![](https://dainikjanata.net/public/postimages/66c42c3b41ee7.jpg)
আত্মগোপনে ঢাকা দুই সিটির ১১৮ কাউন্সিলর
২০৫ পৌরসভার মেয়র আত্মগোপনে আছেন
গা ঢাকা দিয়েছেন ৩১৯ উপজেলা চেয়ারম্যান
৬৪টির মধ্যে ৪৪ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আত্মগোপনে
৮৮৮ জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার
* পদ হারালেন পৌর মেয়ররাও, দায়িত্বে সরকারি কর্মকর্তারা
* চেয়ারম্যানরা বাদ, সব উপজেলা পরিষদের দায়িত্বে ইউএনও
* জেলা পরিষদে চেয়ারম্যানদের সরিয়ে বসানো হলো প্রশাসক
সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই সরকার রুটিন সরকার নয়। এটা একটা বিপ্লবের মাধ্যমে ছাত্র, জনতা, সেনা সবার সম্মিলিতভাবে দেশের প্রতিটি জায়গার মানুষের আন্দোলনের ফলে এই সরকার এসেছে
এ এফ হাসান আরিফ, উপদেষ্টা, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়
যাচাই-বাছাই করে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অপসারণের সিদ্ধান্ত
শাহিদুর রহমান শাহিদ
দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর স্থানীয় সরকার বিভাগের মোট ৮৮৮ জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করেছে আন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে ঢাকার দুই সিটি মেয়রসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়র রয়েছেন। এরই মধ্যে এই ১২টি সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এর আগে স্থানীয় সরকার বিভাগের পৃথক আদেশে দেশের ৪৯৩টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়। তাদের জায়গায় সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও তিন পার্বত্য জেলা বাদে সব জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে যেসব জেলায় বিভাগীয় শহর পড়েছে, সেখানে প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক)। পাশাপাশি দেশের সব পৌরসভার মেয়রদেরও অপসারণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আলাদা আলাদা আদেশ জারি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
যাচাই-বাছাই করে ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ারম্যান অপসারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও আতিকুল ইসলামসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়রদের তাদের পদ থেকে অপসারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল সোমবার স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সিটি করপোরেশনগুলো হচ্ছেÑঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, খুলনা সিটি করপোরেশন, রাজশাহী সিটি করপোরেশন, সিলেট সিটি করপোরেশন, বরিশাল, সিটি করপোরেশন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন, রংপুর সিটি করপোরেশন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন।
ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে অতিরিক্ত সচিব ও সমমর্যাদার চার কর্মকর্তাকে প্রশাসক করা হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনে বিভাগীয় কমিশনারদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এর আগে দেশের ৪৯৩ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করে তাদের জায়গায় সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গত রোববার স্থানীয় সরকার বিভাগের তিন প্রজ্ঞাপনে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
খুলনার কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান জি এম মোহসিন রেজা মারা যাওয়াই শূন্য ঘোষণা করা হয় তার পদটি।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের পাশাপাশি দেশের ৬০টি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সব পৌরসভার মেয়রকেও অপসারণ করে আদেশ জারি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
মৃত্যুর কারণে নাটোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ শূন্য করা হয়েছে।
আটটি জেলা পরিষদে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে (সার্বিক) এবং ৫৩টি জেলা পরিষদে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসককে (ডিসি) প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এসব কর্মকর্তা নিজ নিজ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করবেন।
জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের পাশাপাশি দেশের ৩২৩ পৌরসভার মেয়রকেও অপসারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সহকারী কমিশনার (ভূমি), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন পদবির সরকারি কর্মকর্তা এই দায়িত্ব পেয়েছেন।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের ৩৩০ পৌরসভার মধ্যে ৩২৩ পৌরসভার মেয়রকে অপসারণ করা হয়। বাকি সাত পৌরসভায় আগে থেকে প্রশাসক ছিল, যাদেরকে সরিয়ে নতুনদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এর আগে গত শুক্রবার ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ ও ‘উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। পরদিন গত শনিবার এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি।
ওই সংশোধনীর ফলে বিশেষ পরিস্থিতিতে অত্যাবশ্যক বিবেচনা করলে সরকার জনস্বার্থে কোনো সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র এবং কাউন্সিলরকে অপসারণ করতে পারবে। একইভাবে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের অপসারণ করতে পারবে। একই সঙ্গে এগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে সরকার।
যাচাই-বাছাই করে ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ারম্যান অপসারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের অপসারণের কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ইউনিয়ন পরিষদে এখন হাত দিচ্ছি না। যাচাই-বাছাই করে দেখা যাক সেখানে কার্যক্রম কি রকম আছে, যদি পরবর্তীকালে প্রয়োজন হয় বা প্রয়োজনের তাগিদে কোনো পদক্ষেপ নিতে হয় সেটি নেওয়া হবে। তিনি বলেন, আর দৈনন্দিন যে কাজগুলো নিয়ে প্রত্যেকের আগ্রহের জায়গা ছিল যেমন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনসহ অন্যান্য যে কাগুলো দৈনন্দিন করতে হয় সেগুলো যাতে চালু থাকে, গ্রামীণ পর্যায়ে যে উন্নয়ন কার্যক্রম যেন চলমান থাকে সেজন্য প্রথম দিকেই স্থানীয় যারা সরকারি কর্মচারী আছেন তাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে যান। জেলা ও উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার প্রায় সব শীর্ষ পদই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দখলে ছিল। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছিল। পরে বিকল্প ব্যবস্থা করে সরকার। যেমন উপজেলা চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকলে দায়িত্ব পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। এখন অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন সংশোধন করে মেয়র-চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ তৈরি করছে সরকার।
যাচাই-বাছাই করে ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ারম্যান অপসারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেন, সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের অসারণ করে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পৌরসভা, উপজেলা ও জেলা পরিষদেও প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই সরকার রুটিন সরকার নয়। এটা একটা বিপ্লবের মাধ্যমে ছাত্র, জনতা, সেনা সবার সম্মিলিতভাবে দেশের প্রতিটি জায়গার মানুষের আন্দোলনের ফলে এই সরকার এসেছে। তিনি বলেন, আমরা তাদেরই প্রতিনিধি। ছাত্র, জনতা, সেনার যে দাবি দাওয়া কার্যকরের জন্য আমাদের উপর বিশ্বাস রেখেছে সেটার আমরা প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করছি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের অপসারণের কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ইউনিয়ন পরিষদে এখন হাত দিচ্ছি না। যাচাই-বাছাই করে দেখা যাক সেখানে কার্যক্রম কি রকম আছে, যদি পরবর্তীকালে প্রয়োজন হয় বা প্রয়োজনের তাগিদে কোনো পদক্ষেপ নিতে হয় সেটি নেওয়া হবে। তিনি বলেন, আর দৈনন্দিন যে কাজগুলো নিয়ে প্রত্যেকের আগ্রহের জায়গা ছিল যেমন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনসহ অন্যান্য যে কাগুলো দৈনন্দিন করতে হয় সেগুলো যাতে চালু থাকে, গ্রামীণ পর্যায়ে যে উন্নয়ন কার্যক্রম যেন চলমান থাকে সেজন্য প্রথম দিকেই স্থানীয় যারা সরকারি কর্মচারী আছেন তাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় সরকারের সব স্তরেই আওয়ামী লীগ তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। জেলা ও উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার প্রায় সব শীর্ষ পদই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দখলে নেয়। গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর স্থানীয় সরকারের এই জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে যান। ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৪টির মধ্যে ৪৪টি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানই বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন। ৪৯৫টি উপজেলা পরিষদের ৩১৯টিতেই উপজেলা চেয়ারম্যানরা গা ঢাকা দেন। আর ৩৩০টির মধ্যে ২০৫টি পৌরসভার মেয়র আত্মগোপনে আছেন। এছাড়া অনেক জনপ্রতিনিধি এলাকায় থাকলেও কার্যালয়ে যান না। তবে আওয়ামী লীগের বাইরে বিএনপিসহ অন্য দলের যেসব জনপ্রতিনিধি রয়েছেন, তারা নিয়মিত কার্যালয়ে যান, করেন দাফতরিক কাজও।
দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে ৯টির মেয়র আত্মগোপনে রয়েছেন। রংপুরের মেয়র জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান, গাজীপুরের মেয়র জায়েদা খাতুন এবং নারায়ণগঞ্জের সেলিনা হায়াৎ আইভী নিয়মিত কার্যালয়ে যান।
তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে ১২৯ কাউন্সিলরের মধ্যে আত্মগোপনে আছেন ১১৮ জন।
আগে সব ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হতো। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৫ সালের আইন সংশোধন করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ার পর বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী দল স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জন করে। ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপুল সংখ্যায় সরকারদলীয় প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি কর্মস্থলে আসছেন না। তাদের অনুপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম প্রধান নির্বাহী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী প্রকৌশলীরা অফিস চালাচ্ছেন। তবে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা আত্মগোপনে থাকা জনপ্রতিনিধিদের কাছে থাকায় নিয়মিত কার্যক্রমও ব্যাহত হয়।
এ দিকে বাগেরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ কামরুজ্জামান টুকু আত্মগোপনে রয়েছেন। জেলার ৯টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানই আওয়ামী লীগদলীয় এবং তারা আত্মগোপনে আছেন। বাগেরহাট সদর, মোরেলগঞ্জ ও মোংলা পোর্ট-বাগেরহাটের তিনটি পৌরসভার মেয়রও আত্মগোপনে রয়েছেন।
শরীয়তপুরের জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পাঁচজন উপজেলা চেয়ারম্যান ও পাঁচজন পৌরসভার মেয়র আত্মগোপনে আছেন। মুন্সিগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মহিউদ্দিন ও ছয়টি উপজেলা পরিষদের সব কটির চেয়ারম্যান আত্মগোপনে রয়েছেন।
সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম আত্মগোপনে রয়েছেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও প্রধান নির্বাহী অফিসের চিঠিপত্র আদান-প্রদান করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ করছেন না। সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলা পরিষদের মধ্যে ছয়টির চেয়ারম্যান আত্মগোপনে। তারা সবাই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। কলারোয়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামও আত্মগোপনে।
রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মধ্যে রাজশাহী, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আত্মগোপনে আছেন। জয়পুরহাট ও নাটোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অসুস্থ হয়ে বাড়িতেই থাকেন। শুধু নওগাঁ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অফিস করছেন।
রাজশাহী বিভাগের ৬৭টি উপজেলা পরিষদের মধ্যে ৫৫টির চেয়ারম্যান আত্মগোপনে আছেন। অফিস করছেন মাত্র ৯ জন। বাকি তিনজন এলাকায় থাকলেও অফিস করেন না। আর এই বিভাগের ৬১টি পৌরসভার মধ্যে ৪২টি পৌরসভার মেয়র গা-ঢাকা দিয়ে আছেন।
কুমিল্লা সিটি মেয়র তাহসীন বাহার আত্মগোপনে আছেন। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছামছুল আলম জানান, তিনি সিটি করপোরেশনে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন। সিটি করপোরেশনের কয়েকজন কাউন্সিলর দেখা করে গেছেন। প্রতিটি বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হচ্ছে।
তবে সারা দেশের ব্যতিক্রম চিত্র গোপালগঞ্জে। গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতিয়ার রহমান মুন্সি এলাকায় আছেন এবং অফিস করছেন। পাঁচ উপজেলা চেয়ারম্যানই উপজেলায় আছেন এবং কাজ করছেন। চারজন পৌর মেয়রও এলাকায় আছেন।
এ ছাড়া সাভার পৌরসভার মেয়র মো. আব্দুল গণি, ধামরাই পৌরসভার মেয়র গোলাম কবির ও দোহার পৌরসভার মেয়র আলমাছ উদ্দিন আত্মগোপনে আছেন। পৌরসভার কর্মকর্তারা জানান, যেসব নথিপত্রে মেয়রের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়, সেগুলোর কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিনই জন্মনিবন্ধন, নাগরিক সনদ ও নানা কাজে এসে ফিরে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
ঢাকার পাঁচটি উপজেলা পরিষদের মধ্যে চারটির চেয়ারম্যান ৫ আগস্ট থেকে গা ঢাকা দিয়ে আছেন। সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম, কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীন আহমেদ, দোহার উপজেলা চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন এবং নবাবগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ আত্মগোপনে রয়েছেন।
এ ছাড়া সাভার পৌরসভার মেয়র মো. আব্দুল গণি, ধামরাই পৌরসভার মেয়র গোলাম কবির ও দোহার পৌরসভার মেয়র আলমাছ উদ্দিন আত্মগোপনে আছেন। পৌরসভার কর্মকর্তারা জানান, যেসব নথিপত্রে মেয়রের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়, সেগুলোর কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিনই জন্মনিবন্ধন, নাগরিক সনদ ও নানা কাজে এসে ফিরে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
রংপুর বিভাগের আট জেলার মধ্যে ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আত্মগোপনে। রংপুর ও গাইবান্ধা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এলাকায় থাকলেও অফিস করছেন না। লালমনিরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চিকিৎসার কাজে ভারতে গিয়ে সেখানেই অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
রংপুর বিভাগের ৫৮টি উপজেলার মধ্যে ২৮ জন আত্মগোপনে আছেন। ২৯ জন এলাকায় থাকলেও তাদের মধ্যে মাত্র ১২ জন অফিস করছেন। বাকি একটি উপজেলা চেয়ারম্যানের শপথ স্থগিত আছে। এই বিভাগের ৩১টি পৌরসভার মধ্যে ১৫টির মেয়র আত্মগোপনে আছেন। বাকি ১৬ জন এলাকায় থাকলেও তাদের মধ্যে ৯ জন অফিস করছেন।
২০৫ পৌরসভার মেয়র আত্মগোপনে আছেন
গা ঢাকা দিয়েছেন ৩১৯ উপজেলা চেয়ারম্যান
৬৪টির মধ্যে ৪৪ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আত্মগোপনে
৮৮৮ জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার
* পদ হারালেন পৌর মেয়ররাও, দায়িত্বে সরকারি কর্মকর্তারা
* চেয়ারম্যানরা বাদ, সব উপজেলা পরিষদের দায়িত্বে ইউএনও
* জেলা পরিষদে চেয়ারম্যানদের সরিয়ে বসানো হলো প্রশাসক
সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই সরকার রুটিন সরকার নয়। এটা একটা বিপ্লবের মাধ্যমে ছাত্র, জনতা, সেনা সবার সম্মিলিতভাবে দেশের প্রতিটি জায়গার মানুষের আন্দোলনের ফলে এই সরকার এসেছে
এ এফ হাসান আরিফ, উপদেষ্টা, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়
যাচাই-বাছাই করে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অপসারণের সিদ্ধান্ত
শাহিদুর রহমান শাহিদ
দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর স্থানীয় সরকার বিভাগের মোট ৮৮৮ জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করেছে আন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে ঢাকার দুই সিটি মেয়রসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়র রয়েছেন। এরই মধ্যে এই ১২টি সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এর আগে স্থানীয় সরকার বিভাগের পৃথক আদেশে দেশের ৪৯৩টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়। তাদের জায়গায় সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও তিন পার্বত্য জেলা বাদে সব জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে যেসব জেলায় বিভাগীয় শহর পড়েছে, সেখানে প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক)। পাশাপাশি দেশের সব পৌরসভার মেয়রদেরও অপসারণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আলাদা আলাদা আদেশ জারি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
যাচাই-বাছাই করে ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ারম্যান অপসারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও আতিকুল ইসলামসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়রদের তাদের পদ থেকে অপসারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল সোমবার স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সিটি করপোরেশনগুলো হচ্ছেÑঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, খুলনা সিটি করপোরেশন, রাজশাহী সিটি করপোরেশন, সিলেট সিটি করপোরেশন, বরিশাল, সিটি করপোরেশন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন, রংপুর সিটি করপোরেশন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন।
ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে অতিরিক্ত সচিব ও সমমর্যাদার চার কর্মকর্তাকে প্রশাসক করা হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনে বিভাগীয় কমিশনারদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এর আগে দেশের ৪৯৩ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করে তাদের জায়গায় সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গত রোববার স্থানীয় সরকার বিভাগের তিন প্রজ্ঞাপনে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
খুলনার কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান জি এম মোহসিন রেজা মারা যাওয়াই শূন্য ঘোষণা করা হয় তার পদটি।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের পাশাপাশি দেশের ৬০টি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সব পৌরসভার মেয়রকেও অপসারণ করে আদেশ জারি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
মৃত্যুর কারণে নাটোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ শূন্য করা হয়েছে।
আটটি জেলা পরিষদে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে (সার্বিক) এবং ৫৩টি জেলা পরিষদে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসককে (ডিসি) প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এসব কর্মকর্তা নিজ নিজ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করবেন।
জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের পাশাপাশি দেশের ৩২৩ পৌরসভার মেয়রকেও অপসারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সহকারী কমিশনার (ভূমি), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন পদবির সরকারি কর্মকর্তা এই দায়িত্ব পেয়েছেন।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের ৩৩০ পৌরসভার মধ্যে ৩২৩ পৌরসভার মেয়রকে অপসারণ করা হয়। বাকি সাত পৌরসভায় আগে থেকে প্রশাসক ছিল, যাদেরকে সরিয়ে নতুনদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এর আগে গত শুক্রবার ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ ও ‘উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। পরদিন গত শনিবার এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি।
ওই সংশোধনীর ফলে বিশেষ পরিস্থিতিতে অত্যাবশ্যক বিবেচনা করলে সরকার জনস্বার্থে কোনো সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র এবং কাউন্সিলরকে অপসারণ করতে পারবে। একইভাবে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের অপসারণ করতে পারবে। একই সঙ্গে এগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে সরকার।
যাচাই-বাছাই করে ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ারম্যান অপসারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের অপসারণের কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ইউনিয়ন পরিষদে এখন হাত দিচ্ছি না। যাচাই-বাছাই করে দেখা যাক সেখানে কার্যক্রম কি রকম আছে, যদি পরবর্তীকালে প্রয়োজন হয় বা প্রয়োজনের তাগিদে কোনো পদক্ষেপ নিতে হয় সেটি নেওয়া হবে। তিনি বলেন, আর দৈনন্দিন যে কাজগুলো নিয়ে প্রত্যেকের আগ্রহের জায়গা ছিল যেমন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনসহ অন্যান্য যে কাগুলো দৈনন্দিন করতে হয় সেগুলো যাতে চালু থাকে, গ্রামীণ পর্যায়ে যে উন্নয়ন কার্যক্রম যেন চলমান থাকে সেজন্য প্রথম দিকেই স্থানীয় যারা সরকারি কর্মচারী আছেন তাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে যান। জেলা ও উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার প্রায় সব শীর্ষ পদই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দখলে ছিল। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছিল। পরে বিকল্প ব্যবস্থা করে সরকার। যেমন উপজেলা চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকলে দায়িত্ব পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। এখন অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন সংশোধন করে মেয়র-চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ তৈরি করছে সরকার।
যাচাই-বাছাই করে ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ারম্যান অপসারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেন, সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের অসারণ করে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পৌরসভা, উপজেলা ও জেলা পরিষদেও প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই সরকার রুটিন সরকার নয়। এটা একটা বিপ্লবের মাধ্যমে ছাত্র, জনতা, সেনা সবার সম্মিলিতভাবে দেশের প্রতিটি জায়গার মানুষের আন্দোলনের ফলে এই সরকার এসেছে। তিনি বলেন, আমরা তাদেরই প্রতিনিধি। ছাত্র, জনতা, সেনার যে দাবি দাওয়া কার্যকরের জন্য আমাদের উপর বিশ্বাস রেখেছে সেটার আমরা প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করছি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের অপসারণের কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ইউনিয়ন পরিষদে এখন হাত দিচ্ছি না। যাচাই-বাছাই করে দেখা যাক সেখানে কার্যক্রম কি রকম আছে, যদি পরবর্তীকালে প্রয়োজন হয় বা প্রয়োজনের তাগিদে কোনো পদক্ষেপ নিতে হয় সেটি নেওয়া হবে। তিনি বলেন, আর দৈনন্দিন যে কাজগুলো নিয়ে প্রত্যেকের আগ্রহের জায়গা ছিল যেমন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনসহ অন্যান্য যে কাগুলো দৈনন্দিন করতে হয় সেগুলো যাতে চালু থাকে, গ্রামীণ পর্যায়ে যে উন্নয়ন কার্যক্রম যেন চলমান থাকে সেজন্য প্রথম দিকেই স্থানীয় যারা সরকারি কর্মচারী আছেন তাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় সরকারের সব স্তরেই আওয়ামী লীগ তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। জেলা ও উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার প্রায় সব শীর্ষ পদই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দখলে নেয়। গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর স্থানীয় সরকারের এই জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে যান। ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৪টির মধ্যে ৪৪টি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানই বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন। ৪৯৫টি উপজেলা পরিষদের ৩১৯টিতেই উপজেলা চেয়ারম্যানরা গা ঢাকা দেন। আর ৩৩০টির মধ্যে ২০৫টি পৌরসভার মেয়র আত্মগোপনে আছেন। এছাড়া অনেক জনপ্রতিনিধি এলাকায় থাকলেও কার্যালয়ে যান না। তবে আওয়ামী লীগের বাইরে বিএনপিসহ অন্য দলের যেসব জনপ্রতিনিধি রয়েছেন, তারা নিয়মিত কার্যালয়ে যান, করেন দাফতরিক কাজও।
দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে ৯টির মেয়র আত্মগোপনে রয়েছেন। রংপুরের মেয়র জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান, গাজীপুরের মেয়র জায়েদা খাতুন এবং নারায়ণগঞ্জের সেলিনা হায়াৎ আইভী নিয়মিত কার্যালয়ে যান।
তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে ১২৯ কাউন্সিলরের মধ্যে আত্মগোপনে আছেন ১১৮ জন।
আগে সব ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হতো। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৫ সালের আইন সংশোধন করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ার পর বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী দল স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জন করে। ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপুল সংখ্যায় সরকারদলীয় প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি কর্মস্থলে আসছেন না। তাদের অনুপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম প্রধান নির্বাহী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী প্রকৌশলীরা অফিস চালাচ্ছেন। তবে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা আত্মগোপনে থাকা জনপ্রতিনিধিদের কাছে থাকায় নিয়মিত কার্যক্রমও ব্যাহত হয়।
এ দিকে বাগেরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ কামরুজ্জামান টুকু আত্মগোপনে রয়েছেন। জেলার ৯টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানই আওয়ামী লীগদলীয় এবং তারা আত্মগোপনে আছেন। বাগেরহাট সদর, মোরেলগঞ্জ ও মোংলা পোর্ট-বাগেরহাটের তিনটি পৌরসভার মেয়রও আত্মগোপনে রয়েছেন।
শরীয়তপুরের জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পাঁচজন উপজেলা চেয়ারম্যান ও পাঁচজন পৌরসভার মেয়র আত্মগোপনে আছেন। মুন্সিগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মহিউদ্দিন ও ছয়টি উপজেলা পরিষদের সব কটির চেয়ারম্যান আত্মগোপনে রয়েছেন।
সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম আত্মগোপনে রয়েছেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও প্রধান নির্বাহী অফিসের চিঠিপত্র আদান-প্রদান করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ করছেন না। সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলা পরিষদের মধ্যে ছয়টির চেয়ারম্যান আত্মগোপনে। তারা সবাই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। কলারোয়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামও আত্মগোপনে।
রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মধ্যে রাজশাহী, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আত্মগোপনে আছেন। জয়পুরহাট ও নাটোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অসুস্থ হয়ে বাড়িতেই থাকেন। শুধু নওগাঁ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অফিস করছেন।
রাজশাহী বিভাগের ৬৭টি উপজেলা পরিষদের মধ্যে ৫৫টির চেয়ারম্যান আত্মগোপনে আছেন। অফিস করছেন মাত্র ৯ জন। বাকি তিনজন এলাকায় থাকলেও অফিস করেন না। আর এই বিভাগের ৬১টি পৌরসভার মধ্যে ৪২টি পৌরসভার মেয়র গা-ঢাকা দিয়ে আছেন।
কুমিল্লা সিটি মেয়র তাহসীন বাহার আত্মগোপনে আছেন। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছামছুল আলম জানান, তিনি সিটি করপোরেশনে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন। সিটি করপোরেশনের কয়েকজন কাউন্সিলর দেখা করে গেছেন। প্রতিটি বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হচ্ছে।
তবে সারা দেশের ব্যতিক্রম চিত্র গোপালগঞ্জে। গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতিয়ার রহমান মুন্সি এলাকায় আছেন এবং অফিস করছেন। পাঁচ উপজেলা চেয়ারম্যানই উপজেলায় আছেন এবং কাজ করছেন। চারজন পৌর মেয়রও এলাকায় আছেন।
এ ছাড়া সাভার পৌরসভার মেয়র মো. আব্দুল গণি, ধামরাই পৌরসভার মেয়র গোলাম কবির ও দোহার পৌরসভার মেয়র আলমাছ উদ্দিন আত্মগোপনে আছেন। পৌরসভার কর্মকর্তারা জানান, যেসব নথিপত্রে মেয়রের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়, সেগুলোর কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিনই জন্মনিবন্ধন, নাগরিক সনদ ও নানা কাজে এসে ফিরে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
ঢাকার পাঁচটি উপজেলা পরিষদের মধ্যে চারটির চেয়ারম্যান ৫ আগস্ট থেকে গা ঢাকা দিয়ে আছেন। সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম, কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীন আহমেদ, দোহার উপজেলা চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন এবং নবাবগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ আত্মগোপনে রয়েছেন।
এ ছাড়া সাভার পৌরসভার মেয়র মো. আব্দুল গণি, ধামরাই পৌরসভার মেয়র গোলাম কবির ও দোহার পৌরসভার মেয়র আলমাছ উদ্দিন আত্মগোপনে আছেন। পৌরসভার কর্মকর্তারা জানান, যেসব নথিপত্রে মেয়রের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়, সেগুলোর কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিনই জন্মনিবন্ধন, নাগরিক সনদ ও নানা কাজে এসে ফিরে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
রংপুর বিভাগের আট জেলার মধ্যে ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আত্মগোপনে। রংপুর ও গাইবান্ধা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এলাকায় থাকলেও অফিস করছেন না। লালমনিরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চিকিৎসার কাজে ভারতে গিয়ে সেখানেই অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
রংপুর বিভাগের ৫৮টি উপজেলার মধ্যে ২৮ জন আত্মগোপনে আছেন। ২৯ জন এলাকায় থাকলেও তাদের মধ্যে মাত্র ১২ জন অফিস করছেন। বাকি একটি উপজেলা চেয়ারম্যানের শপথ স্থগিত আছে। এই বিভাগের ৩১টি পৌরসভার মধ্যে ১৫টির মেয়র আত্মগোপনে আছেন। বাকি ১৬ জন এলাকায় থাকলেও তাদের মধ্যে ৯ জন অফিস করছেন।