
বৈষম্য দূর করে শিক্ষাকে মানসম্মত করতে ‘শিক্ষা কমিশন’ গঠন করার কথা জানিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষার কনসালটেন্ট কমিটির আহ্বায়ক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদ। অন্যদিকে, নবম শ্রেণিতে নয় একাদশ শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি। গতকাল বুধবার গণসাক্ষরতা অভিযান আয়োজিত রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বৈষম্য দূরীকরণে শিক্ষায় নিরবচ্ছিন্ন রূপান্তর: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ শিরোনামে পলিসি ব্রিফ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। বেসরকারি শিক্ষা পরিবারের পক্ষে পলিসি ব্রিফ উপস্থাপন করা হয়। শিক্ষায় সংস্কার আনতে বর্তমান সরকার গত ৩০ সেপ্টেম্বর ড. মনজুর আহমদকে আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যের একটি কনসালটেন্ট (পরামর্শক) কমিটি গঠন করে। অনুষ্ঠানে শিক্ষায় সংস্কার নিয়ে বক্তব্য রাখেন তিনি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদ বলেন, নবম শ্রেণি থেকে বিভাগ (বিজ্ঞান, বাণিজ্য, কলা) বিভাজনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এত অল্প বয়সে (নবম-দশম) বিভাগ বিভাজনের বিষয়টি থেকে অন্যান্য দেশ সরে গেছে। আমাদের জন্যও এটি উপযুক্ত নয়, একাদশ থেকে হবে। সেটা হঠাৎ করে পরিবর্তন করা হলো। এটা কীভাবে হলো, কেন হলো? আগের জায়গায় চলে গেলো, সেটাই মনে হচ্ছে। এরকম ঢালাওভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক নয়, এটা বিচার-বিবেচনা করে করা উচিত, আমরা সেটাই বলতে চাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাওয়া দরকার। একটি কমিশন হোক, আলাপ-আলোচনা শুরু হোক, সিদ্ধান্তর একটি প্রক্রিয়া হোক, তারপর একটা পরামর্শ দেবে কীভাবে করতে হবে, মধ্যবর্তী ও লম্বা সময়ের জন্য। এখন নেই, তবে সেটি করা দরকার।কমিশন স্থায়ীভাবে করা হবে কিনা জানতে চাইলে ড. মনজুর আহমদ বলেন, ‘কমিশন স্থায়ী হবে কিনা এখন একটি কমিশন করে, আমরা সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি। স্থায়ী করার একটি সিদ্ধান্ত ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে ছিল। আগের সরকার সেদিকে যায়নি। এখন স্থায়ী হওয়া দরকার। বর্তমানে যেটি হবে, সেটিকে স্থায়ী করতে পারে। সেটার জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হতে হবে। পার্লামেন্টে বা যেভাবে হয়- সেই চিন্তা-ভাবনা মাথায় রেখে আমরা কাজ শুরু করি, তারপরে যেটা স্থায়ী হবে, বিধিবদ্ধভাবে হবে।’ প্রাথমিক শিক্ষার কনসালটেন্ট কমিটির সদস্য ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. ইরাম মারিয়াম বলেন, শিশুদের খেলার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। খেলার মাধ্যমে তাদের বিকাশ ঘটে।’ শিশুদের মানসিক অবস্থা বোঝার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, মন ভালো না থাকলে শিখন ভালো হয় না। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্যের যে বড় বিষয় সেটার স্বীকৃতি দিতে হবে। সেটার জন্য প্রস্তুতি দরকার। কেন দরকার? কারণ শিখনের সঙ্গে মনের একটি সম্পর্ক রয়েছে। আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অনেকেই যুক্ত ছিলেন, তাদের অনুভূতি কাজ করছে। সেটা চিহ্নিত করা দরকার, কাজ করা দরকার। ‘শিক্ষাক্রম হয় কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না’ এমন প্রসঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার কনসালটেন্ট কমিটির সদস্য ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. ইরাম মারিয়াম বলেন, ২০১৩ সাল থেকে দেখছি প্রাক-প্রাথমিক বাস্তবায়ন হচ্ছে। এখন দুই বছরের যে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম ২০২৪ সালে ৩ হাজার স্কুলে পাইলট হচ্ছে, ২০২৫ সালে সেটি ৫ হাজার স্কুলে হবে। অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য রাখেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, আমরা বারবার বলেছি, শিক্ষার কাঠামো ঠিক না করলে হবে না। শিক্ষার বড় অংশীদার শিক্ষার্থী, তাদের কথা চিন্তা না করে, দ্বিতীয় অংশীদার শিক্ষক তাদের কথা না ভেবে, তারপর অভিভাবকের কথা না চিন্তা করে কাঠামো ঠিক করা যাবে না। বাস্তবতা বিবেচনা করে নিরবচ্ছিন্ন রূপান্তর করতে হবে। বৈষম্য যে দানা বেঁধেছে, ক্রমাগত বাড়ছে, সেটা যেন নতুন করে শক্তিশালী না হয়- সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। সব বৈষম্য রাতারাতি দূর হবে না। শহর-গ্রামের বৈষম্য, ধনি-দরিদ্রের বৈষম্য রাতারাতি দূর হবে না। কিন্তু বৈষম্য নিরসনের পথে যাতে যেতে পারি। সংস্কারের রূপরেখাটা বৈষম্যহীন চান রাশেদা কে চৌধুরী। আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি, শিক্ষাকে অগ্রাধিকারে অগ্রাধিকারে রাখা হয়নি। শিক্ষা সাইডলাইনে চলে গেছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে শিক্ষা গুরুত্ব পায়নি। রাশেদা কে চৌধুরী আরও জানান, অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত প্রস্তাব ও সুপারিশমালা মন্ত্রণালয় ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের কাছে দেওয়া হবে। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা জৌতি এফ গমেজ, লালমাটিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আকমল হোসেন, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি শাহিনুর আল আমিন, এডুকেশন ওয়াচের আহ্বায়ক ড. আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে অংশ নেন। অনুষ্ঠানে শিক্ষায় রূপান্তরের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে লিখিত বক্তব্যে জানানো হয়, পৃথিবীর দেশগুলো তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। শিক্ষায় রূপান্তর এখন শুধু শিক্ষাক্রম বা নতুন পাঠ্যবই ছাপানোর কার্যক্রম নয়। একটি সার্বিক রূপান্তর প্রক্রিয়ায় শিখন-শেখানো পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিখন-শেখানো সামগ্রী প্রস্তুত, মূল্যায়ন প্রক্রিয়া প্রণয়ন এবং শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরিকল্পিত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এই নিরবচ্ছিন্ন এবং শিক্ষার সব স্তরে সামগ্রিকভাবে। শিক্ষার সব স্তরে সামঞ্জস্য বাজায় রেখে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত একটি নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষা কাঠামো তৈরি খুব জরুরি। শিক্ষা প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগ বিষয়ের সুপারিশে বলা হয়, সমন্বিত চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষা বিষয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের বদলে একক মন্ত্রণালয়ে নেতৃত্ব প্রয়োজন। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা ও গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে এবং বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় শিক্ষা রূপান্তর কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। মানসম্মত শিক্ষক ছাড়া শিক্ষায় কোনো উন্নয়ন টেকসই হবে না। এজন্য একটি সমন্বিত জাতীয় শিক্ষক উন্নয়ন রূপরেখা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশার জন্য প্রস্তুতি, নিয়োগ, পদোন্নতি, ক্ষমতায়ন, বেতন কাঠামো, মাননিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। বাংলাদেশের শিক্ষকদের মান নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্নতা রয়েছে। কাজেই অনেক শিক্ষক শিক্ষাক্রমের যেকোনও রূপান্তর বাস্তবায়ন করার জন্য প্রস্তুত নন। তাই বছরব্যাপী হাইব্রিড ট্রেনিংয়ের আয়োজন করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা এবং বেতন বৃদ্ধির ব্যবস্থা খুবই জরুরি। কারণ শিক্ষায় যেকোনও সংস্কার বাস্তবায়নে শিক্ষকদের মোটিভেশনের বিকল্প নেই। সংস্কার প্রসঙ্গে আরও বলা হয়, যেসব সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তার কোনোটিই ঠিকমত করা সম্ভব হবে না, যদি শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানো না হয়। শিক্ষায় রূপান্তর বা সংস্কার টেকসই করতে হলে জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বিনিয়োগ করতে হবে। লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে নবম শ্রেণি থেকে বিশেষায়িত বিভাগ বিভাজন শিক্ষায় ও সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করছে। শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্যের বড় ক্ষেত্র হলো বিজ্ঞান শিক্ষা। বিজ্ঞান শিক্ষার মৌলিক ধারণা লাভ সকল শিক্ষার্থীর জন্য অপরিহার্য কারণ, মানুষ বিজ্ঞান শেখে শুধু বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞান সংক্রান্ত পেশাজীবী হওয়ার জন্য নয়। বরং সকল শিক্ষার্থী বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা অর্জন করলে তার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনে বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতা অর্জন করে। বৈজ্ঞানিক পন্থা অনুসরণ করে সুনির্দিষ্ট ধাপ অনুসরণ করতে পারলে সৃজনশীল মানুষ তৈরি হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের প্রাথমিক কাজ হিসেবে ভর্তিপরীক্ষার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। মুখস্থনির্ভর লিখিত পরীক্ষার বদলে প্রবণতানির্ভর (অঢ়ঃরঃঁফব) টেস্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও সক্ষমতা অনুযায়ী উচ্চশিক্ষায় প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও গতানুগতিক কন্টেন্টনির্ভর কোর্সের বদলে গবেষণানির্ভর, প্রয়োগমুখী, সমস্যা সমাধাননির্ভর আন্তবিষয়ক মাইক্রো-ক্রেডেন্সিয়াল কোর্স চালু করা সময়ের দাবি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার মান ও শ্রমবাজারের দাবি অনুযায়ী শিক্ষার সংস্থান জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন যাতে তারা মনিটরিং, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং মার্কেট বেসিস ডিগ্রি বা কোর্স প্রণয়নে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারে।