
* রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে দ্রব্যমূল্যের অস্থিরতা
* বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে বড় দুই দলে চলছে দোষারোপের রাজনীতি
সফিকুল ইসলাম
পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই ধর্মীয় উৎসবের সময় ব্যবসায়ীরা পণ্যমূল্যের দাম কমিয়ে দেয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পবিত্র রমজান মাস আসলেই নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে রাখা হয়। তবে বরাবরের মতো এবারও উল্টো চিত্র বাংলাদেশে। পবিত্র মাহে রমজান মাস আসলেই নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। রমজান মাসকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। রমজানে চাহিদা বেশি রয়েছে এমন সব পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও বাজারে চাল, ডাল, চিনি, ছোলা, খেজুর, পেয়াঁজ, আদা, রসুন, মুরগী, গরু-খাসীর মাংস, বিভিন্ন জাতের মাছ ও ফলের দামের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে উর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে পণ্যমূল্য উর্ধ্বগতির জন্য দেশের সরকারি দল এবং মাঠের প্রধান বিরোধী দল অসাধু মজুতদার ও সিন্ডিকেটকে দায়ী করলেও দুই দলই এই ইস্যুতে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপের রাজনীতি শুরু করেছে। টানা চতুর্থ মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, সিন্ডিকেট করে পণ্যমূল্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। আর এই সিন্ডিকেট লালন পালন করেছে বিএনপি, মজুতদারদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে তারা। অপরদিকে উল্টোসুরে কথা বলছেন বিএনপিসহ সমমনা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।
এদিকে রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এক প্রকার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সরকার। সরকারের শীর্ষ মহল থেকে চ্যালেঞ্জের বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রীও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বাজার নিয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট ভাঙার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এমনকি গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একতরফা জয়ের মধ্য দিয়ে সরকার গঠনের পরই গঠিত মন্ত্রিসভাকে বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং সাধারণ মানুষকে এর সুফল ভোগের বিষয়টি নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেন সরকার প্রধান। তবুও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার এখনো সিন্ডিকেটের কবজায় থাকায় হতাশ দেশের সাধারণ মানুষ। পবিত্র রমজানেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি বলেছেন, দ্রব্যের দাম বাড়ছে, এটা বাস্তবতা, অস্বীকার করে লাভ নেই। তিনি বলেন, বিএনপি সিন্ডিকেট লালন পালন করেছে, মজুদদারদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে, একথা বললে কি ভুল হবে? যারা করছে তারা বিএনপির পুরোনো সিন্ডিকেট। তিনি বলেন, বিএনপি সরকার ছিল ব্যবসায়ী সরকার। আওয়ামী লীগ ব্যবসা করতে আসেনি। এখানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার হাল ছেড়ে দিয়েছে এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই। বিভিন্নভাবে সরকার পরিকল্পনা নিয়ে যে অশুভ চক্র দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে জন অসন্তোষের কারণ সৃষ্টি করছে তাদের কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেয়া হবে না। তবে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে নানা সংশয় ছিল। সেটা ইতোমধ্যে কেটে গেছে। মন্ত্রিসভা গঠন হয়েছে। মন্ত্রিসভার আকারও ইতোমধ্যে বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেই চ্যালেঞ্জ উতরাতে পারলেও দ্রব্যমূল্যের বাজার স্থিতিশীল রাখা ও এর সুফল সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া নতুন সরকারের জন্য বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ। তারা মনে করেন, গত এক যুগে বিএনপি ও তার মিত্ররা কোনো আন্দোলনেই সফল হতে পারেনি। কারণ তাদের ইস্যুটা ছিল তাদের দলের জন্য, সাধারণ জনগণের জন্য তারা কোনো আন্দোলন করেনি। এবার বিএনপি ও তার মিত্ররা দ্রব্যমূল্য নিয়ে ধীরে ধীরে সক্রিয় হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাদের অনেক নেতাই জামিনে মুক্ত হয়ে জেল থেকে বের হয়েছেন। তাদের শীর্ষ নেতারা এখন নিয়মিত দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে সরব হয়ে উঠেছেন। বিএনপির মিত্র দলগুলো রাজপথে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে নিয়মিত মিছিল মিটিং করছেন। এটা একটি ইস্যু হয়ে গেলে জনঅসেন্তাষ দেখা দিতে পারে। সেটা মোকাবেলা করা আওয়ামী লীগ ও সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। যদিও সরকারের উচ্চপর্যায়ের মনিটরিং সেল বাজার ব্যবস্থা নিয়ে কাজ শুরু করেছে। আগামী রমজানে হয়তো কিছুটা সুফল মিলতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে বিএনপি বলছে, শুধু রমজান মাসই নয়, আওয়ামী লীগ যেনতেন নির্বচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, যারা বাজার নিয়ন্ত্রক করে, তারাই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফকরুল আলমগীর অভিযোগ করে বলেন, সরকারের লুটপাট আর দুর্নীতির কারণেই দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুর কবির রিজভী বলেছেন, প্রতিটি পণ্যের দাম যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ অবস্থায় নিম্নআয়ের শুধু নয় মধ্যবিত্তরাও চরমতমভাবে অসহায় হয়ে পড়েছে। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছে না মানুষ। আর সিন্ডিকেট সরকার উদ্ভট কথাবার্তা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তিনি বলেন, মানুষের এখন জান বাঁচানো দায়। কারণ ডামি সরকার লোক দেখানো হাঁকডাক দিলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বাজার নিয়ন্ত্রকরাই এখন সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে রমজান উপলক্ষে যারা অবৈধভাবে নিত্যপণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, অবৈধভাবে যারা নিত্যপণ্য মজুত করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী সেই অনুযায়ী কাজ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাল মঙ্গলবার থেকে পবিত্র রমজান শুরু হচ্ছে। আজ সোমবার দিবাগত রাতে সেহরী খেয়ে রোজা রাখবেন ধর্মপ্রিয় মুসল্লিগণ। কিন্তু এই মাসে দেশের বাজার পরিস্থিতি অস্থির হয়ে উঠছে। কোনো কিছুতেই যেন দ্রব্যমূল্যের লাগম টেনে ধরা যাচ্ছে না। পেঁয়াজের ঝাঁঝে ক্রেতাদের চোখে পানি আসছে আর ১০ টাকা কেজিতে কমলেও সয়াবিন তেলের বাজার চড়াই রয়ে গেছে। সকল নিত্যপণ্যের দামেই অস্বস্তি। আর বাজার পরিস্থির এই অস্বস্তি এখন বাজার বা ঘর ছেড়ে রাজপথে। দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে রাজপথের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সারাদেশেই সভা-সমাবেশ করছে। বাম দলগুলোও বসে নেই। তারাও এ নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে আওয়ামী লীগও অস্বস্তিতে রয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে এখন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। তবে বরাবরের মতো সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এ নিয়েও শুরু হয়েছে রাজনীতির মাঠের গরম। এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে রাজপথে আন্দোলনে করছে বিরোধীদলগুলো। দ্রব্যমূল্য যেন তাদের রাজনীতির খোড়াক জুগিয়েছে। টক অব দ্যা কান্ট্রি এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এই নিয়েই চলছে রাজনীতির মাঠে কাদা ছোড়াছুড়ি। এক পক্ষ অন্য পক্ষের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। সর্বশেষ গতকাল রোববারও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আজ-কালের মধ্যে জিহাদি খেজুরের দাম বেঁধে দেবে। আমদানিকারকদের সঙ্গে বৈঠকে বসে নজরদারির মধ্যে রাখা হবে অন্যান্য খেজুরও। তিনি বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযান কার্যক্রম পরিচালনা করে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবে ভোক্তা অধিকার। অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত রাখা হবে। এরআগে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, রমজান মাসের বাইরেও নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তিনি বলেন, আমাদের টার্গেট রমজানে যেন ভোক্তাদের বেশি দামে পণ্য কিনতে না হয়। আমাদের টার্গেট শুধু রমজান নয়, রমজান মাসের পরও নিত্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ কোনো ব্যবসায়ী বা কোনো গোষ্ঠীর হাতে যেন সাধারণ মানুষ জিম্মি না থাকে। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, গত শুক্রবার থেকে ভোজ্যতেলের মনিটরিং শুরু হয়েছে। আজ সকাল থেকেও সব মিলগেটে টিমগুলো মনিটরিংয়ে আছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এমপি বলেছেন, রমজান মাসে মানুষ যাতে ন্যায্য মূল্যে পণ্য সামগ্রী পায় এ জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এরপরও অতিমুনাফার লোভে কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। এটি দেশ বিরোধী কাজ। আর এ কাজ যে করবে তাকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। তিনি বলেন, বিএনপি-জামাত চায় মানুষের দুঃখ-কষ্ট যাতে বৃদ্ধি পায়। এ জন্য যা যা সম্ভব তারা তাই করছে। তারা মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এরা কখনও দেশের ভালো চায় না। এরা দেশকে ধ্বংস করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চায়। এদের নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, পবিত্র রমজান মাসে মানুষকে জিম্মি করলে কেউ রেহাই পাবে না। তিনি বলেন, যে বাজারদর রমজান মাসের সাদকাহ হওয়ার কথা, সেখানে উল্টো মানুষকে জিম্মি করে উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছে, তাদের আমি সতর্কবাণী দিলাম। দলের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে কেউ রেহাই পাবে না। তিনি বলেন, জনগণ আমাদের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী বাজারদর নিয়ে বারবার সতর্ক করেছেন, কঠিন বার্তা দিচ্ছেন। তারপরও যারা বাজারদরকে নিয়ন্ত্রণে আনছে না, তাদের এই চ্যালেঞ্জ দিলাম।