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প অনুমোদন সভায় দ্রুততার সঙ্গে প্রস্তাব উত্থাপন এবং গোপনে প্রকল্প প্রস্তাব মূল্যায়ন-সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করতে সওজের কিছু কর্মকর্তা পরিকল্পনা কমিশনের কর্মচারীদের ২ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিয়েছেন।
টিআইবি আরও বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও তা কার্যকর করার জন্য একটি টেকসই ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন। সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের প্রকল্পের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে টিআইবির কর্মকর্তারা অনেক তথ্য পাননি, যা দুর্নীতির ব্যাপারে আরও তদন্তের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পরিচালক (আউটরিচ ও কমিউনিকেশন) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। সরকারের উচিত সকল প্রকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
তিনি জানান, তবে বাস্তব কথা হলো, প্রতিষ্ঠানে কিছু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে, তবে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার তো পরিবর্তন হয়নি। তাই রাতারাতি পরিবর্তন আশা করছি না।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, দুর্নীতির বিষয়টি খুবই গুরুতর। আমাদের প্রত্যাশা, যেসব তথ্য প্রকাশযোগ্য, সেগুলো যেন প্রকাশ করা হয়। বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পগুলোতেও কমবেশি দুর্নীতি হয়েছে। দেশীয় আমলাতন্ত্রের সঙ্গে বিদেশি আমলাতন্ত্রের যোগসাজশ হয়েছে।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনটি শুধু দেশীয় অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। যা দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়।
এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন টিআইবির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মো. জুলকারনাইন এবং গবেষণা সহযোগী মো. মোস্তফা কামাল। টিআইবি আশা করছে যে, তাদের এই প্রতিবেদন সরকারের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সহায়ক হবে।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির পরিচালক (আউটরিচ ও কমিউনিকেশন) তৌহিদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) সুমাইয়া খায়ের।