
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছেন । গতকাল সোমবার বিকাল ৪টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রথম বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে বসেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর একে একে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমেদ ও বেগম সেলিমা রহমান। এ সময় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলিনি, নির্বাচন আয়োজন করতে একটা নির্দিষ্ট সময় লাগবে, আমরা সেই সময় দিতে চাই-এমন কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা মতবিনিময় করার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমরা এসেছি, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, গণতন্ত্র হত্যাকারী গণবিরোধী যারা দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতা দখল করে এ দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছে তা থেকে মুক্তি পেয়েছে দেশ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হয়েছে দেশ। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কী কী করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করেছি। একইসাথে আমাদের মতামত দিয়েছি। আমরা মনে করি এ সরকারকে সহায়তা করা প্রতিটি জনগণের দায়িত্ব। আজকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতে হয়, সেই মহলটি যারা বাংলাদেশের মানুষের অধিকার হরণ করেছে তারা আবার বিদেশে বসে গণজাগরণের যে বিজয় হয়েছে সেটাকে নস্যাৎ করার জন্য কাজ করছে। ছাত্র আন্দোলনের বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য কাজ করছে। এ দলটি দেশের এতগুলো ছাত্র, জনতা, শিশুদের হত্যা করার পরে বিভিন্ন রকম কথা বলছে যা বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে। আমরা মনে করি বর্তমান সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিবে। সরকার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলবে কিন্তু কোনো হত্যাকারী দলের সাথে কথা বলবে না। বিএনপির এ শীর্ষ নেতা বলেন, আমরা একটা কথা খুব স্পষ্ট করে বলেছি, তথাকথিত মাইনরিটির ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের যে গল্প পাতা হয়েছে, সে গল্পটা পুরোপুরিভাবে উদ্দেশ্যমূলক। বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, এই সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, ছাত্রজনতার আন্দোলনকে একেবারে নস্যাৎ করে দেয়ার আরেকটি চক্রান্ত।
সন্ধ্যা ৬টায় আরও চারটি দলের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দলগুলো হচ্ছে-এবি পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ ও গণঅধিকার পরিষদ (একাংশ)। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সিপিবি ও বাসদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন নোবেলজয়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা.শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। উনারা কেবল বসলেন, মাত্র চারটা দিন হলো, আমরা দেখতে চাই উনারা (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) কীভাবে জাতিকে নিয়ে এগোতে চাচ্ছেন। সমস্যাগুলোর সমাধান কীভাবে করেন। যৌক্তিক সময়ে সমাধান হবে বলে আমরা আশাবাদী। তিনি বলেন, আপনারা জানেন জাতির জীবনে একটা টার্নিং পয়েন্ট চলছে। আমরা প্রধান উপদেষ্টার দাওয়াতে এখানে এসেছিলাম। দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এখন করণীয় কী, সেই বিষয়ে আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, দেশ আমাদের সবার। দেশ ভালো থাকলে আমরা ভালো থাকব। আমরা যদি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ করি সবাইকে সহযোগী করি, এখন যারা দায়িত্বে এসেছেন তাদেরকে সহযোগিতা করি, তাহলে দেশ একটা শৃঙ্খলা ও সুন্দরের মধ্যে আসবে বলে আমরা মনে করি। জামায়াতের আমির বলেন, আন্দোলনে যারা শাহাদাতবরণ করেছেন তাদের জন্য দোয়া করেছি। যারা আহত হয়েছেন তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সুস্থতা কামনা করেছি। দেশের বিভিন্ন ভালো-মন্দ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি।
এবি পার্টির সদস্য সচিব মুজিবুর রহমান মনজু জানান, সন্ধ্যা ৬টায় চারটি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি তাড়াহুড়ো করবে না। তবে অন্যদলগুলোর নেতারা বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে কয়েকটি দাবি তুলে ধরেছি। এর মধ্যে অন্যতম যৌক্তিক কারণ ছাড়া নির্বাচন যেন না পেছানো হয়। এতে এ সরকারের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে। বামজোটের সমন্বয়ক ও বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, বাসদ ও সিপিবিকে সন্ধ্যায় সাড়ে ৭টায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। এরপর সময়মতো আমরা উপস্থিত হলে বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে আমরা বেশ কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছি। তবে ইতোমধ্যে বামজোট ও প্রগতিশীল দলগুলো একটি অবস্থান ব্যক্ত করেছে উল্লেখ করে ফিরোজ বলেন, আমরা ছাত্রজনতার বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ চাই। তারা যে আহ্বানে এই পরিবর্তন এনেছে, সেই বৈষম্যের অবসান চাই। গত ১৫ বছরে দেশে যে ফ্যাসিবাদী শাসন চলেছে, তা যেন ফিরে না আসে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। ‘তিন মাস, দুই মাস বা সাড়ে তিন মাসে তো সংস্কার আসবে না’ জানিয়েছেন বজলুর রশীদ। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার করতে হবে। প্রশাসনের সর্বস্তরে দলীয় লোকজন, এগুলো ঠিক করতে হবে। সময় লাগবে। আমরা সময় জানতে চাইবো। একইদিন সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা। এ সময় বৈঠকে অংশ নেন মঞ্চের শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের নেতারা। এ সময় মঞ্চের নেতা সাইফুল হক বলেন, আমরা প্রতিটি দল থেকে দু’জন করে নোবেলজয়ী প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তিনি বলেন, আমরা বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্যমূলক কথা বলেছি। সময় নিয়ে এখনই কোনো চাপ দিতে চাই না। তবে পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট হলে রাজনৈতিক অবস্থান ব্যক্ত করার কথা বলেন গণতন্ত্র মঞ্চ।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয়। সেদিন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ ১৩ জন উপদেষ্টা শপথ নিয়েছিলেন। তারপর গত রোববার আরও দুই উপদেষ্টা শপথ নেন। ১৬ উপদেষ্টার মধ্যে ফারুক-ই-আজম যুক্তরাষ্ট্রে থাকার কারণে শপথ নিতে পারেননি। তিনি রোববার রাতে দেশে পৌঁছেছেন। আজ মঙ্গলবার তার শপথ নেয়ার কথা রয়েছে।