হাবিবুর রহমান ও আবু জাফর
নির্বাহী আদেশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও দলটির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির এবং তাদের সব অঙ্গসংগঠনকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। নিষিদ্ধ ঘোষণার পর গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে রাজধানীসহ সারাদেশে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে টহল ও চেকপোস্ট জোরদার করা হয়েছে। তবে নিষিদ্ধ হওয়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও দলটির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে মোকাবিলার প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। এর আগেও ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ১৯৬৪ সালে আবারও নিষিদ্ধ করা হয় জামায়াতকে। এছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখা-২ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই-ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং এর অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ)-কে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধে দায়ী হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। এছাড়া হাইকোর্ট বিভাগের? এক রিট পিটিশনের রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে দিয়েছেন। আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগের ওই রায়কে বহাল রেখেছেন বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং এর অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল। সরকার বিশ্বাস করে যে, জামায়াত ও শিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। তাই ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯’ এর ধারা ১৮(১) এ দেয়া ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো। এ আইনের তফসিল-২ এ জামায়াত ও ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে তালিকাভুক্ত করলো বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়।
গত বুধবারের মধ্যে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা হচ্ছে বলে এর আগে গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। যদিও প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কিছুটা সময় লাগায় গত বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রস্তাব লেজিসলেটিভ বিভাগ ভেটিং (আইনি মতামত) করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছে, সেখান থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় দলটির সাবেক বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার সাজা হয়েছে। গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের পর মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা এবং মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মতো পাঁচ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। জামায়াতের আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলার রায়ে জামায়াতকে একটি ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, জামায়াত একটি অপরাধী সংগঠন। একাত্তরে তাদের ভূমিকা ছিল দেশের স্বার্থের পরিপন্থী।
বাংলাদেশে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল জামায়াত। রাজনৈতিক নানান পটপরিবর্তনের পর দেশের রাজনীতিতে আবারও সক্রীয় হয় দলটি। ১৯৮৬ সালে প্রথম বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশ নেয় জামায়াত। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার গঠন করলে জামায়াতের কয়েকজন নেতা মন্ত্রিসভায় স্থান পান, যা তখন ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। ২০০৮ সালে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন দেয়া হয়। এরপর দলটির নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে রিট আবেদন করেন তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় ঘোষণা করেন। আপিল বিভাগেও এ রায় বহাল থাকে। এরপর ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন।
প্রজ্ঞাপন প্রকাশের আগে গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে কথা বলেন সাংবাদিকরা। নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াত-শিবির আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে কিনা-এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে। আন্ডারগ্রাউন্ডে অনেক দল গেছে, অনেক দলের কী হয়েছে, সেটা আপনারা জানেন। তবে সেটাকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি সরকারের আছে। এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনও আমরা সংশোধন করার ব্যবস্থা করেছি। নিষিদ্ধ করার পরেও তাকে শাস্তি দেয়া যাবে না এমনটি নয়। হয়তো নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আর সাজার মধ্যে আসবে না। নিষিদ্ধ করার পর দলটির সম্পদের কী হবে- প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, সেগুলোরও ব্যবস্থা হবে। সেটা আইনে আছে। দলের যারা সদস্য তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা- দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইনমন্ত্রী বলেন, এই দলের অধীনে তারা রাজনীতি করতে পারবে না। বাংলাদেশের কোনো আইনে তারা অপরাধ করলে সেটার বিচার হবে। আপনারা যদি বলেন গণহারে যারা জামায়াতে ইসলামীর নতুন কর্মী রয়েছেন, ১৯৭১ এর পরে যারা জন্ম নিয়েছেন তাদের বিচার করা হবে এরকম গণহারে বিচার করা হবে না। সূত্র জানায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম সমালোচিত দল হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। বাংলাদেশে নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেও দেশের রাজনীতিতে টিকে যাওয়া ও প্রতিষ্ঠা পাওয়া নিয়ে রয়েছে দীর্ঘদিনের হতাশা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়ার কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল নাগরিকদের কাছে দলটি সবসময় ঘৃণিতই ছিল। তারপরও ধর্মীয় আবেগ ও রাষ্ট্রীয় বিভক্তির সুযোগ নিয়ে দলটি রাজনীতিতে স্থায়ী আসন গড়ে নেয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের’ কারণে। সে সময় সংবিধানর ৩৮ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। কেবল স্বাধীন বাংলাদেশেই নয় যে পাকিস্তান নামক দেশে জামায়াতে ইসলামীর জন্ম সেদেশেও তাদের দুবার নিষিদ্ধ করা হয়। প্রথমবার ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়। সে বার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানির অভিযোগে দলটি নিষিদ্ধ হয়। তবে অল্পদিন পরেই তারা আবার রাজনীতি করার সুযোগ পায়। এরপর ১৯৬৪ সালে আবারও নিষিদ্ধ করা হয় জামায়াতকে। এবার কারণ হিসেবে বলা হয় মুসলিম পরিবার আইনের বিরোধিতা। তবে এই নিষেধাজ্ঞাও বেশিদিন ছিল না। পাকিস্তানে যেমন নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে ফিরে আসে একইভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তারা ফেরত এসেছিল। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আগ পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে জামায়াতের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময় ১৯৭৬ সালে ধর্মীয় রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। ফলে রাজনীতিতে পুনরায় ফিরে আসে দলটি। ১৯৭৬ সালের ৩ মে রাষ্ট্রপতি এ.এস.এম সায়েম একটি অধ্যাদেশ জারি করে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।
সূত্র আরও জানায়, এর আগে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশে ৯টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী এসব সংগঠন বাংলাদেশে কোনও ধরনের কার্যক্রম চালাতে পারবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত নিষিদ্ধ এই সংগঠনগুলো হলো- শাহাদত-ই-আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম, আল্লাহর দল এবং জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। নিষিদ্ধ সংগঠনের মধ্যে ২০০৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি চার দলীয় জোট সরকার প্রথমে শাহাদাত-ই-আল হিকমা নামে জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে। এরপর ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশকে (জেএমজেবি) এবং ওই বছরের ১৭ অক্টোবর হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশকে (হুজিবি) নিষিদ্ধ করা হয়। বোমা হামলা চালিয়ে বিচারক হত্যার দায়ে জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। চার দলীয় জোট সরকারের সময় নিষিদ্ধ এসব জঙ্গি সংগঠনগুলোর কয়েকটিকে তৎকালীন সরকারের এমপি মন্ত্রীরা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
এছাড়াও জামায়াত ইসলামীসহ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছয়টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরমধ্যে উগ্রপন্থা প্রচারের জন্য ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর নিষিদ্ধ করা হয় হিযবুত তাহরীরকে। ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তৎপরতা সামনে আসে। পরে ২০১৫ সালের ২২ মে মাসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ করা হয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ হওয়ার পর এর সদস্যরাই সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনাকারী বরখাস্ত মেজর জিয়াউল হকের নেতৃত্বে আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরতা শুরু করে। একের পর এক জঙ্গি হামলা ও হত্যার প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালের মার্চে আনসার আল ইসলামকে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আল্লাহর দল নামের জঙ্গি সংগঠনটি গঠিত হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। ২০০৪ সালের শেষের দিকে এই সংগঠন জেএমবির সঙ্গে একীভূত হয়। ২০০৫ সালের ১৭ অগাস্ট সারা দেশে জেএমবির বোমা হামলায়ও আল্লাহর দলের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যায়। জেএমবি নিষিদ্ধ হলে আল্লাহর দল আবার সক্রিয় হয় আমিন মতিন মেহেদীর নেতৃত্বে। ২০১৪ সালে আল্লাহর দলের নাম পরিবর্তন করে ‘আল্লাহর সরকার’ রাখা হয়। কয়েক বছর দলটির দৃশ্যমান কোনও তৎপরতা না থকলেও নিষিদ্ধ জেএমবির সহযোগিতায় ২০১৯ সালে ‘আল্লাহর দল’ সারা দেশে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার তথ্য আসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ওই সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত আমির ইব্রাহিম আহমেদ হিরোসহ ৮জন সদস্য র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। এরপর ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আল্লাহর দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০২৩ সালের ৯ আগস্ট নিষিদ্ধ করা হয় ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে’। এ সংগঠনটি নিষিদ্ধ সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারের কাছে এ মর্মে প্রতীয়মান হয় যে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামক জঙ্গি দল/সংগঠনটির ঘোষিত কার্যক্রম দেশের শান্তি শৃঙ্খলা পরিপন্থী। ইতোমধ্যে দল/সংগঠনটির কার্যক্রম জননিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত হওয়ায় বাংলাদেশে এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।
এখানে উল্লেখ্য, সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। একই বছর সালের ৭ জুন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশাপাশি বিলুপ্ত করা হয়েছিল আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঘুনে ধরা সমাজকে বাঁচাতে সব দল নিষিদ্ধ করে সবাইকে একই প্ল্যাটফর্মে আনতে বাকশাল গঠন করেন। বাকশালকে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সাধারণ জনগণের পাশাপাশি সামরিক বেসামরিক আমলা ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের বাকশালের অন্তর্ভুক্তির আইনগত সুযোগ ছিল। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর সেটি আর বাস্তবায়িত হয়নি। পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সামরিক ফরমান বলে আবারো বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করলে আওয়ামী লীগসহ পুরনো দলগুলো কার্যক্রম শুরু করে। পাশাপাশি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পথ তৈরি হয়।
ব্রিটিশ আমলে ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে সামাজিক-রাজনৈতিক ইসলামি আন্দোলনের অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী গঠন হয়। জামায়াত ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল। স্বাধীনতা ও ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর দলটির প্রতিষ্ঠাতা আবুল আ’লা মওদুদী ভারত থেকে পাকিস্তান চলে যান।
পাকিস্তান আমলে জামায়াত ইসলামী একবার নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছিল। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের বিরোধিতা করার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ওই সময় মওদুদী ও গোলাম আজমসহ দলটির অন্তত ৬০ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ওই বছর অক্টোবরেই আবার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। জামায়াত ইসলামী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাকিস্তান ভাঙার জোরালো বিরোধিতা করেছিল। দলটির সদস্যরা শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আল-বদর গঠনে নেতৃত্ব দেয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে ডা. আব্দুল মালিককে গভর্নর একটি প্রাদেশিক সরকার গঠন করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের উদ্যোগে গঠিত এ প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী সভায় আব্বাস আলী খানকে (পরবর্তীকালে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির) শিক্ষামন্ত্রী করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াতে ইসলামীও এর আওতায় পড়ে। তখন গোলাম আজমসহ জামায়াতের কিছু নেতা পাকিস্তানে নির্বাসনে চলে যান।
বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর ১৯৭৬ সালের আগস্টে জিয়াউর রহমান সরকার সব ধরনের রাজনৈতিক দলের রাজনীতি উন্মুক্ত করে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষণা করে। এ সময় আবার রাজনীতির ময়দানে ফেরে জামায়াত। ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি নামক একটি দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী যুক্ত হয়। পরে পাকিস্তান থেকে গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে এলে ১৯৭৯ সালের মে মাসে ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ গঠিত হয়। এসময় এর ভারপ্রাপ্ত আমির করা হয় আব্বাস আলী খানকে। এরপর থেকে বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে রাজনীতি করে যাচ্ছে দলটি। তবে স্বাধীন বাংলাদেশেও জামায়াতের বিরুদ্ধে নানা সময়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তোলা হয়েছে। ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে দলটি অংশগ্রহণ করে দলটি। এ ছয়টি সংসদেই দলটির কম বেশি প্রতিনিধিত্ব ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে। এতে দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামী ও মহাসচিব আলী আহসান মুজাহিদসহ শীর্ষ পর্যায়ের চার নেতার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। দলের আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। এক রিটের পর ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। ওই রায়ের পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এদিকে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে জামায়াত ইসলামী আপিল করলে ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর এক আদেশে ওই আপিল খারিজ করে হাইকোর্ট বিভাগের রায় বহাল রাখেন।
নির্বাহী আদেশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও দলটির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির এবং তাদের সব অঙ্গসংগঠনকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। নিষিদ্ধ ঘোষণার পর গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে রাজধানীসহ সারাদেশে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে টহল ও চেকপোস্ট জোরদার করা হয়েছে। তবে নিষিদ্ধ হওয়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও দলটির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে মোকাবিলার প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। এর আগেও ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ১৯৬৪ সালে আবারও নিষিদ্ধ করা হয় জামায়াতকে। এছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখা-২ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই-ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং এর অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ)-কে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধে দায়ী হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। এছাড়া হাইকোর্ট বিভাগের? এক রিট পিটিশনের রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে দিয়েছেন। আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগের ওই রায়কে বহাল রেখেছেন বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং এর অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল। সরকার বিশ্বাস করে যে, জামায়াত ও শিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। তাই ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯’ এর ধারা ১৮(১) এ দেয়া ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো। এ আইনের তফসিল-২ এ জামায়াত ও ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে তালিকাভুক্ত করলো বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়।
গত বুধবারের মধ্যে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা হচ্ছে বলে এর আগে গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। যদিও প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কিছুটা সময় লাগায় গত বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রস্তাব লেজিসলেটিভ বিভাগ ভেটিং (আইনি মতামত) করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছে, সেখান থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় দলটির সাবেক বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার সাজা হয়েছে। গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের পর মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা এবং মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মতো পাঁচ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। জামায়াতের আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলার রায়ে জামায়াতকে একটি ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, জামায়াত একটি অপরাধী সংগঠন। একাত্তরে তাদের ভূমিকা ছিল দেশের স্বার্থের পরিপন্থী।
বাংলাদেশে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল জামায়াত। রাজনৈতিক নানান পটপরিবর্তনের পর দেশের রাজনীতিতে আবারও সক্রীয় হয় দলটি। ১৯৮৬ সালে প্রথম বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশ নেয় জামায়াত। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার গঠন করলে জামায়াতের কয়েকজন নেতা মন্ত্রিসভায় স্থান পান, যা তখন ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। ২০০৮ সালে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন দেয়া হয়। এরপর দলটির নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে রিট আবেদন করেন তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় ঘোষণা করেন। আপিল বিভাগেও এ রায় বহাল থাকে। এরপর ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন।
প্রজ্ঞাপন প্রকাশের আগে গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে কথা বলেন সাংবাদিকরা। নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াত-শিবির আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে কিনা-এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে। আন্ডারগ্রাউন্ডে অনেক দল গেছে, অনেক দলের কী হয়েছে, সেটা আপনারা জানেন। তবে সেটাকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি সরকারের আছে। এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনও আমরা সংশোধন করার ব্যবস্থা করেছি। নিষিদ্ধ করার পরেও তাকে শাস্তি দেয়া যাবে না এমনটি নয়। হয়তো নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আর সাজার মধ্যে আসবে না। নিষিদ্ধ করার পর দলটির সম্পদের কী হবে- প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, সেগুলোরও ব্যবস্থা হবে। সেটা আইনে আছে। দলের যারা সদস্য তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা- দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইনমন্ত্রী বলেন, এই দলের অধীনে তারা রাজনীতি করতে পারবে না। বাংলাদেশের কোনো আইনে তারা অপরাধ করলে সেটার বিচার হবে। আপনারা যদি বলেন গণহারে যারা জামায়াতে ইসলামীর নতুন কর্মী রয়েছেন, ১৯৭১ এর পরে যারা জন্ম নিয়েছেন তাদের বিচার করা হবে এরকম গণহারে বিচার করা হবে না। সূত্র জানায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম সমালোচিত দল হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। বাংলাদেশে নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেও দেশের রাজনীতিতে টিকে যাওয়া ও প্রতিষ্ঠা পাওয়া নিয়ে রয়েছে দীর্ঘদিনের হতাশা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়ার কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল নাগরিকদের কাছে দলটি সবসময় ঘৃণিতই ছিল। তারপরও ধর্মীয় আবেগ ও রাষ্ট্রীয় বিভক্তির সুযোগ নিয়ে দলটি রাজনীতিতে স্থায়ী আসন গড়ে নেয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের’ কারণে। সে সময় সংবিধানর ৩৮ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। কেবল স্বাধীন বাংলাদেশেই নয় যে পাকিস্তান নামক দেশে জামায়াতে ইসলামীর জন্ম সেদেশেও তাদের দুবার নিষিদ্ধ করা হয়। প্রথমবার ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়। সে বার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানির অভিযোগে দলটি নিষিদ্ধ হয়। তবে অল্পদিন পরেই তারা আবার রাজনীতি করার সুযোগ পায়। এরপর ১৯৬৪ সালে আবারও নিষিদ্ধ করা হয় জামায়াতকে। এবার কারণ হিসেবে বলা হয় মুসলিম পরিবার আইনের বিরোধিতা। তবে এই নিষেধাজ্ঞাও বেশিদিন ছিল না। পাকিস্তানে যেমন নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে ফিরে আসে একইভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তারা ফেরত এসেছিল। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আগ পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে জামায়াতের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময় ১৯৭৬ সালে ধর্মীয় রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। ফলে রাজনীতিতে পুনরায় ফিরে আসে দলটি। ১৯৭৬ সালের ৩ মে রাষ্ট্রপতি এ.এস.এম সায়েম একটি অধ্যাদেশ জারি করে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।
সূত্র আরও জানায়, এর আগে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশে ৯টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী এসব সংগঠন বাংলাদেশে কোনও ধরনের কার্যক্রম চালাতে পারবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত নিষিদ্ধ এই সংগঠনগুলো হলো- শাহাদত-ই-আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম, আল্লাহর দল এবং জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। নিষিদ্ধ সংগঠনের মধ্যে ২০০৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি চার দলীয় জোট সরকার প্রথমে শাহাদাত-ই-আল হিকমা নামে জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে। এরপর ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশকে (জেএমজেবি) এবং ওই বছরের ১৭ অক্টোবর হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশকে (হুজিবি) নিষিদ্ধ করা হয়। বোমা হামলা চালিয়ে বিচারক হত্যার দায়ে জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। চার দলীয় জোট সরকারের সময় নিষিদ্ধ এসব জঙ্গি সংগঠনগুলোর কয়েকটিকে তৎকালীন সরকারের এমপি মন্ত্রীরা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
এছাড়াও জামায়াত ইসলামীসহ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছয়টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরমধ্যে উগ্রপন্থা প্রচারের জন্য ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর নিষিদ্ধ করা হয় হিযবুত তাহরীরকে। ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তৎপরতা সামনে আসে। পরে ২০১৫ সালের ২২ মে মাসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ করা হয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ হওয়ার পর এর সদস্যরাই সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনাকারী বরখাস্ত মেজর জিয়াউল হকের নেতৃত্বে আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরতা শুরু করে। একের পর এক জঙ্গি হামলা ও হত্যার প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালের মার্চে আনসার আল ইসলামকে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আল্লাহর দল নামের জঙ্গি সংগঠনটি গঠিত হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। ২০০৪ সালের শেষের দিকে এই সংগঠন জেএমবির সঙ্গে একীভূত হয়। ২০০৫ সালের ১৭ অগাস্ট সারা দেশে জেএমবির বোমা হামলায়ও আল্লাহর দলের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যায়। জেএমবি নিষিদ্ধ হলে আল্লাহর দল আবার সক্রিয় হয় আমিন মতিন মেহেদীর নেতৃত্বে। ২০১৪ সালে আল্লাহর দলের নাম পরিবর্তন করে ‘আল্লাহর সরকার’ রাখা হয়। কয়েক বছর দলটির দৃশ্যমান কোনও তৎপরতা না থকলেও নিষিদ্ধ জেএমবির সহযোগিতায় ২০১৯ সালে ‘আল্লাহর দল’ সারা দেশে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার তথ্য আসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ওই সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত আমির ইব্রাহিম আহমেদ হিরোসহ ৮জন সদস্য র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। এরপর ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আল্লাহর দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০২৩ সালের ৯ আগস্ট নিষিদ্ধ করা হয় ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে’। এ সংগঠনটি নিষিদ্ধ সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারের কাছে এ মর্মে প্রতীয়মান হয় যে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামক জঙ্গি দল/সংগঠনটির ঘোষিত কার্যক্রম দেশের শান্তি শৃঙ্খলা পরিপন্থী। ইতোমধ্যে দল/সংগঠনটির কার্যক্রম জননিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত হওয়ায় বাংলাদেশে এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।
এখানে উল্লেখ্য, সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। একই বছর সালের ৭ জুন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশাপাশি বিলুপ্ত করা হয়েছিল আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঘুনে ধরা সমাজকে বাঁচাতে সব দল নিষিদ্ধ করে সবাইকে একই প্ল্যাটফর্মে আনতে বাকশাল গঠন করেন। বাকশালকে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সাধারণ জনগণের পাশাপাশি সামরিক বেসামরিক আমলা ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের বাকশালের অন্তর্ভুক্তির আইনগত সুযোগ ছিল। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর সেটি আর বাস্তবায়িত হয়নি। পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সামরিক ফরমান বলে আবারো বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করলে আওয়ামী লীগসহ পুরনো দলগুলো কার্যক্রম শুরু করে। পাশাপাশি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পথ তৈরি হয়।
ব্রিটিশ আমলে ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে সামাজিক-রাজনৈতিক ইসলামি আন্দোলনের অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী গঠন হয়। জামায়াত ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল। স্বাধীনতা ও ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর দলটির প্রতিষ্ঠাতা আবুল আ’লা মওদুদী ভারত থেকে পাকিস্তান চলে যান।
পাকিস্তান আমলে জামায়াত ইসলামী একবার নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছিল। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের বিরোধিতা করার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ওই সময় মওদুদী ও গোলাম আজমসহ দলটির অন্তত ৬০ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ওই বছর অক্টোবরেই আবার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। জামায়াত ইসলামী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাকিস্তান ভাঙার জোরালো বিরোধিতা করেছিল। দলটির সদস্যরা শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আল-বদর গঠনে নেতৃত্ব দেয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে ডা. আব্দুল মালিককে গভর্নর একটি প্রাদেশিক সরকার গঠন করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের উদ্যোগে গঠিত এ প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী সভায় আব্বাস আলী খানকে (পরবর্তীকালে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির) শিক্ষামন্ত্রী করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াতে ইসলামীও এর আওতায় পড়ে। তখন গোলাম আজমসহ জামায়াতের কিছু নেতা পাকিস্তানে নির্বাসনে চলে যান।
বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর ১৯৭৬ সালের আগস্টে জিয়াউর রহমান সরকার সব ধরনের রাজনৈতিক দলের রাজনীতি উন্মুক্ত করে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষণা করে। এ সময় আবার রাজনীতির ময়দানে ফেরে জামায়াত। ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি নামক একটি দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী যুক্ত হয়। পরে পাকিস্তান থেকে গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে এলে ১৯৭৯ সালের মে মাসে ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ গঠিত হয়। এসময় এর ভারপ্রাপ্ত আমির করা হয় আব্বাস আলী খানকে। এরপর থেকে বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে রাজনীতি করে যাচ্ছে দলটি। তবে স্বাধীন বাংলাদেশেও জামায়াতের বিরুদ্ধে নানা সময়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তোলা হয়েছে। ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে দলটি অংশগ্রহণ করে দলটি। এ ছয়টি সংসদেই দলটির কম বেশি প্রতিনিধিত্ব ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে। এতে দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামী ও মহাসচিব আলী আহসান মুজাহিদসহ শীর্ষ পর্যায়ের চার নেতার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। দলের আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। এক রিটের পর ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। ওই রায়ের পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এদিকে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে জামায়াত ইসলামী আপিল করলে ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর এক আদেশে ওই আপিল খারিজ করে হাইকোর্ট বিভাগের রায় বহাল রাখেন।