লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন
দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। রাজধানীর নয়াপল্টনে গতকাল বুধবার বিএনপির সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে এ দাবি জানান তিনি। বেলা ২টা ৩৮ মিনিটে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে এই সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশস্থলে দলটির নেতাকর্মীদের ঢল নেমেছে। প্রায় দেড় যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীরা মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে এবং হাতে জাতীয় ও দলীয় পতাকা নিয়ে বিজয় উল্লাস করতে করতে সমাবেশস্থলে আসে।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তারেক রহমান বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় গুণগত পরিবর্তন আনতে না পারলে আজকের বিপ্লবের কাক্সিক্ষত ফল মিলবে না। হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তে ঝরা এই বিপ্লবের লক্ষ্য একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। তাই বিপ্লবের লক্ষ্য বাস্তবায়নে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। আইনের শাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে বক্তব্যে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, ধর্মীয় পরিচয় বা বিশ্বাস যাই হোক, নিজ নিজ এলাকার সব নাগরিকের নিরাপত্তায় ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাসকারী প্রত্যেকটি মানুষের একটিই পরিচয়, আমরা বাংলাদেশি। পুলিশ প্রসঙ্গে নেতাকর্মীদের তারেক রহমান বলেন, একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশ অপরিহার্য। পুলিশ জনগণের শত্রু নয়। গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা বিনা ভোটে ক্ষমতায় থাকার জন্য পুলিশকে জনগণের শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বিএনপিসহ বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলও বিশ্বাস করে পুলিশের ভেতরে একটি চক্র ছাড়া অধিকাংশ কর্মকর্তা ও সদস্য চাকরিবিধি এবং দেশের আইনকানুন মেনেই দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছে। শেখ হাসিনার পলায়নের পরে একটি চক্র পুলিশের মনোবল ভেঙে দেয়ার চক্রে লিপ্ত হয়েছে। পুলিশকে অকার্যকর করে দেয়া গেলে দেশকে অস্থিতিশিল করা সহজ। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মনে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করা সহজ।
অস্থিতিশিলতা সৃষ্টির চেষ্টাকারীদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, পুলিশ কিংবা ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর আজ থেকে হামলা ও নৈরাজ্য বন্ধ করুন। এমনকি কেউ বিএনপির নাম ব্যবহার করে কোনো অপকর্ম করতে চাইলে তাকে ধরে আইনের হাতে তুলে দিন। কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যথানিয়মে অভিযোগ করারও আহ্বান জানান তারেক রহমান।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রশাসনকে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে রাষ্ট্রপতি যেন নির্দেশ দেন আমরা সে আহ্বান জানাবো। একইসঙ্গে দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে তিন মাসের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের প্রায় ৬০ লাখ নেতাকর্মী সরকার বন্দি করেছিল। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা যখন আন্দোলন করেছিল আমরা তাদের সমর্থন জানিয়েছিলাম। এরপর থেকে ফ্যাসিস্ট সরকার আমাদের ১১ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু সবকিছু পেরিয়ে বাংলার ছাত্র-জনতা বিজয় কেড়ে নিয়ে এসেছে। এই বিজয় ছাত্র-জনতা ও নেতাকর্মীদের। আমাদের বিজয়কে কেউ যাতে ছিনিয়ে নিতে না পারে সে জন্য সকলকে সজাগ থাকতে হবে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা একটি মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাই, সাম্যের রাষ্ট্র গড়তে চাই। বর্তমানে আমাদের এই বিজয়কে নস্যাৎ করার জন্য যারা কাজ করছে তারা তাদেরই প্রেতাত্মা। নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান থাকবে আপনারা কোনও আগুন দেয়ার ঘটনার সঙ্গে জড়িত হবেন না। ক্ষোভ প্রকাশ করে আইন হাতে তুলে নেবেন না। যারা এ সকল ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকবে, দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইবে তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। তিনি আরও বলেন, যারা লুটপাট করছে তারা আমাদের কেউ না, তারা ছাত্রদের মধ্যেও কেউ না। তারা হলো দুর্বৃত্ত। আমরা ছাত্রদের সঙ্গে একমত। আমরা গণতন্ত্রের দেশ নির্মাণ করতে চাই। আজকে আমাদেরকে ধৈর্যের সঙ্গে দিন পার করতে হবে। কোনও প্রতিহিংসা নয়, প্রতিরোধ নয়। এ বিজয়কে সুসংগঠিত করতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, দেশের ছাত্র-যুব সমাজ ও সাধারণ মানুষ একটি পরিবর্তনের জন্য আশা করছে। সেই পরিবর্তন আমরাই করতে পারব। তিনি আরও বলেন, খালেদা জিয়াকে জীবিত অবস্থায় মুক্ত করতে পেরেছি বলে আমরা আনন্দিত। তারেক রহমানকেও একইভাবে মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। যে তরুণরা এই দেশের জন্য জীবন দিয়েছে তাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা দেশকে মুক্ত করতে পেরেছি জানিয়ে নজরুল ইসলাম খান বলেন, তাদের অবদানের কথা স্বীকার করে আমরা একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলব। জনগণের কাছে দায় থাকবে এমন একটি সরকার আমরা গঠন করতে চাই। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ পতন হয়েছে, দাম্ভিক হাসিনার পতন হয়েছে। আমাদের যে ফ্যাসিবাদের প্রতি আন্দোলন তা শেষ হয়েছে। আজকের যে আন্দোলন তা আগামী দিনের নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার আন্দোলন। আগামী দিনের নির্বাচনের জন্য এখন থেকেই নেতা-কর্মীদের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এর আগে কোনো ধরনের বাধা-বিপত্তি ছাড়াই দীর্ঘ সময় পর বিএনপির সমাবেশে নয়াপল্টনে হাজার হাজার নেতাকর্মী জড়ো হয়। এরইমধ্যে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। গতকাল বুধবার নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দুপুর ২টা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাবেশের কার্যক্রম শুরু হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আর সভাপতিত্ব করবেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর ওইদিন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে বিজয় উল্লাস করে।
এরমধ্যে গত ৬ আগস্ট মঙ্গলবার রাত থেকে নয়াপল্টন দলের কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ মঞ্চ তৈরির কাজ করে বিএনপি। প্রশাসনের কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই নির্বিঘ্নে চালিয়ে যায় দলটি। গতকাল বুধবার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে জড়ো হতে থাকেন নেতাকর্মীরা।
সরেজমিনে বিএনপির সমাবেশস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বদলে গেল দলটির কার্যালয়ে আশপাশের পরিবেশ। গত এক দশক ধরে দেখা যেত দলটির কার্যালয় ঘিরে চারপাশে থাকতো পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সেই দৃশ্যটি এখন চোখে পড়েনি।
এদিকে রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্ত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছবি সম্বলিত ব্যানার-ফেস্টুন শোভা পাচ্ছে সমাবেশস্থলের বিভিন্ন জায়গায়। শুধু তাই নয়, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবি সম্বলিত বেনার-ফেস্টুনও দেখা গেছে। সমাবেশকে কেন্দ্র করে মাইকও লাগানো হয়েছে রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংক পর্যন্ত। সমাবেশে আসা বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, আগে সমাবেশে আসতে পথে-পথে বাধার সম্মুখীন হতেন। অনেক সময় হামলারও শিকার হয়েছেন। এছাড়া সমাবেশস্থল থেকে কিংবা আসা-যাওয়ার পথ থেকে গ্রেফতার হওয়ার সম্ভবনা থাকত। গতকাল বুধবার সেই ভয় ছিলো না। গত কয়েক দিন নিজ বাসা-বাড়িতে শান্তিতে ঘুমাতে পেরেছেন। গ্রেফতারের ভয় ছিল না।
এদিকে সমাবেশ মঞ্চের মাইক থেকে বলা হচ্ছে, আজ আমরা মুক্ত। বিজয় অর্জন করেছি। এখন অনেক সুযোগ সন্ধানী দলে ভিড়তে চাইবে। নিজেদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইবে। এটা হতে দেয়া যাবে না। মঞ্চ থেকে নেতাকর্মীদের বিচারপতির বাসভবন, পল্টন থানাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পাহারা দিতে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।