
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পেনশন আন্দোলন ও শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অর্থনৈতিক সংকট ও গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে সামাজিক অস্থিরতায় হঠাৎ চাপে পড়েছে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগ সরকার। এমনটি মনে করছে দীর্ঘ ১৭ বছরের অধিক সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দল বিএনপিও। আর সরকারের ওপর এসব চাপের সুযোগ নিতে চায় রাজপথের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত বিএনপি। তবে পাঁচ ইস্যুসহ বিরোধীদের কৌশলে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করবে আওয়ামী লীগ। জানা গেছে, গতকাল বুধবার আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম ছয় মাস অতিবাহিত হচ্ছে। কিন্তু এই ছয় মাসে নানা রকম সঙ্কট মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। তবে এসব ইস্যুতে ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বারবার সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, দুইটা আন্দোলনই অরাজনৈতিক। অরাজনৈতিক আন্দোলনে বিএনপি ও সমমনাদের সমর্থনের বিষয়ে ভাবতে হবে আওয়ামী লীগকে। নিজেরা আন্দোলন করতে পারে না বিএনপি। কোনো অশুভ শক্তি যেন কাজ না করতে পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। জনগণের যেন দুর্ভোগ না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ছাত্রলীগের কেউ যেন উস্কানিতে পা না দেয় এবং নিজেরাও উস্কানি না দেয়। তিনি বলেন, কোটা ও পেনশন নিয়ে চলমান আন্দোলনে ছাত্রলীগ অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে কোনো উস্কানি না দেয়, সে বিষয় নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরইমধ্যে জনগণকে সুন্দর ও উন্নত জীবন দিতে সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আওয়ামী লীগ দেশকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রতিবার চক্রান্ত হয়, সেটা মোকাবিলা করে আমরা বেরিয়ে আসি। আমাদের তা ধরে রাখতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে যে অধিকারগুলো আদায় করেছিল, সেটা আমরা সমুন্নত করতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, পরিস্থিতি বুঝে সুবিধামতো সময়ে সরকারকে চাপে ফেলতে চায় বিএনপি। নানান ইস্যুতে সরকার যত চাপে পড়বে সেই সুযোগে বিএনপিও আন্দোলনের চাপ বাড়াবে। এমন কৌশল নিয়ে দলটি পরবর্তী আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। এ সরকার থাকা মানে হচ্ছে, আমাদের দেশ, গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাওয়া। আমাদের নিজেদের রক্ষা করতে হলে সামনের দিকে অবশ্যই আরও তীব্র থেকে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ আন্দোলনের মাধ্যমেই এদের পরাজিত করতে হবে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, চলতি বছরের শেষের দিকে আমরা নতুন করে নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামতে চাই। একই সুরে কথা বলেছেন বিএনপির উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।
সরকারের সামনে পাঁচ চ্যালেঞ্জ: সরকারের সামনে এখন যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১. শিক্ষার্থীদের আন্দোলন: শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর। বহু সরকার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিল। এমনকি সেনা সমর্থিত এক এগারোর সরকারও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে বিপর্যস্ত হয়েছিল। সরকার এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ভালোভাবেই সামাল দিচ্ছে। একদিকে যেমন সংযত অবস্থানে থাকা, অন্যদিকে আদালতের মাধ্যমে বিষয়টিকে মীমাংসা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এটি যে সরকারের জন্য একটি সুস্পষ্ট চাপ তা সহজেই অনুমান করা যায়। কোটা সংস্কার নিয়ে নিয়ে হাইকোর্টের রায়কে স্থিতাবস্থায় এনেছে। আর এই রায়ের পরেও আন্দোলন থামেনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেছেন যে, এ নিয়ে কমিশন করা এবং স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে। এটি সামনের দিনগুলোতে সরকারের জন্য বড় চাপের কারণ হতে পারে। আগামী দু-একদিনে বোঝা যাবে যে, এই আন্দোলনকে সরকার কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ২. শিক্ষকদের আন্দোলন: সারা দেশে পেনশন স্কিম নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলন এখনও চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা হচ্ছে না। একদিকে শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন, অন্যদিকে শিক্ষকদের পেনশনের আন্দোলন একটি নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। শিক্ষকদের মধ্যে যারা আন্দোলন করছে তারা বেশিরভাগই আওয়ামীপন্থী শিক্ষক। একারণেই শিক্ষকদের এই আন্দোলন নিয়ে সরকারের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। সরকার সামান্য হলেও একটি চাপের মুখে পড়েছে। এই চাপ সরকার কীভাবে সামলাবে সেটিই দেখার বিষয়। ৩. দুর্নীতি: দুর্নীতি নিয়ে যেন দেশে এখন একটা হুলস্থুল কাণ্ড চলছে। প্রতিদিন কোনও না কোনও দুর্নীতিবাজের ফিরিস্তি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির লোমহর্ষক কাহিনী জনগণকে উদ্বিগ্ন করেছে। আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় রয়েছে ১৫ বছর। কাজেই এই দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার এবং দুর্নীতিবাজদের এই লম্ফনের দায় আওয়ামী লীগ কোনভাবেই এড়াতে পারে না। দুর্নীতিটি ইস্যুটি সরকার কীভাবে সমাধান করে সেটি এখন একটি বড় দেখার বিষয়। ৪. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সরকারের জন্য একটি বড় ধরনের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং কাঁচাবাজারে নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যবৃদ্ধি জনগণের মধ্যে একধরনের ক্ষোভ তৈরি করছে। এই অবস্থায় এখনই সরকারের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি বলেই অনেকে মনে করছে। ৫.অর্থনৈতিক সংকট: সরকার একটি কঠিন অর্থনৈতিক সময় পার করছে। এই অবস্থায় অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য সরকার কি করবে তার ওপর নির্ভর করছে সরকারের আগামী দিনের পথচলা।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে সব সময় ষড়যন্ত্র ছিল। এসব ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিরোধের মধ্যদিয়েই আওয়ামী লীগ এগিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। একই কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দেশবিরোধীরা ষড়যন্ত্র করছে। তাদের সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আগামীতেও সব ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে আওয়ামী লীগ।