সরকারের গতির জন্য প্রশাসন অন্যতম ভূমিকা রাখে। প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা সাবেক সরকারের কট্টর সমর্থক বলে পরিচিত, তাদের হয়তো ওএসডি বা কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন করা হতে পারে
মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বাংলাদেশ সচিবালয়ের শীর্ষ পদ, বিভিন্ন সংস্থা বা দফতর ও মাঠ প্রশাসনে বড় ধরনের পরিবর্তন চলছে। বিগত সরকারের আস্থাভাজন কর্তাব্যক্তিদের সরিয়ে ১৬ বছর ধরে বঞ্চিত যোগ্য ও তুলনামূলক নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ইমেজের কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হচ্ছে। প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে প্রতিটি স্তরেই রদবদল শুরু করেছে নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এছাড়াও পুলিশে আইজিপি, এসবি, র্যাব, পুলিশ কমিশনার পরিবর্তন করা হয়েছে। এছাড়াও সব জেলায় পুলিশ সুপারসহ থানায়ও পরিবর্তন আসছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরদিন থেকেই দেখা যায়, পদোন্নতি বঞ্চিত বিভিন্ন ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা সচিবালয়ে প্রতিদিনই আন্দোলন করছেন। জনপ্রশাসন সচিব ও প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে।
তবে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া মোট ১৯ জন পূর্ণ সচিবের মধ্যে ১০ জনের নিয়োগ ১৪ আগস্ট বাতিল করা হয়েছে। বাকিদের নিয়োগও বাতিল হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। সংশ্লিষ্টরা আরো জানিয়েছেন, নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েই সংস্কার কাজে হাত দিয়েছে। এর অংশ হিসেবে ঢেলে সাজানো হবে প্রশাসন। অপরদিকে বঞ্চিতদের পক্ষে থেকে বলা হচ্ছে শেখ হাসিনার শাসনামলে যারা তার আস্থাভাজন কর্মকর্তা বলে পরিচিত, গণপূর্ত অধিদফতর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর. এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীসহ বেশ কয়েকটি অধিদফতরের প্রধান এখনো বহাল তবিয়তে কাজ করছে ।
অপরদিকে বিগত সরকারের আস্থাভাজন কর্তাব্যক্তিদের সরিয়ে ১৬ বছর ধরে বঞ্চিত যোগ্য ও তুলনামূলক নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ইমেজের কর্মকর্তাদের পদায়ন হতে পারে। বিশেষ করে মাঠ প্রশাসনের বিভাগীয় কমিশনার, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগ সরকার আমলের সচিবদের ওএসডি করে নতুন করে সচিব পদায়ন করলে কাজের গতি পাবে এই সরকার। বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পুরোপুরি সফল হতে হলে পুরোনো প্রশাসন বহাল রাখা কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। কারণ তারা আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী। তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চেষ্টা করবে। দ্রুত তাদের সরিয়ে বিভিন্ন সময়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিতে হবে।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের এ তালিকায় রয়েছেন- জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিম, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব কে এম আব্দুস সালাম, সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব এ বি এম আমিনুল্লাহ নুরী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া, পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিৎ কর্মকার, বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম ওয়াহিদা আক্তার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আলী হোসেন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী সদস্য (সচিব) মো. খাইরুল ইসলাম।
এছাড়া প্রশাসনে যারা শেখ হাসিনা সরকারের আস্থাভাজন ও প্রভাবশালী বলে পরিচিত সিনিয়র সচিব ও সচিব, তাদেরও বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হতে পারে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও দফতর থেকে বদলি করে কম গুরুত্বপূর্ণ দফতরেও পাঠানো হতে পারে কাউকে কাউকে। প্রশাসনে অসংখ্য কর্মকর্তা আছেন যাদের শুধু রাজনৈতিক কারণেই পদোন্নতি দেয়া হয়নি।
পদোন্নতি বঞ্চিত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ফোরামের সভাপতি বিসিএস ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমার ব্যাচমেটরা দেড় বছর আগেই সচিব হয়েছেন। অথচ আমি এখনো সিনিয়র সহকারী সচিব পদে আছি। ভালো দক্ষ কর্মকর্তা বলে আমাকে ওএসডি করা হয়নি। রাজনৈতিক তকমা দিয়ে আমাকে ১৬ বছর পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে। আমার কপালে কোনো পদোন্নতি জোটেনি। আমার মতো প্রশাসনে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন, যারা ১৬ বছর ধরে একই পদে কর্মরত। শত শত কর্মকর্তা বছরের পর বছর ওএসডি থেকে অবসরে গেছেন। আমরা এ সরকারের কাছে প্রতিকার চাই। আমাদের মতো যারা পদোন্নতি বঞ্চিত, তাদের দ্রুত পদোন্নতি দিতে হবে। এদিকে মাঠ প্রশাসনে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক হিসেবে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়, তাদের সরকারের আস্থাভাজন ও দক্ষ কর্মকর্তা বলেই মনে করা হয়। বর্তমানে বিভাগীয় কমিশনার পদে ঢাকা ও খুলনার বিভাগীয় কমিশনার ১৫তম ব্যাচের এবং বাকিগুলোতে ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া জেলা প্রশাসক পদে বর্তমানে বিসিএস ২৪, ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের অনেকে ঢাকায় ফেরার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, সরকারের গতির জন্য প্রশাসন অন্যতম ভূমিকা রাখে। প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা সাবেক সরকারের কট্টর সমর্থক বলে পরিচিত, তাদের হয়তো ওএসডি বা কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন করা হতে পারে। যারা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত, তারা পদোন্নতি না পাওয়া পর্যন্ত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যোগ্যতার অভাবে পোস্টিং পাবেন না। সে ক্ষেত্রে প্রশাসনের নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ইমেজের কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে পারেন।
এদিকে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ফের বঞ্চিত করা হচ্ছে অভিযোগ করে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিসট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বাসা)। সংগঠনটির দাবি, বিগত অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকারের দোসর ও ছাত্র-জনতার ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে বাধাদানকারী একইসঙ্গে ছাত্র-জনতাকে মদদ দানকারী কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে তাদের মধ্য থেকেই পদায়ন করা হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যবৃন্দ গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, স্বৈরাচারী সরকারের পতনের এক সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও জনপ্রশাসনে তাদের দোসররাই দোর্দণ্ড প্রতাপে প্রশাসনের কলকাঠি নাড়ছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের দর্শন ও জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন হিসেবে নিরপেক্ষ, দক্ষ ও পেশাদার জনপ্রশাসন গড়ে তোলার প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা পুনঃ আবির্ভূত হয়েছেন।
জনপ্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে সাজানোর পরিবর্তে বিগত অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকারের দোসর এবং ছাত্র-জনতার ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে বাধাদানকারী এবং ছাত্র হত্যার মদদ দানকারী কর্মকর্তাদের দিয়েই জনপ্রশাসন সাজানোর পাঁয়তারা চলছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল এবং আপামর জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হিসেবে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন এবং পতিত সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে তারা জনপ্রশাসন ঢেলে সাজানোর নামে তাদেরই মদদপুষ্ট কর্মকর্তাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পদায়ন করছে। বিগত অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকারের সময়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের আবারও বঞ্চিত রেখেই সুবিধাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হচ্ছে।
এতে আরও বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এখনো পদত্যাগ করছেন না কোনো সচিব। বরং গত ৩ আগস্ট সচিব সভায় যে সকল সচিব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে দমন করার শপথ গ্রহণ করেছেন এবং স্বৈরাচারী সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করেছেন তারা এখনো বহাল আছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বর্ণচোরা দলদাস কর্মকর্তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে এখনো সরিয়ে দেয়া হয়নি। ফলে শত শত শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত দ্বিতীয় স্বাধীনতা উক্ত মহল বিশেষের চক্রান্তে নস্যাৎ হয়ে যাওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছে।
অপরদিকে অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেছেন, সকল পর্যায়ের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, বিগত অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকারের দোসর কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অপসারণ এবং বিগত ১৬ বছরে অন্যায়ভাবে পদোন্নতি ও বঞ্চনার শিকার সকল কর্মকর্তাদের দ্রুত পদোন্নতি প্রদানপূর্বক উপযুক্ত পদে পদায়ন করার জোর দাবি জানানো হয়।
মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বাংলাদেশ সচিবালয়ের শীর্ষ পদ, বিভিন্ন সংস্থা বা দফতর ও মাঠ প্রশাসনে বড় ধরনের পরিবর্তন চলছে। বিগত সরকারের আস্থাভাজন কর্তাব্যক্তিদের সরিয়ে ১৬ বছর ধরে বঞ্চিত যোগ্য ও তুলনামূলক নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ইমেজের কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হচ্ছে। প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে প্রতিটি স্তরেই রদবদল শুরু করেছে নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এছাড়াও পুলিশে আইজিপি, এসবি, র্যাব, পুলিশ কমিশনার পরিবর্তন করা হয়েছে। এছাড়াও সব জেলায় পুলিশ সুপারসহ থানায়ও পরিবর্তন আসছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরদিন থেকেই দেখা যায়, পদোন্নতি বঞ্চিত বিভিন্ন ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা সচিবালয়ে প্রতিদিনই আন্দোলন করছেন। জনপ্রশাসন সচিব ও প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে।
তবে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া মোট ১৯ জন পূর্ণ সচিবের মধ্যে ১০ জনের নিয়োগ ১৪ আগস্ট বাতিল করা হয়েছে। বাকিদের নিয়োগও বাতিল হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। সংশ্লিষ্টরা আরো জানিয়েছেন, নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েই সংস্কার কাজে হাত দিয়েছে। এর অংশ হিসেবে ঢেলে সাজানো হবে প্রশাসন। অপরদিকে বঞ্চিতদের পক্ষে থেকে বলা হচ্ছে শেখ হাসিনার শাসনামলে যারা তার আস্থাভাজন কর্মকর্তা বলে পরিচিত, গণপূর্ত অধিদফতর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর. এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীসহ বেশ কয়েকটি অধিদফতরের প্রধান এখনো বহাল তবিয়তে কাজ করছে ।
অপরদিকে বিগত সরকারের আস্থাভাজন কর্তাব্যক্তিদের সরিয়ে ১৬ বছর ধরে বঞ্চিত যোগ্য ও তুলনামূলক নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ইমেজের কর্মকর্তাদের পদায়ন হতে পারে। বিশেষ করে মাঠ প্রশাসনের বিভাগীয় কমিশনার, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগ সরকার আমলের সচিবদের ওএসডি করে নতুন করে সচিব পদায়ন করলে কাজের গতি পাবে এই সরকার। বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পুরোপুরি সফল হতে হলে পুরোনো প্রশাসন বহাল রাখা কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। কারণ তারা আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী। তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চেষ্টা করবে। দ্রুত তাদের সরিয়ে বিভিন্ন সময়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিতে হবে।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের এ তালিকায় রয়েছেন- জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিম, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব কে এম আব্দুস সালাম, সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব এ বি এম আমিনুল্লাহ নুরী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া, পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিৎ কর্মকার, বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম ওয়াহিদা আক্তার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আলী হোসেন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী সদস্য (সচিব) মো. খাইরুল ইসলাম।
এছাড়া প্রশাসনে যারা শেখ হাসিনা সরকারের আস্থাভাজন ও প্রভাবশালী বলে পরিচিত সিনিয়র সচিব ও সচিব, তাদেরও বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হতে পারে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও দফতর থেকে বদলি করে কম গুরুত্বপূর্ণ দফতরেও পাঠানো হতে পারে কাউকে কাউকে। প্রশাসনে অসংখ্য কর্মকর্তা আছেন যাদের শুধু রাজনৈতিক কারণেই পদোন্নতি দেয়া হয়নি।
পদোন্নতি বঞ্চিত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ফোরামের সভাপতি বিসিএস ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমার ব্যাচমেটরা দেড় বছর আগেই সচিব হয়েছেন। অথচ আমি এখনো সিনিয়র সহকারী সচিব পদে আছি। ভালো দক্ষ কর্মকর্তা বলে আমাকে ওএসডি করা হয়নি। রাজনৈতিক তকমা দিয়ে আমাকে ১৬ বছর পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে। আমার কপালে কোনো পদোন্নতি জোটেনি। আমার মতো প্রশাসনে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন, যারা ১৬ বছর ধরে একই পদে কর্মরত। শত শত কর্মকর্তা বছরের পর বছর ওএসডি থেকে অবসরে গেছেন। আমরা এ সরকারের কাছে প্রতিকার চাই। আমাদের মতো যারা পদোন্নতি বঞ্চিত, তাদের দ্রুত পদোন্নতি দিতে হবে। এদিকে মাঠ প্রশাসনে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক হিসেবে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়, তাদের সরকারের আস্থাভাজন ও দক্ষ কর্মকর্তা বলেই মনে করা হয়। বর্তমানে বিভাগীয় কমিশনার পদে ঢাকা ও খুলনার বিভাগীয় কমিশনার ১৫তম ব্যাচের এবং বাকিগুলোতে ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া জেলা প্রশাসক পদে বর্তমানে বিসিএস ২৪, ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের অনেকে ঢাকায় ফেরার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, সরকারের গতির জন্য প্রশাসন অন্যতম ভূমিকা রাখে। প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা সাবেক সরকারের কট্টর সমর্থক বলে পরিচিত, তাদের হয়তো ওএসডি বা কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন করা হতে পারে। যারা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত, তারা পদোন্নতি না পাওয়া পর্যন্ত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যোগ্যতার অভাবে পোস্টিং পাবেন না। সে ক্ষেত্রে প্রশাসনের নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ইমেজের কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে পারেন।
এদিকে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ফের বঞ্চিত করা হচ্ছে অভিযোগ করে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিসট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বাসা)। সংগঠনটির দাবি, বিগত অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকারের দোসর ও ছাত্র-জনতার ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে বাধাদানকারী একইসঙ্গে ছাত্র-জনতাকে মদদ দানকারী কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে তাদের মধ্য থেকেই পদায়ন করা হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যবৃন্দ গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, স্বৈরাচারী সরকারের পতনের এক সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও জনপ্রশাসনে তাদের দোসররাই দোর্দণ্ড প্রতাপে প্রশাসনের কলকাঠি নাড়ছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের দর্শন ও জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন হিসেবে নিরপেক্ষ, দক্ষ ও পেশাদার জনপ্রশাসন গড়ে তোলার প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা পুনঃ আবির্ভূত হয়েছেন।
জনপ্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে সাজানোর পরিবর্তে বিগত অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকারের দোসর এবং ছাত্র-জনতার ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে বাধাদানকারী এবং ছাত্র হত্যার মদদ দানকারী কর্মকর্তাদের দিয়েই জনপ্রশাসন সাজানোর পাঁয়তারা চলছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল এবং আপামর জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হিসেবে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন এবং পতিত সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে তারা জনপ্রশাসন ঢেলে সাজানোর নামে তাদেরই মদদপুষ্ট কর্মকর্তাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পদায়ন করছে। বিগত অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকারের সময়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের আবারও বঞ্চিত রেখেই সুবিধাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হচ্ছে।
এতে আরও বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এখনো পদত্যাগ করছেন না কোনো সচিব। বরং গত ৩ আগস্ট সচিব সভায় যে সকল সচিব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে দমন করার শপথ গ্রহণ করেছেন এবং স্বৈরাচারী সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করেছেন তারা এখনো বহাল আছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বর্ণচোরা দলদাস কর্মকর্তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে এখনো সরিয়ে দেয়া হয়নি। ফলে শত শত শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত দ্বিতীয় স্বাধীনতা উক্ত মহল বিশেষের চক্রান্তে নস্যাৎ হয়ে যাওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছে।
অপরদিকে অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেছেন, সকল পর্যায়ের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, বিগত অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকারের দোসর কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অপসারণ এবং বিগত ১৬ বছরে অন্যায়ভাবে পদোন্নতি ও বঞ্চনার শিকার সকল কর্মকর্তাদের দ্রুত পদোন্নতি প্রদানপূর্বক উপযুক্ত পদে পদায়ন করার জোর দাবি জানানো হয়।