গত তিন দিনে সারাদেশের বেশ কয়েকটি জেলায় বন্যায় অন্তত ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কুমিল্লায় ৪, ফেনীতে ১, চট্টগ্রামে ৫, নোয়াখালীতে ৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১, লক্ষ্মীপুরে ১ ও কক্সবাজারে ৩ জন রয়েছে। এছাড়া বন্যাকবলিত ১১ জেলায় মোট ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৫৪৮ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৯ জন। পানিবন্দি বা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের আশ্রয়দানের জন্য মোট ৩ হাজার ৫২৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ২ লাখ ৮৪ হাজার ৮৮৮ জন লোক এবং ২১ হাজার ৬৯৫টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৭৭০টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে। গতকাল শনিবার দুপুরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ কামরুল হাসান এতথ্য জানিয়েছে। তথ্য বিবরণীতে কামরুল হাসান বলেন, বৃষ্টি থামায় কিছু স্থান থেকে নামছে বানের পানি। তবে এখনও ৭টি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে বইছে।
অপরদিকে সচিবালয়ে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা বলেন, সবশেষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে ১১টি জেলার ৭৭টি উপজেলা। জেলাগুলো হলো- ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর এবং কক্সবাজার। এদিকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা নেই। বিভিন্ন নদ-নদীর পানি কমার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া আগামী ২৪ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলেও জানান তিনি। সচিব বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় এ পর্যন্ত নগদ ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং ২০ হাজার ১৫০ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ১৫ হাজার বস্তা শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া শিশুখাদ্যের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা এবং পশুখাদ্যের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা। ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য ৭৭০টি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলে জানানি তিনি।
অপরদিকে বিকেল ৩টায় বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) তথ্যমতে, গোমতী, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, মেঘনা ও হালদা নদীর পানি ১৭০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত কমেছে। এফএফডব্লিউসি বলছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি সমতল ধীরগতিতে কমছে। এদিকে ছয়টি নদীর ৯টি স্টেশনে এখনও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এরমধ্যে অমলশীদ (কুশিয়ারা) স্টেশনে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার, শেওলায় (কুশিয়ারা) ১ সেন্টিমিটার, শেরপুর-সিলেটে (কুশিয়ারা) ৮ সেন্টিমিটার, মারকুলীতে (কুশিয়ারা) ২ সেন্টিমিটার, মৌলভীবাজারে (মনু) ৭৫ সেন্টিমিটার, বাল্লায় (খোয়াই) ৩০ সেন্টিমিটার, কুমিল্লায় (গোমতী) ৯৪ সেন্টিমিটার, রামগড়ে (ফেনী) ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এখনও পরশুরাম (মুহুরী) স্টেশনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বিপৎসীমার নিচে থাকা স্টেশনগুলো হচ্ছে- হবিগঞ্জ (খোয়াই), মনু রেলওয়ে ব্রিজ (মনু), দেবীদ্বার (গোমতী), নারায়ণহাট (হালদা), পাঁচপুকুরিয়া (হালদা)। এছাড়া দেশের উজানে পানি সমতল যেসব স্টেশনে বিপৎসীমার নিচে রয়েছে, সেগুলো হলো মুহুরী (বিলোনিয়া-ত্রিপুরা), গোমতী (অমরপুর), ফেনী (সাবরুম)। সকাল ৯ টার পর দেশের উজানে ও দেশের অভ্যন্তরে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাতের রেকর্ড নেই। এফএফডব্লিউসির নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, গত ছয় ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ অববাহিকাসমূহে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত পরিলক্ষিত হয়নি এবং উজানের নদ-নদীর পানি সমতল কমা অব্যাহত আছে। ফলে বর্তমানে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত আছে।
আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ১৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদী সমূহের পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে এবং সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকতে পারে। আরও বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, উত্তরাঞ্চলের তিস্তা-ধরলা-দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এদিকে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ১০৮ এমএসএল পর্যন্ত বিপৎসীমার অবস্থা সৃষ্টি হয়। কাপ্তাই বাঁধের স্পিলওয়েগুলো গতকাল শনিবার দিবাগত রাত ১০টায় খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এজন্য ভাটি অঞ্চলকে জরুরি সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে। কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আবদুজ্জাহের স্বাক্ষরিত এক জরুরি বার্তায় এতথ্য জানানো হয়েছে।
আমাদের প্রতিনিধি পাঠানো তথ্য অনুযায়ী
বন্যায় আটকা অন্তঃসত্ত্বাকে উদ্ধার করলো সেনাবাহিনী : নোয়াখালীতে বন্যার পানিতে আটকা পড়া গুরুতর অসুস্থ অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। অসুস্থ ওই নারী বন্যার পানিতে কয়েকদিন নিমজ্জিত ছিলেন। গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সোনাপুর রেলস্টেশন এলাকা থেকে মুক্তা বেগম (২৩) নামে ওই নারীকে উদ্ধার করে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর ১৬ পদাতিকের সিইও লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশরাফ উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, পানিবন্দি পরিবার থেকে জরুরি ফোন পেয়ে তাৎক্ষণিক নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে গর্ভবতী ওই নারীকে উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। ওই নারীর স্বামী শাকিল আহমেদ বলেন, আমার স্ত্রী পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি পানিতে আটকা পড়ে ঠান্ডায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোনো উপায় না দেখে সেনাবাহিনীর নোয়াখালী ক্যাম্পে ফোন দিলে তারা দ্রুত তাকে উদ্ধার করেছেন। আমি সেনা সদস্যদের কাছে কৃতজ্ঞ। জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, নোয়াখালীর আট উপজেলার অন্তত ২০ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। জেলায় ৮২৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ। এ ছাড়া বন্যায় এ পর্যন্ত তিনজন নিহত হয়েছেন। অনেকে পানিবন্দি হয়ে নিজের বসতবাড়িতে আছেন। আমরা সবার মাঝে সরকারি সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। দুর্গত অনেক স্থানে এখনো লোকজন পানিবন্দি হয়ে আছেন। এখন খাবারসহ সুপেয় পানি দেওয়া ও পানিবাহিত রোগ থেকে মুক্তি আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেটি মোকাবিলায় আমাদের লোকজন কাজ করছে।
৯ হাজার বন্যাদুর্গতকে উদ্ধার করেছে সশস্ত্র বাহিনী : গত ২৪ ঘণ্টায় বন্যাকবলিত জেলাগুলো থেকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ও কন্টিনজেন্টগুলো ৫৫টি বোট ও হেলিকপ্টারের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে নয় হাজার বন্যাদুর্গত ব্যক্তিকে উদ্ধার করেছে। তাদের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। গতকাল শনিবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। আইএসপিআর জানায়, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বর্তমানে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং খাগড়াছড়িতে বন্যার্তদের উদ্ধার কার্যক্রমে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ও কন্টিনজেন্ট নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বন্যাদুর্গত এলাকা থেকে উদ্ধার ব্যক্তিদের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি প্রায় পাঁচ হাজার বন্যার্ত লোকের মাঝে ত্রাণ ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে চিকিৎসা সহায়তার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেডিকেল টিম মোতায়েন রয়েছে। আইএসপিআর আরও জানায়, বন্যাদুর্গত এলাকায় চিকিৎসা সেবা প্রদানের পাশাপাশি ২৩ আগস্ট ফেনীর ফুলগাজী থানা থেকে অন্তঃসত্ত্বা মোছাম্মৎ সুমি বেগমকে মুমূর্ষু অবস্থায় সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারের মাধ্যমে উদ্ধার করে কুমিল্লা সিএমএইচ এ প্রেরণ করা হলে তিনি পুত্র সন্তান প্রসব করেন। এছাড়াও সশস্ত্র বাহিনীর সব পদবীর সদস্যদের এক দিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বন্যার্তদের সহযোগিতায় প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে জমার পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী সদস্য কর্তৃক নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জরুরি ত্রাণ সংগ্রহের কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে। আইএসপিআর আরও জানায়, ২৩ আগস্ট সেনা ও বিমান বাহিনী প্রধান এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) হেলিকপ্টারযোগে বন্যাদুর্গত এলাকা পর্যবেক্ষণ করেন। এ সময় উদ্ধার কাজে নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনী সদস্যদের প্রয়োজনীয় দিক-নিদের্শনা প্রদান করা হয়।
মুহুরীতে নতুন করে বাড়ছে পানি : ভারী বৃষ্টির প্রবণতা কমে আসায় নদীর পানি নামতে শুরু করেছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে। তবে এখনও কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, গোমতি, ফেনী নদীর বেশ কয়েকটি স্টেশনের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে ফেনী অঞ্চলে মুহুরী নদীর পানি নতুন করে বিপদসীমার ওপরে উঠেছে। এই স্টেশনটি বন্যাকবলিত হওয়ায় যোগাযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে। তবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় যদি আর ভারী বৃষ্টি না হয় তাহলে এসব নদীর পানিও বিপদসীমার নিচে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, আজও দেশের ৬ নদীর ৯ স্টেশনের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, গত শুক্রবার সাত নদীর ১৪টি স্টেশনের পানি বিপদসীমার ওপরে ছিল। এরমধ্যে ফেনী নদীর রামগড় স্টেশনের পানি বিপদসীমার ২০০ থেকে কমে এখন ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। খোয়াই নদীর বাল্লা স্টেশনে পানি বিপদসীমার ১৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল, গতকাল শনিবার বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে, তবে একই নদীর হবিগঞ্জ স্টেশনে পানি গত শুক্রবার ছিল ১৬৫ সেন্টিমিটার ওপরে, গতকাল শনিবার তা বিপদসীমার নিচে নেমে গেছে। এদিকে গোমতির নদীর কুমিল্লা স্টেশনের পানি ছিল ১১৮ সেন্টিমিটার, তবে এখন তা কমে ৯৬ সেন্টিমিটারে নেমেছে। মনু নদীর মৌলভীবাজার স্টেশনে পানি ১১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল, এখন তা বইছে ৯১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। এদিকে নতুন করে মুহুরি নদীর পরশুরাম স্টেশনের পানি বিপদসীমার উপরে উঠেছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি বন্যা কবলিত এলাকা হওয়ায় যোগাযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। এদিকে সব মিলিয়ে কুশিয়ারা নদীর ৪ স্টেশনের পানি আজকেও বিপদসীমার ওপরে থাকলেও এখন পানির পরিমাণ কমে এসেছে। তাদের পূর্বাভাসে বলা হয়, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর পানি কমা অব্যাহত আছে। বিগত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ অববাহিকাগুলোর উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত পরিলক্ষিত হয়নি এবং উজানের নদ-নদীর পানি কমা অব্যাহত আছে। ফলে বর্তমানে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির গত শুক্রবার হতে উন্নতি শুরু হয়েছে এবং অব্যাহত আছে। আবহাওয়া সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা নেই। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীগুলোর পানি কমতে পারে এবং আশপাশের নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকতে পারে। একইরকম তথ্য দেওয়া হয়েছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানের এলাকার জন্যও। বলা হয়েছে, এ সময় এ অঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার মুহুরী, ফেনী, গোমতী, হালদা ইত্যাদি নদীগুলোর পানি কমতে পারে এবং আশেপাশের নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতিও অব্যাহত থাকতে পারে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি কমছে, অপরদিকে গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। ে দশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি কমছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল আছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় এই নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ বিরাজমান থাকতে পারে বলেও জানানো হয়েছে।
বন্যাকবলিত এলাকায় কমেছে বৃষ্টি : দেশের বন্যাকবলিত অনেক এলাকায় এখন আর বৃষ্টি নেই। গত ২৪ ঘণ্টায় যেসব এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে, তা আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। এতে বন্যার পানি কোথাও স্থিতিশীল, আবার কোথাও কোথাও কমতে শুরু করেছে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে বৃষ্টি কমে এলেও খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মৌসুমি বায়ুর অক্ষের বর্ধিতাংশ পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌসুমি বায়ু বংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি থেকে প্রবল অবস্থায় রয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বভাগের কিছুকিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় (সকাল ৬ পর্যন্ত) দেশে সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে ঈশ্বরদীতে ৬১ মিলিমিটার। গত শুক্রবার ঈশ্বরদীতেই ১৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। সে হিসেবে বৃষ্টির পরিমাণ কমে এসেছে। এদিকে কক্সবাজারে গত শুক্রবার ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি ছিল ১৫১ মিলিমিটার, গতকাল শনিবার ২৪ ঘণ্টায় তা কমে ৬ মিলিমিটারে নেমে আসে। একইভাবে আমবাগানে ছিল ১৪৩, গতকাল শনিবার শূন্য; রাঙ্গামাটিতে ছিল ৯৭, গতকাল শনিবার ২; চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ছিল ৯০, গতকাল শনিবার শূন্য; লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে ছিল ৯০, গতকাল শনিবার ৮; চট্টগ্রামে ছিল ৮৭, গতকাল শনিবার শূন্য; চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ৮৪, গতকাল শনিবার শূন্য; পটুয়াখালীর খেপুপাড়া ৮১, গতকাল শনিবার কমে ৪২; নোয়াখালীর মাইজদীকোর্টে ৭৩, গতকাল শনিবার ২০; নোয়াখালীর হাতিয়ায় ৭০, গতকাল শনিবার ৩; সাতক্ষীরায় ৬৬, গতকাল শনিবার ১৪; বরিশালে ৬৫, গতকাল শনিবার ২৭; খুলনায় ৬৩, গতকাল শনিবার ১; গোপালগঞ্জে ৬২, গতকাল শনিবার ১; বাগেরহাটের মোংলায় ৬০, গতকাল শনিবার ২; তাড়াশে গত ২৪ ঘণ্টায় ছিল ৫৯, গতকাল শনিবার সকাল ৬টায় পর্যন্ত শূন্য; ভোলায় ছিল ৪৯, গতকাল শনিবার ২৩; কুমিল্লায় ৪৯, গতকাল শনিবার শূন্য; যশোরে ৪৮, গতকাল শনিবার ৪; কক্সবাজারের টেকনাফে ৪৫, গতকাল শনিবার কিছুটা কমে ৪১; বগুড়া ৩৭, গতকাল শনিবার শূন্য; কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে ছিল ৩৬, গতকাল শনিবার ২০; বান্দরবানে ছিল ৩৬, গতকাল শনিবার ২; নওগাঁর বদলগাছিতে ৩৬, গতকাল শনিবার শূন্য; ময়মনসিংহে ৩৩, গতকাল শনিবার শূন্য; চাঁদপুরে ২৪, গতকাল শনিবার শূন্য মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এদিকে রাজশাহীতে গত শুক্রবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ১৮ মিলিমিটার, যা গতকাল শনিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ মিলিমিটার। এ ছাড়া ফরিদপুরে ছিল ১৫, গতকাল শনিবার ৪; পটুয়াখালী ছিল ১৪, গতকাল শনিবারও ১৪; কিশোরগঞ্জের নিকলিতে ১৩, গতকাল শনিবার ১; চুয়াডাঙ্গায় ১১, গতকাল শনিবার শূন্য; নেত্রকোনায় ১০, গতকাল শনিবার সামান্য; রংপুরে ৯, গতকাল শনিবার ছিল না; আরিচায় ৮, গতকাল শনিবার ৩; দিনাজপুরে ৮, গতকাল শনিবার শূন্য; ঢাকায় ৫, গতকাল শনিবার ১; নারায়ণগঞ্জ ছিল ৪, গতকাল শনিবার ৩; তবে টাঙ্গাইলে ছিল ৪, বেড়ে ১৫; সিলেটে ৩, গতকাল শনিবারও ৩; এদিকে খুলনার কয়রায় ছিল ২, তা বেড়ে গতকাল শনিবার ১১; মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ছিল ২, গতকাল শনিবার ৩; মাদারিপুরে ২, গতকাল শনিবার শূন্য, সৈয়দপুর ও নীলফামারীর ডিমলায় ছিল ২, গতকাল শনিবার শূন্য মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
লক্ষ্মীপুরে অবনতি : লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। হু হু করে বাড়ছে পানি, আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ। গত শুক্রবার থেকে বৃষ্টি না হলেও বাড়ছে পানি। পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী জেলার বন্যার পানি রহমতখালী খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরের লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ছে। এতে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছে স্থানীয় লোকজন। লক্ষ্মীপুরে গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে জেলার প্রায় বেশিরভাগ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তবে গত দুই ধরে বৃষ্টিপাত না হলেও পানির উচ্চতা বাড়তে থাকে। ফলে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জেলার সদর উপজেলার পৌর এলাকা, মান্দারী, চন্দ্রগঞ্জ, উত্তর জয়পুর, দত্তপাড়া, চরশাহী, কুশাখালী, তেওয়ারীগঞ্জ, ভবানীগঞ্জ, বাঙ্গাখা, পার্বতীনগর, টুমচর ইউনিয়ন এবং জেলার কমলনগরের চরকাদিরা ও রামগতি চর বাদাম, চর পোড়াগাছা ইউনিয়ন, রায়পুর এবং রামগঞ্জ উপজেলাতে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গৃহবধূ কাজল বেগমের ঘরে ভেতর হাঁটু সমান পানি। খাটের ওপরও পানি উঠে গেছে। তাই পরিবারের চার সদস্যদের নিয়ে উঠেছেন আশ্রয় কেন্দ্রে। তার বাড়ি লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের খালপাড় এলাকায়। তিনি আশ্রয় নিয়েছেন পৌর আইডিয়েল কলেজের ভবনে। কাজল বেগমের মতো ১৫০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে বিদ্যালয়টিতে। তাদের সবার বাড়ি পৌরসভার ২ নম্বর এবং ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে। পৌর আইডিয়েল কলেজে ছাড়াও স্থানীয় একটি মহিলা মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছে শতাধিক পরিবার। আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে জেসমিন, নয়ন ও রিনা বেগম বলেন, আমাদের সব ডুবে গেছে। ঘরের মধ্যে হাঁটুর ওপর পানি। থাকার মতো অবস্থা নাই। পরিবারের শিশু সন্তানদের নিয়ে ভয়ে ছিলাম। রান্নার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই বাধ্য হয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে আসছি। তারা আরও বলেন, আশ্রয় কেন্দ্রে কেউ কেউ শুকনো খাবার দিয়ে যাচ্ছে। তবে চাল না থাকায় ভাত রান্নার ব্যবস্থা ছিল না। শুকনো খাবার খেয়েই কোনোমতে দিন পার করছি। পৌর এলাকার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. সবুজ বলেন, ঘরের ভেতরে হাঁটু পানি। ঘরের সামনে কোমর পানি। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেক কষ্টে আছি। আমাদের আশেপাশের প্রায় প্রত্যেকের ঘরে পানি উঠে গেছে। চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে লোকজনকে। বৃষ্টি নেই, কিন্তু দিন দিন পানি বাড়ছে। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের যাদৈয়া গ্রামের বাসিন্দা শারমিন ও জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, বসতঘরের সামনে হাঁটু পানি। ঘরে এখনও ঢুকেনি। তবে যেভাবে পানির উচ্চতা বাড়ছে, যে কোনো সময় ঘরে পানি ঢুকতে পারে। বাড়ির আশপাশে সাপের উপদ্রব্য বেড়েছে। শিশু সন্তানদের নিয়ে আতঙ্কে আছি। তারা আরও জানায়, তাদের আশপাশের অনেক বসতঘরে পানি উঠে গেছে। তারা স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। রান্নার চুলো পানির নিচে তলিয়ে থাকায় খাবারের যোগান দিতে পারছেন না তারা। সব মিলিয়ে মানবেতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। চন্দ্রগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ও সাংবাদিক মোহাম্মদ হাসান বলেন, চন্দ্রগঞ্জ এবং উত্তর জয়পুরসহ আশপাশের গ্রামীণ জনপদ তলিয়ে গেছে। কারো ঘরে পানি উঠেছে। কেউ কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন, জেলার পাঁচ উপজেলার প্রায় ছয় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গতদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
অপরদিকে সচিবালয়ে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা বলেন, সবশেষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে ১১টি জেলার ৭৭টি উপজেলা। জেলাগুলো হলো- ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর এবং কক্সবাজার। এদিকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা নেই। বিভিন্ন নদ-নদীর পানি কমার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া আগামী ২৪ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলেও জানান তিনি। সচিব বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় এ পর্যন্ত নগদ ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং ২০ হাজার ১৫০ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ১৫ হাজার বস্তা শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া শিশুখাদ্যের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা এবং পশুখাদ্যের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা। ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য ৭৭০টি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলে জানানি তিনি।
অপরদিকে বিকেল ৩টায় বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) তথ্যমতে, গোমতী, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, মেঘনা ও হালদা নদীর পানি ১৭০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত কমেছে। এফএফডব্লিউসি বলছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি সমতল ধীরগতিতে কমছে। এদিকে ছয়টি নদীর ৯টি স্টেশনে এখনও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এরমধ্যে অমলশীদ (কুশিয়ারা) স্টেশনে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার, শেওলায় (কুশিয়ারা) ১ সেন্টিমিটার, শেরপুর-সিলেটে (কুশিয়ারা) ৮ সেন্টিমিটার, মারকুলীতে (কুশিয়ারা) ২ সেন্টিমিটার, মৌলভীবাজারে (মনু) ৭৫ সেন্টিমিটার, বাল্লায় (খোয়াই) ৩০ সেন্টিমিটার, কুমিল্লায় (গোমতী) ৯৪ সেন্টিমিটার, রামগড়ে (ফেনী) ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এখনও পরশুরাম (মুহুরী) স্টেশনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বিপৎসীমার নিচে থাকা স্টেশনগুলো হচ্ছে- হবিগঞ্জ (খোয়াই), মনু রেলওয়ে ব্রিজ (মনু), দেবীদ্বার (গোমতী), নারায়ণহাট (হালদা), পাঁচপুকুরিয়া (হালদা)। এছাড়া দেশের উজানে পানি সমতল যেসব স্টেশনে বিপৎসীমার নিচে রয়েছে, সেগুলো হলো মুহুরী (বিলোনিয়া-ত্রিপুরা), গোমতী (অমরপুর), ফেনী (সাবরুম)। সকাল ৯ টার পর দেশের উজানে ও দেশের অভ্যন্তরে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাতের রেকর্ড নেই। এফএফডব্লিউসির নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, গত ছয় ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ অববাহিকাসমূহে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত পরিলক্ষিত হয়নি এবং উজানের নদ-নদীর পানি সমতল কমা অব্যাহত আছে। ফলে বর্তমানে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত আছে।
আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ১৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদী সমূহের পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে এবং সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকতে পারে। আরও বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, উত্তরাঞ্চলের তিস্তা-ধরলা-দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এদিকে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ১০৮ এমএসএল পর্যন্ত বিপৎসীমার অবস্থা সৃষ্টি হয়। কাপ্তাই বাঁধের স্পিলওয়েগুলো গতকাল শনিবার দিবাগত রাত ১০টায় খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এজন্য ভাটি অঞ্চলকে জরুরি সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে। কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আবদুজ্জাহের স্বাক্ষরিত এক জরুরি বার্তায় এতথ্য জানানো হয়েছে।
আমাদের প্রতিনিধি পাঠানো তথ্য অনুযায়ী
বন্যায় আটকা অন্তঃসত্ত্বাকে উদ্ধার করলো সেনাবাহিনী : নোয়াখালীতে বন্যার পানিতে আটকা পড়া গুরুতর অসুস্থ অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। অসুস্থ ওই নারী বন্যার পানিতে কয়েকদিন নিমজ্জিত ছিলেন। গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সোনাপুর রেলস্টেশন এলাকা থেকে মুক্তা বেগম (২৩) নামে ওই নারীকে উদ্ধার করে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর ১৬ পদাতিকের সিইও লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশরাফ উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, পানিবন্দি পরিবার থেকে জরুরি ফোন পেয়ে তাৎক্ষণিক নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে গর্ভবতী ওই নারীকে উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। ওই নারীর স্বামী শাকিল আহমেদ বলেন, আমার স্ত্রী পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি পানিতে আটকা পড়ে ঠান্ডায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোনো উপায় না দেখে সেনাবাহিনীর নোয়াখালী ক্যাম্পে ফোন দিলে তারা দ্রুত তাকে উদ্ধার করেছেন। আমি সেনা সদস্যদের কাছে কৃতজ্ঞ। জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, নোয়াখালীর আট উপজেলার অন্তত ২০ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। জেলায় ৮২৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ। এ ছাড়া বন্যায় এ পর্যন্ত তিনজন নিহত হয়েছেন। অনেকে পানিবন্দি হয়ে নিজের বসতবাড়িতে আছেন। আমরা সবার মাঝে সরকারি সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। দুর্গত অনেক স্থানে এখনো লোকজন পানিবন্দি হয়ে আছেন। এখন খাবারসহ সুপেয় পানি দেওয়া ও পানিবাহিত রোগ থেকে মুক্তি আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেটি মোকাবিলায় আমাদের লোকজন কাজ করছে।
৯ হাজার বন্যাদুর্গতকে উদ্ধার করেছে সশস্ত্র বাহিনী : গত ২৪ ঘণ্টায় বন্যাকবলিত জেলাগুলো থেকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ও কন্টিনজেন্টগুলো ৫৫টি বোট ও হেলিকপ্টারের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে নয় হাজার বন্যাদুর্গত ব্যক্তিকে উদ্ধার করেছে। তাদের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। গতকাল শনিবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। আইএসপিআর জানায়, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বর্তমানে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং খাগড়াছড়িতে বন্যার্তদের উদ্ধার কার্যক্রমে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ও কন্টিনজেন্ট নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বন্যাদুর্গত এলাকা থেকে উদ্ধার ব্যক্তিদের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি প্রায় পাঁচ হাজার বন্যার্ত লোকের মাঝে ত্রাণ ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে চিকিৎসা সহায়তার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেডিকেল টিম মোতায়েন রয়েছে। আইএসপিআর আরও জানায়, বন্যাদুর্গত এলাকায় চিকিৎসা সেবা প্রদানের পাশাপাশি ২৩ আগস্ট ফেনীর ফুলগাজী থানা থেকে অন্তঃসত্ত্বা মোছাম্মৎ সুমি বেগমকে মুমূর্ষু অবস্থায় সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারের মাধ্যমে উদ্ধার করে কুমিল্লা সিএমএইচ এ প্রেরণ করা হলে তিনি পুত্র সন্তান প্রসব করেন। এছাড়াও সশস্ত্র বাহিনীর সব পদবীর সদস্যদের এক দিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বন্যার্তদের সহযোগিতায় প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে জমার পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী সদস্য কর্তৃক নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জরুরি ত্রাণ সংগ্রহের কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে। আইএসপিআর আরও জানায়, ২৩ আগস্ট সেনা ও বিমান বাহিনী প্রধান এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) হেলিকপ্টারযোগে বন্যাদুর্গত এলাকা পর্যবেক্ষণ করেন। এ সময় উদ্ধার কাজে নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনী সদস্যদের প্রয়োজনীয় দিক-নিদের্শনা প্রদান করা হয়।
মুহুরীতে নতুন করে বাড়ছে পানি : ভারী বৃষ্টির প্রবণতা কমে আসায় নদীর পানি নামতে শুরু করেছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে। তবে এখনও কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, গোমতি, ফেনী নদীর বেশ কয়েকটি স্টেশনের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে ফেনী অঞ্চলে মুহুরী নদীর পানি নতুন করে বিপদসীমার ওপরে উঠেছে। এই স্টেশনটি বন্যাকবলিত হওয়ায় যোগাযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে। তবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় যদি আর ভারী বৃষ্টি না হয় তাহলে এসব নদীর পানিও বিপদসীমার নিচে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, আজও দেশের ৬ নদীর ৯ স্টেশনের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, গত শুক্রবার সাত নদীর ১৪টি স্টেশনের পানি বিপদসীমার ওপরে ছিল। এরমধ্যে ফেনী নদীর রামগড় স্টেশনের পানি বিপদসীমার ২০০ থেকে কমে এখন ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। খোয়াই নদীর বাল্লা স্টেশনে পানি বিপদসীমার ১৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল, গতকাল শনিবার বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে, তবে একই নদীর হবিগঞ্জ স্টেশনে পানি গত শুক্রবার ছিল ১৬৫ সেন্টিমিটার ওপরে, গতকাল শনিবার তা বিপদসীমার নিচে নেমে গেছে। এদিকে গোমতির নদীর কুমিল্লা স্টেশনের পানি ছিল ১১৮ সেন্টিমিটার, তবে এখন তা কমে ৯৬ সেন্টিমিটারে নেমেছে। মনু নদীর মৌলভীবাজার স্টেশনে পানি ১১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল, এখন তা বইছে ৯১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। এদিকে নতুন করে মুহুরি নদীর পরশুরাম স্টেশনের পানি বিপদসীমার উপরে উঠেছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি বন্যা কবলিত এলাকা হওয়ায় যোগাযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। এদিকে সব মিলিয়ে কুশিয়ারা নদীর ৪ স্টেশনের পানি আজকেও বিপদসীমার ওপরে থাকলেও এখন পানির পরিমাণ কমে এসেছে। তাদের পূর্বাভাসে বলা হয়, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর পানি কমা অব্যাহত আছে। বিগত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ অববাহিকাগুলোর উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত পরিলক্ষিত হয়নি এবং উজানের নদ-নদীর পানি কমা অব্যাহত আছে। ফলে বর্তমানে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির গত শুক্রবার হতে উন্নতি শুরু হয়েছে এবং অব্যাহত আছে। আবহাওয়া সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা নেই। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীগুলোর পানি কমতে পারে এবং আশপাশের নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকতে পারে। একইরকম তথ্য দেওয়া হয়েছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানের এলাকার জন্যও। বলা হয়েছে, এ সময় এ অঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার মুহুরী, ফেনী, গোমতী, হালদা ইত্যাদি নদীগুলোর পানি কমতে পারে এবং আশেপাশের নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতিও অব্যাহত থাকতে পারে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি কমছে, অপরদিকে গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। ে দশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি কমছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল আছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় এই নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ বিরাজমান থাকতে পারে বলেও জানানো হয়েছে।
বন্যাকবলিত এলাকায় কমেছে বৃষ্টি : দেশের বন্যাকবলিত অনেক এলাকায় এখন আর বৃষ্টি নেই। গত ২৪ ঘণ্টায় যেসব এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে, তা আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। এতে বন্যার পানি কোথাও স্থিতিশীল, আবার কোথাও কোথাও কমতে শুরু করেছে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে বৃষ্টি কমে এলেও খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মৌসুমি বায়ুর অক্ষের বর্ধিতাংশ পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌসুমি বায়ু বংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি থেকে প্রবল অবস্থায় রয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বভাগের কিছুকিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় (সকাল ৬ পর্যন্ত) দেশে সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে ঈশ্বরদীতে ৬১ মিলিমিটার। গত শুক্রবার ঈশ্বরদীতেই ১৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। সে হিসেবে বৃষ্টির পরিমাণ কমে এসেছে। এদিকে কক্সবাজারে গত শুক্রবার ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি ছিল ১৫১ মিলিমিটার, গতকাল শনিবার ২৪ ঘণ্টায় তা কমে ৬ মিলিমিটারে নেমে আসে। একইভাবে আমবাগানে ছিল ১৪৩, গতকাল শনিবার শূন্য; রাঙ্গামাটিতে ছিল ৯৭, গতকাল শনিবার ২; চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ছিল ৯০, গতকাল শনিবার শূন্য; লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে ছিল ৯০, গতকাল শনিবার ৮; চট্টগ্রামে ছিল ৮৭, গতকাল শনিবার শূন্য; চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ৮৪, গতকাল শনিবার শূন্য; পটুয়াখালীর খেপুপাড়া ৮১, গতকাল শনিবার কমে ৪২; নোয়াখালীর মাইজদীকোর্টে ৭৩, গতকাল শনিবার ২০; নোয়াখালীর হাতিয়ায় ৭০, গতকাল শনিবার ৩; সাতক্ষীরায় ৬৬, গতকাল শনিবার ১৪; বরিশালে ৬৫, গতকাল শনিবার ২৭; খুলনায় ৬৩, গতকাল শনিবার ১; গোপালগঞ্জে ৬২, গতকাল শনিবার ১; বাগেরহাটের মোংলায় ৬০, গতকাল শনিবার ২; তাড়াশে গত ২৪ ঘণ্টায় ছিল ৫৯, গতকাল শনিবার সকাল ৬টায় পর্যন্ত শূন্য; ভোলায় ছিল ৪৯, গতকাল শনিবার ২৩; কুমিল্লায় ৪৯, গতকাল শনিবার শূন্য; যশোরে ৪৮, গতকাল শনিবার ৪; কক্সবাজারের টেকনাফে ৪৫, গতকাল শনিবার কিছুটা কমে ৪১; বগুড়া ৩৭, গতকাল শনিবার শূন্য; কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে ছিল ৩৬, গতকাল শনিবার ২০; বান্দরবানে ছিল ৩৬, গতকাল শনিবার ২; নওগাঁর বদলগাছিতে ৩৬, গতকাল শনিবার শূন্য; ময়মনসিংহে ৩৩, গতকাল শনিবার শূন্য; চাঁদপুরে ২৪, গতকাল শনিবার শূন্য মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এদিকে রাজশাহীতে গত শুক্রবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ১৮ মিলিমিটার, যা গতকাল শনিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ মিলিমিটার। এ ছাড়া ফরিদপুরে ছিল ১৫, গতকাল শনিবার ৪; পটুয়াখালী ছিল ১৪, গতকাল শনিবারও ১৪; কিশোরগঞ্জের নিকলিতে ১৩, গতকাল শনিবার ১; চুয়াডাঙ্গায় ১১, গতকাল শনিবার শূন্য; নেত্রকোনায় ১০, গতকাল শনিবার সামান্য; রংপুরে ৯, গতকাল শনিবার ছিল না; আরিচায় ৮, গতকাল শনিবার ৩; দিনাজপুরে ৮, গতকাল শনিবার শূন্য; ঢাকায় ৫, গতকাল শনিবার ১; নারায়ণগঞ্জ ছিল ৪, গতকাল শনিবার ৩; তবে টাঙ্গাইলে ছিল ৪, বেড়ে ১৫; সিলেটে ৩, গতকাল শনিবারও ৩; এদিকে খুলনার কয়রায় ছিল ২, তা বেড়ে গতকাল শনিবার ১১; মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ছিল ২, গতকাল শনিবার ৩; মাদারিপুরে ২, গতকাল শনিবার শূন্য, সৈয়দপুর ও নীলফামারীর ডিমলায় ছিল ২, গতকাল শনিবার শূন্য মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
লক্ষ্মীপুরে অবনতি : লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। হু হু করে বাড়ছে পানি, আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ। গত শুক্রবার থেকে বৃষ্টি না হলেও বাড়ছে পানি। পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী জেলার বন্যার পানি রহমতখালী খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরের লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ছে। এতে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছে স্থানীয় লোকজন। লক্ষ্মীপুরে গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে জেলার প্রায় বেশিরভাগ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তবে গত দুই ধরে বৃষ্টিপাত না হলেও পানির উচ্চতা বাড়তে থাকে। ফলে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জেলার সদর উপজেলার পৌর এলাকা, মান্দারী, চন্দ্রগঞ্জ, উত্তর জয়পুর, দত্তপাড়া, চরশাহী, কুশাখালী, তেওয়ারীগঞ্জ, ভবানীগঞ্জ, বাঙ্গাখা, পার্বতীনগর, টুমচর ইউনিয়ন এবং জেলার কমলনগরের চরকাদিরা ও রামগতি চর বাদাম, চর পোড়াগাছা ইউনিয়ন, রায়পুর এবং রামগঞ্জ উপজেলাতে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গৃহবধূ কাজল বেগমের ঘরে ভেতর হাঁটু সমান পানি। খাটের ওপরও পানি উঠে গেছে। তাই পরিবারের চার সদস্যদের নিয়ে উঠেছেন আশ্রয় কেন্দ্রে। তার বাড়ি লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের খালপাড় এলাকায়। তিনি আশ্রয় নিয়েছেন পৌর আইডিয়েল কলেজের ভবনে। কাজল বেগমের মতো ১৫০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে বিদ্যালয়টিতে। তাদের সবার বাড়ি পৌরসভার ২ নম্বর এবং ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে। পৌর আইডিয়েল কলেজে ছাড়াও স্থানীয় একটি মহিলা মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছে শতাধিক পরিবার। আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে জেসমিন, নয়ন ও রিনা বেগম বলেন, আমাদের সব ডুবে গেছে। ঘরের মধ্যে হাঁটুর ওপর পানি। থাকার মতো অবস্থা নাই। পরিবারের শিশু সন্তানদের নিয়ে ভয়ে ছিলাম। রান্নার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই বাধ্য হয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে আসছি। তারা আরও বলেন, আশ্রয় কেন্দ্রে কেউ কেউ শুকনো খাবার দিয়ে যাচ্ছে। তবে চাল না থাকায় ভাত রান্নার ব্যবস্থা ছিল না। শুকনো খাবার খেয়েই কোনোমতে দিন পার করছি। পৌর এলাকার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. সবুজ বলেন, ঘরের ভেতরে হাঁটু পানি। ঘরের সামনে কোমর পানি। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেক কষ্টে আছি। আমাদের আশেপাশের প্রায় প্রত্যেকের ঘরে পানি উঠে গেছে। চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে লোকজনকে। বৃষ্টি নেই, কিন্তু দিন দিন পানি বাড়ছে। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের যাদৈয়া গ্রামের বাসিন্দা শারমিন ও জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, বসতঘরের সামনে হাঁটু পানি। ঘরে এখনও ঢুকেনি। তবে যেভাবে পানির উচ্চতা বাড়ছে, যে কোনো সময় ঘরে পানি ঢুকতে পারে। বাড়ির আশপাশে সাপের উপদ্রব্য বেড়েছে। শিশু সন্তানদের নিয়ে আতঙ্কে আছি। তারা আরও জানায়, তাদের আশপাশের অনেক বসতঘরে পানি উঠে গেছে। তারা স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। রান্নার চুলো পানির নিচে তলিয়ে থাকায় খাবারের যোগান দিতে পারছেন না তারা। সব মিলিয়ে মানবেতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। চন্দ্রগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ও সাংবাদিক মোহাম্মদ হাসান বলেন, চন্দ্রগঞ্জ এবং উত্তর জয়পুরসহ আশপাশের গ্রামীণ জনপদ তলিয়ে গেছে। কারো ঘরে পানি উঠেছে। কেউ কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন, জেলার পাঁচ উপজেলার প্রায় ছয় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গতদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।