
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে নাশকতার ক্ষতচিহ্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে। হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগে সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও যানবাহনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কয়েক দিনের নাশকতার ঘটনায় গাজীপুরের ছয়টি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় ৫০ কোটি ৫৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার থেকে টানা কয়েক দিন ধরে চলা আন্দোলনের নামে নাশকতার ঘটনা ঘটে। নাশকতাকারীরা মহানগরের টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত এলাকায় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। তবে হামলাকারীরা সরকারি অফিসকে কেন্দ্র করে নাশকতা করেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার পুলিশ বক্সটির টিনের চাল, চেয়ার-টেবিল ও আসবাব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এর পাশে সড়ক ও জনপথের কার্যালয়। সেই কার্যালয়ের ভেতরে গিয়ে চারটি পোড়া গাড়ি পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আশপাশের ঘরবাড়ি ও দালানের ভাঙা গ্লাস দেখা যাচ্ছে। গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের স্টেশনগুলোয় রাখা এসকেলেটরগুলোর আংশিক পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনাবাড়ী এলাকায় পুলিশের একটি বক্স পুড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা। টঙ্গীর কলেজ গেট এলাকায় সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৪ বা টঙ্গী কার্যালয় অবস্থিত। মূল ফটকের পাশে সহকারী প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ও যন্ত্র বিভাগের উপসহকারী কর্মকর্তার কক্ষ। দুটি কক্ষেই ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। কক্ষের ভেতরে পড়ে আছে আগুনে পোড়া আসবাব ও কাগজপত্র। কক্ষ দুটির সামনে একটি ফাঁকা জায়গায় সারিবদ্ধ ২০-২৫টি গাড়ি। ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া এসব গাড়ি অকেজো হয়ে পড়েছে। মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে গাড়ির ধ্বংসাবশেষ, কাচ ও বিভিন্ন জিনিসপত্র। কার্যালয়টির সামনে একেবারে দক্ষিণ পাশে একটি টিনের ছাউনির নিচে সারিবদ্ধভাবে রাখা ছয়টি গাড়ি। সবকটি গাড়িই আগুনে পোড়া। হামলাকারীরা চান্দনা চৌরাস্তায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের তিনটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তারা চারটি ট্রাক, হাইড্রোলিক হ্যামার, বিআরটি প্রজেক্টের অফিস গেট, ভবনসহ অন্যান্য মালামাল ভাঙচুর করে। এতে ২ কোটি ১৯ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী খ. মো. শরিফুল আলম জানান, গাজীপুরে যে সহিংসতা হয়েছে তাতে আমাদের আনুমানিক ৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। যানবাহনের পাশাপাশি ইট-পাটকেল ছুড়ে ভবন ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ছাড়া হামলায় বিআরটি প্রজেক্টের ২৫টি এসকেলেটর, দুই হাজার বর্গ মিটার এসএস রেলিং, একটি এক্সকাভেটর, ৩ হাজার কেজি এমএসইওয়াল প্যানেল ফর্ম ওয়ার্ক, ছয়টি ইলেকট্রিক হ্যামার, চারটি ওয়েল্ডিং মেশিন, দুটি রোডকাটিং মেশিন, ৩৬০ মিটার ফেন্সিং ও প্লাস্টিক ট্রাফিক ব্যারিয়ার, সাতটি স্টেশনে জেনারেটর, পানির লাইন ও ইউলিটি সংযোগ এবং একটি প্রকল্প সাইট অফিসের ক্ষতিসাধন হয়েছে। এতে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। উত্তরা থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত নাশকতায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণাধীন স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রকল্পের ক্ষয়-ক্ষতির বিষয়ে ব্রিফিং করেন ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের এমডি ড. মো. মনিরুজ্জামান। তিনি জানান, প্রাথমিক হিসাবে প্রকল্পের প্রায় ৫০-৬০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। টঙ্গীতে ডেসকোর কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে সাতটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ, উপকেন্দ্রের অফিস ভবন, ১০টি কম্পিউটার, সাতটি প্রিন্টার, এসি কমপ্রেসারসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ও সামগ্রী ভাঙচুর করে তিন কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি করা হয়েছে। হামলাকারীরা টঙ্গীর বেক্সিমকো ফার্মার ভেতরে চারটি গাড়ি পুড়িয়েছে। তারা ছয়টি সিসি ক্যামেরা, ছয়টি কাভার্ডভ্যান, দুটি মাইক্রোবাস ভাঙচুর ও বিল্ডিংয়ের ক্ষতিসহ মোট ৩ কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করেছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গাজীপুরা, বোর্ডবাজার, গাছা, কোনাবাড়ী ও চান্দনা চৌরাস্তা পাঁচটি পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে এপিসি গ্লাস। এতে ৩৫ লাখ টাকার ক্ষতি সাধিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া টঙ্গী পশ্চিম থানায় ইট-পাটকেল ছুড়ে ভাঙচুর করা হয়েছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম জানান, দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিতভাবে হামলা করেছে থানা ও পুলিশ বক্সে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তাদের শনাক্ত করা হচ্ছে। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। এ ছাড়া গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১৯টি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে আরও ১৩টি যানবাহন। এর মধ্যে জিপ গাড়ি তিনটি, পিকআপ পাঁচটি, ড্রাম্পট্রাক ১৮টি, কম্পেক্টর একটি, মোবাইল কোর্ট গাড়ি একটি, বিদ্যুতের গাড়ি দুটি, হুইল লোডার একটি, টেম্পু একটি। তারা সিটির জোন-১-এর ভবনের দরজা, জানালা ভাঙচুর এবং নিচতলার তিনটি কক্ষ পুড়িয়ে দেয়। আঞ্চলিক কার্যালয় জোন-৩-এর ভবনের দরজা-জানালাও ভাঙচুর করা হয়। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এএসএম সফিউল আজম জানান, আন্দোলনে সিটি করপোরেশনের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। অনেক যানবাহন পুড়িয়ে দিয়েছে, এতে অনেক কাজ ব্যাহত হচ্ছে। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের হিসাবে ছয়টি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৫০ কোটি ৫৮ লাখ টাকার ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। তবে এই ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।’